ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে আটকে আছে ৪০০ মামলা

প্রকাশ | ২৬ মে ২০১৯, ০৯:৩৬

রিমন রহমান, রাজশাহী ব্যুরো প্রধান

রাজশাহী মেডিকেল কলেজের (রামেক) ফরেনসিক বিভাগে প্রায় ৪০০ লাশের ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন আটকে রয়েছে। ফলে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ নিশ্চিত হতে পারছে না পুলিশ। তাই এসব মৃত্যুর ঘটনায় হওয়া মামলার অভিযোগপত্র দাখিল হচ্ছে না। আর অভিযোগপত্র না পাওয়ায় আদালত বিচার কাজও শুরু করতে পারছেন না।

পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, রাজধানী ঢাকার পর সবচেয়ে বেশি অপরাধ সংঘটিত হয় রাজশাহী অঞ্চলে। খুন হন অনেকে। ঘটে আত্মহত্যার মতো ঘটনাও। এছাড়া অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার তো আছেই। ফলে মৃত্যুর কারণ জানতে শরণাপন্ন হতে হয় রামেকের ফরেনসিক বিভাগের ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনের ওপর।

সদ্য অবসর নেওয়া রামেকের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. এনামুল হক বলেন, ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩৭৫ মরদেহের ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন জমা আছে। যেগুলো এখনো প্রস্তুত হয়নি। তিনি বলেন, সেই সংখ্যার প্রায় অর্ধেকের মতো ছিল আমার সময়ে। নতুন বছরে এ সংখ্যাটি আরও বেড়েছে।

সাবেক এই ফরেনসিক প্রধান আরও বলেন, যেসব ঘটনার গুরুত্ব ছিল, সেসব ঘটনার লাশের ভিসেরা ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন খুব দ্রুত দেয়ার চেষ্টা করেছি। তবে ফরেনসিক বিভাগের জনবল সংকটের কারণে সবগুলো প্রতিবেদন দেওয়া সম্ভব হয়নি। এ সংখ্যা দিন দিন বাড়ে। এখন প্রায় চারশ’র কাছাকাছি হতে পারে।

ডা. এনামুল হকের তথ্যের সঙ্গে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) একাধিক থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের (ওসি) কথার মিল খুঁজে পাওয়া গেছে। জেলার বিভিন্ন থানার ওসি এবং মামলার তদন্ত কর্মকর্তারাও বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তারা বলছেন, ময়নাদতদন্তের প্রতিবেদনের জন্য তারা বার বার রামেকের ফরেনসিক বিভাগে খোঁজ নিচ্ছেন। কিন্তু প্রতিবেদন পাচ্ছেন না। ফলে লাশ উদ্ধারের ঘটনায় যেসব মামলা হয়েছে সেগুলোর অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করা যাচ্ছে না।

নগরীর বোয়ালিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আমান উল্লাহ বলেন, ময়নাতদন্ত রিপোর্ট ও ভিসেরা রিপোর্টের জন্য অনেক মামলার শেষ পরিণতি থেমে আছে। যেগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ মামলা, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ থেকে চাপ দেওয়া হয়। সেগুলো আমরা ব্যক্তিগত যোগাযোগ করে দ্রুত বের করে আনার চেষ্টা করি। তবে এখনো, অনেক মামলা অমীমাংসিত আছে, ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনের জন্য।

এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন রাজশাহী জেলা জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ইবরাহীম হোসেন। তিনি বলেন, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন ছাড়া মামলার অভিযোগপত্র হয় না। আর অভিযোগপত্র ছাড়া বিচার শুরু হয় না। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন ছাড়া বিচার শেষ তো দূরের কথা, শুরুই করা যাচ্ছে না। ফলে আসামিরা শুধু হাজিরা দিচ্ছেন। এদের মধ্যে অনেকেই হয়তো আছেন যে ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন, তারা হয়রানি হচ্ছেন। আবার বিপরীত দিকে আসামিদের দ্রুত সাজা না হওয়ার কারণে তারা জামিন নিয়ে বাইরে থাকছেন। মামলা তুলে নিতে বাদীকে চাপ দিচ্ছেন। এ জন্য লাশের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনগুলো দ্রুত দেয়াটা খুবই জরুরি।

সম্প্রতি সরেজমিনে রামেকের ফরেনসিক বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, একজন চিকিৎসক আর কর্মচারীর সমন্বয়ে পরিচালিত হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ এই তদন্ত প্রতিবেদনের কাজ। সেখানে রবিউল ইসলাম নামে একজন যান তার বোনের হত্যার ফরেনসিক ল্যাব প্রতিবেদনের খোঁজ নিতে। রবিউলের অভিযোগ, এক বছর আগের ঘটনায় ছয় মাস পর ভিসেরা প্রতিবেদন পেলেও পরবর্তী ছয় মাসে পাননি ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন।

বোনের মৃত্যুর বর্ণনা দিয়ে রবিউল ইসলাম বলেন, নতুন সংসারে বোন আমার গলায় ফাঁস দিয়ে মারা যায়। আমাদের প্রথম থেকেই সন্দেহ। বোন আমার মরেনি। তাকে খুন করে ওড়না দিয়ে ফাঁস পড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। বিষয়টা নিশ্চিত হওয়া যাবে পোস্টমর্টেমে। কিন্তু এই রিপোর্টই পাচ্ছি না।

সার্বিক বিষয়ে রামেকের ফরেনসিক বিভাগের বর্তমান প্রধান ডা. রায়হান আহমেদ বলেন, আমাদের দিক থেকে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি ময়নাতদন্তের রিপোর্টগুলো দ্রুত দেয়ার। তবে দেব বললেই হয় না, একটি প্রক্রিয়ার মাধ্য দিয়ে যেতে হয়। প্রায় ৪০০ ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন আটকে থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, আমি অস্বীকার করছি না, ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন জমা নেই। তবে যতগুলো বলা হচ্ছে এতটা না। আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী, যত দ্রুত সম্ভব প্রতিবেদনগুলো ছাড়ার চেষ্টা করছি।

ঢাকাটাইমস/২৬মে/আরআর/এমআর