হতাশ বিএনপির নেতৃত্বে ভজঘট

প্রকাশ | ২৬ মে ২০১৯, ০৯:৩১

বোরহান উদ্দিন, ঢাকাটাইমস

সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেওয়ায় ঠাকুরগাঁও-৩ আসন থেকে নির্বাচিত জাহিদুর রহমান জাহিদ এখনো কি বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত? প্রশ্নটা উঠেছে সঙ্গত কারণেই। তিনি সিদ্ধান্ত অমান্য করে শপথ নিয়েছেন বলে দল তাকে দূরে ঠেলে দেয়। অথচ পরে শপথ নেন আরও চারজন। তবে নেননি দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। যদিও তার আসনে উপ-নির্বাচনে বিএনপি আবার অংশ নিচ্ছে। সব গোলমেলে ঠেকছে কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে। অন্যরা শপথ নিলে ফখরুল কেন নেবেন না? আবার জাহিদ কেন বহিষ্কৃত?

আবার ফখরুল যে আসন থেকে জিতেছিলেন সেই বগুড়া-৬ আসনে মনোনয়ন নিয়ে ঘটেছে অভিনব ঘটনা। দলের কারাবন্দি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষে ফরম তুলে সই নিয়ে আসতে গেলে তিনি রাগ করেছেন। অর্থাৎ ওই আসনে কাকে বিএনপি প্রার্থী করবে- এই বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্ত জানা ছিল না দলের চেয়ারপারসনেরই।

সব মিলিয়ে বিএনপিতে কী হচ্ছে বুঝতে পারছেন না একনিষ্ঠ ভক্ত অনুসারীরাই। দল কী করতে যাচ্ছে, কী চাইছে, তার কোনো আভাস নেই কোথাও।

দুই দফা সরকারবিরোধী আন্দোলনে ব্যর্থতা আর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর হতাশা জেঁকে বসেছে বিএনপিতে। চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া কারাগার থেকে কবে মুক্তি পাবেন, এই বিষয়টি অনিশ্চিত। তার অবর্তমানে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানেরও দেশে ফেরাও নিশ্চিত নয়। এই অবস্থায় দলের সিদ্ধান্ত কীভাবে নেওয়া হচ্ছে তা স্পষ্ট নয়। শীর্ষ নেতাদের মধ্যে বক্তব্যে সমন্বয় নেই।

রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবের কথা নেতাকর্মীদেরও মুখে মুখে ছিল আগে থেকেই। সিদ্ধান্ত নিয়ে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের দুই ধরনের মতামতেরও খবর ছিল। তবে গত নির্বাচনে অংশ নেয়া, নির্বাচনের আগে ঐক্যফ্রন্টে একীভূত হওয়া, সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেয়া, সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ হিসেবে রুমিন ফারহানাকে মনোনয়ন দেওয়ার পর বগুড়া-৬ আসনে উপ-নির্বাচনে অংশ নেয়া নিয়ে এই সমন্বয়হীনতার বিষয়টি আবার সামনে এসেছে। এই নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে নিজের নামে মনোনয়ন সংগ্রহ করায় চটেছেন প্রায় দেড় বছর ধরে কারাবন্দি খালেদা জিয়া।

এসব নিয়ে তৃণমূল থেকে শীর্ষ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ আছে। তবে দলের শৃঙ্খলার কথা চিন্তা করে এ নিয়ে সরাসরি মুখ খুলছেন না কেউ। শুধু তাই নয়, এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আগে যারা নানা হুঁশিয়ারি দিতেন তাদেরও শেষমেশ চুপ থাকতে বাধ্য হচ্ছেন।

বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, সবকিছুতে এখন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান অনেকটা একক সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। কখনো বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, কখনো আবার গুলশান কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের দিয়ে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হয়। সম্প্রতি গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু বিষয়ে দলের নীতিনির্ধারকরাও ছিলেন অন্ধকারে। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আগ মুহূর্তেও তারা জানতে পারছেন না কী হচ্ছে। এসব খবর প্রকাশ্যে আসায় মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা নেমে এসেছে।

সবশেষ ঘটনার দিকে নজর দিলে দেখা যায়, গত ২০ মে সংরক্ষিত নারী আসনের জন্য রুমিন ফারহানাকে মনোনয়ন দেয় বিএনপি। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের স্বাক্ষর করা মনোনয়নপত্র রুমিন সংগ্রহ করেন খালেদা জিয়ার একান্ত সচিব এ বি এম সাত্তারের হাত থেকে। নিয়ম অনুযায়ী একটি সংরক্ষিত আসন পাওয়া নিয়ে আগ্রহী ছিলেন অনেকে। তবে শেষমেশ মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় না থেকেও মনোনয়ন দেওয়া হয় রুমিনকে। এ বিষয়টি সম্পর্কে ওয়াকিবহল ছিলেন না বিএনপির শীর্ষ নেতারা।

তারেক রহমানের সিদ্ধান্তে এমনটা হয়েছে বলে জানাচ্ছেন বিএনপি নেতারা। শুধু তাই নয়, ব্যাংককে যাওয়ার সময় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মনোনয়নপত্রে সই করে চলে যান। তবে রুমিন ফারহানা যখন মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময়ও এ বিষয়ে কিছু জানেন না বলে জানান দলের মুখপাত্র রুহুল কবির রিজভী।

ওই দিন বেলা ১১টার দিকে সংবাদ সম্মেলনে রিজভী বলেন, ‘দল থেকে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি।’ আবারও প্রশ্ন করা হয়, রুমিন ফারহানা বলেছেন তাকে দল থেকে চিঠি দেয়া হয়েছে। জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি বলেছি দল থেকে আমাকে এখনও কেউ জানায়নি, জানালে জানতে পারবেন।’

বিএনপির একজন সহ-দপ্তর সম্পাদক নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘বাস্তবে যাদের যা জানার কথা দলের বিষয় তারা জানছেন না। এটা কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্পষ্ট। মহাসচিবের যা জানা উচিত তিনি হয়ত জানেন না। আবার দপ্তরের যা জেনে আপনাদের (সাংবাদিক) জানানোর কথা তা হয়তো খবরের পর দপ্তর জানছে।’

এরপর আলোচনায় আসে খালেদা জিয়ার নিজ আসন বগুড়া-৬ এর উপনির্বাচন। এই আসন থেকে একাদশ সংসদ নির্বাচনে মির্জা ফখরুল বিজয়ী হলেও তিনি অজ্ঞাত কারণে শপথ নেননি। সেখানেই আবার উপ-নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেয় দলটি। কিন্তু সেকথা জানতেন না স্বয়ং খালেদা জিয়া।

বিএনপি নেত্রীর পক্ষে মনোনয়ন সংগ্রহ করে তার সই আনতে গুলশান কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তাকে পাঠানো হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়া নির্বাচনে যাওয়ার খবর শুনে চটে যান। তাকে প্রার্থী করায় বিস্মিত হয়ে জানতে চান, এই নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত কে নিয়েছে। সই না করে যারা নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ফরম তাদের কাছে নিয়ে যেতে বলেন ক্ষুব্ধ সাবেক প্রধানমন্ত্রী।

বিএনপি নেতারা বলেন, দলের বড় একটি অংশ এই নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে ছিলেন না। তবে তারেক রহমান সিদ্ধান্ত দিয়েছেন ভোটে যেতে। বিএনপির একজন কেন্দ্রীয় নেতা ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘উপ-নির্বাচন নিয়ে চেয়ারপারসন একটা বার্তা দিয়েছেন। তা হলো সরকারের সঙ্গে সমঝোতা বা তাদের অধীনে কোনো নির্বাচন নয়। যারা তাকে প্রার্থী করেছে এটা বাড়াবাড়ি।’

সার্বিক বিষয় নিয়ে অনেকটা ক্ষোভ প্রকাশ করে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম মঞ্জু ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘দেশে গণতন্ত্রের সংকটের মতো বিএনপিও নানাভাবে সংকটাপন্ন। ফল প্রত্যাখ্যান করার পর সেই সংসদে শপথ নেয়ার কারণ আজও জানে না তৃণমূল। এই সিদ্ধান্ত মেনেও নেয়নি নেতাকর্মীরা। চেয়ারপারসন কারাগারে যাওয়ার পর তারেক রহমানের একক নেতৃত্ব পরিচালনা করাও দুরূহ হয়ে গেছে। ফলে দলের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রশ্নে সমন্বয়হীনতা সামনে চলে আসছে।’

দ্রুত নির্বাহী কমিটির সভা ডেকে সব সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা, স্থায়ী কমিটিকে কার্যকর করা, চেয়ারপারসনের মুক্তির জন্য কার্যকর আন্দোলন ঘোষণা চান মঞ্জু।

বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী এ বিষয়ে বলেন, ‘অবশ্যই দলে সমন্বয়হীনতা আছে। ভালো সিদ্ধান্ত নিলেও ভুল প্রক্রিয়ায় বিএনপি হাঁটে। এটাই সমস্যা। এক্ষেত্রে তারেক রহমানকে শীর্ষ নেতাদের নিয়ে চলতে হবে, পরামর্শ করে চলার বিকল্প নেই।’

স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেনের মূল্যায়ন অবশ্য অন্য রকম। তিনি বলেন, ‘অনেক কথা শোনা যায়। কিন্তু আমরা কোনো সমন্বয়হীনতা দেখি না। দল অতীতের মতই সবার মতামতে চলছে।’

আবার বগুড়া-৬ আসনে নির্বাচনের জন্য নাগরিক ঐক্যের প্রধান মাহমুদুর রহমান মান্নাকে বিএনপিতে যোগ দেয়ার বিষয়েও আলোচনা হয়। তবে এই শর্তে রাজি হননি ঐক্যফ্রন্ট নেতা।

বিএনপির চার সংসদ সদস্যেও শপথ, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নাকে বিএনপিতে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব, সংরক্ষিত নারী আসনে মনোনয়ন নিয়ে দলে আলোচনা হয়নি বলে স্বীকার করেন মোশাররফ। বলেন, ‘দলীয় ফোরামের এ বিষয়টি নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। তাছাড়া মান্না সাহেব তো একটি দলের প্রধান। তিনি বিএনপিতে আসবেন কেন? আর তাকে আমরা আনতে চাইবই বা কেন?’

ঢাকাটাইমস/২৬মে/বিইউ/এমআর