স্মৃতির পাতায় শাখাওয়াত মবিন চৌধুরী

মহিবুল ইজদানী খান ডাবলু, স্টকহল্ম থেকে
 | প্রকাশিত : ২৬ মে ২০১৯, ১৪:৩৩

ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শ্রদ্ধেয় সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলীর ফেসবুকে গত ২০ মে শাখাওয়াত মবিন চৌধুরীর ইন্তেকালের সংবাদটা প্রথম দৃষ্টিতে পড়ে। সংবাদটি দেখে কিছুক্ষণের জন্য হলেও আমি নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। হটাৎ করে যে তিনি এভাবে আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন তা কখনো ভাবিনি। তবে তার গুরুতর অসুস্থতার কথা আমার জানা ছিল।

শাখাওয়াত মবিন চৌধুরী তার আসল নাম হলেও তিনি সকলের কাছে শাহান নামে পরিচিত। আমি তাকে শাহান মামা বলে সন্মন্ধন করতাম। কারণ তিনি আমার মায়ের আপন চাচাতো ভাই। শাহান মামা ছোট বেলা থেকে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ধানমন্ডী ১৬ নাম্বার রোডে ছিলেন। ১৬ নাম্বার রোডের লেকের পাশেই তাদের বাসা। লেকের ওপারেই ৩২ নাম্বার রোডে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের বাসভবন।

বঙ্গবন্ধুর জ্যৈষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল ভাইয়ের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন শাহান মামা। তারা দুইজন একই সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করতেন। তারা দুইজন সবসময় একই সঙ্গে চলতেন। বলতে গেলে বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তরের সময়গুলোতে সব সময়ই কামাল ভাইয়ের পাশে তাকে দেখা গেছে। এজন্য অনেকে তাকে শেখ শাহান বলেও সম্মোধন করতো। বঙ্গবন্ধুর কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দুইজনই শাহান মামাকে খুব কাছে থেকে চিনেন ও জানেন।

কয়েক সপ্তাহ আগে মামার সাথে টেলিফোনে কথা হয়। বললেন ওয়ার্ল্ড কাপ ক্রিকেট দেখতে লন্ডন আসছেন। ওখান থেকে পরে স্টকহল্ম বেড়াতে আসবেন। স্টকহল্ম দেখার তার খুব ইচ্ছে। কিন্তু শাহান মামার ওয়ার্ল্ড কাপ ক্রিকেট ও স্টকহল্ম দেখা আর হলো না।

শাহান মামাকে ঘিরে আমার রাজনৈতিক জীবনের দুটি স্মরণীয় ঘটনা, যা আমি কোনোদিন ভুলব না। সেদিন টেলিফোনে কথা হওয়ার সময় ঘটনা দুটি তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলামl সিলেটি ভাষায় বললেন, ‘আমার হক্কলতাই মন আছে। সুইডেন গিয়া তুমি বালাই করছো। একবার আইয়া মামারে দেকি যাওরে বা। মামাতো আর বেশিদিন বাঁচতাম নায়। কতদিন দেখছিনা না তোমারে। মামার সাথে আমার আর দেখা হয়নি। শেষ দেখা কবে হয়েছিল আমার মনে নেই।’

৭৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর রাতের একটি ঘটনা। শাহান মামা সেদিন কামাল ভাইয়ের সাথে ছিলেন। ওই দিন রাতে ভুল বোঝাবুঝির কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের গোলচত্বরের কাছে পুলিশের সার্জেন্ট কিবরিয়ার বাহিনীর সাথে গোলাগুলি হলে কামাল ভাই সহ তার সাথের অনেকেই আহত হন। আমি তখন বিজয় দিবসের তপ্তধনী অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে। এত গভীর রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ গেট দিয়ে কয়েকটি গাড়ি এসে প্রবেশ করে। খবর এলো কামাল ভাইয়ের আহত হওয়ার সংবাদ।

আমরা কয়েকজন শহীদ মিনার থেকে ইমার্জেন্সিতে ছুটে গেলাম। ভেতরে গিয়ে দেখি করুণ অবস্থা। বিভিন্ন বিছানায় রক্তাক্ত অবস্থায় কামাল ভাইয়ের সাথীরা কাতরাচ্ছেন। হটাৎ মামু বলে ডাক শুনতেই ফিরে দেখি শাহান মামার রক্তাক্ত হাত আমাকে ইশারা দিয়ে কাছে আসতে বলছে। পাশে যেতেই বললেন, তার এই অবস্থার কথা বাড়িতে যেন না জানাই।

আমি কামাল ভাইয়ের কথা জিজ্ঞেস করতে বললেন, কামালকে ইন্টেনসিভে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ওর অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। একটু এদিকে ফিরে দেখি মোহাম্মদপুরের বরকত ভাই। উনি আমার কাছে আগে থেকেই পরিচিত ছিলেনl কারণ আমি তখন মোহাম্মদপুর থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। এই কমিটিতে বরকত ভাইও ছিলেন। কমিটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন কামাল ভাইয়ের আরেক সহপাঠী ও বন্ধু বাদল ভাই। সেদিন বেশ কিছু সময় আমরা হাসপাতালের জরুরি বিভাগে কামাল ভাইকে নিয়ে খুব চিন্তিত ছিলাম। একসময় বিপদ আশঙ্কা কেটে গেলে আমরা হাসপাতাল থেকে চলে আসি।

মামার সাথে আমার দ্বিতীয়বার দেখা হয় পঁচাত্তরের ৪ নভেম্বর। সেদিন ছাত্রলীগ সারা দেশে হরতালের ডাক দেয়। ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফ সামরিক অভ্যুত্থান করে জিয়াউর রহমানকে বন্দি করেনl ওইদিন আমরা মৌন মিছিল নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসায় গিয়েছিলাম। পরবর্তীতে হরতালকে সফল করার জন্য ধানমন্ডি ২ নাম্বার রোড, সাইন্স লেবরেটারির মোড় দেখার জন্য আমার উপর দায়িত্ব দেওয়া হয়। আমি সিটি কলেজ, আইডিয়াল কলেজ, সেন্ট্রাল কলেজের (সম্ভবত এখন আর নেই) কর্মীদের নিয়ে রাস্তা দিয়ে যাওয়া বাস ও যানবাহন চলাচল বন্ধের তদারকি করছিলাম। এসময় দুই নাম্বার রোডে বাংলাদেশ বেতারের একটি বভন ছিল। শাহান মামা ওই ভবনের উপর থেকে আমাকে উদ্দেশ্য করে চিৎকার করে বলেছিলেন, মামু বাসায় যাও। দেশের অবস্থা ভালো নয়। তোমরা সবাই এখন থেকে সরে যাও। যে কোনো সময় মিলিটারির গাড়ি আসতে পারে। সম্ভবত শাহান মামার সাথে এটাই আমার শেষ কথা ও শেষ দেখা।

ইন্তেকালের পূর্বের দিনগুলোতে হটাৎ করে আবার যোগাযোগ সৃষ্টি হয়। সেই যোগাযোগের সূত্র ধরে আমাকে তিনি দুইটি ছবি পাঠিয়েছিলেন এবং প্রায়ই গুড মর্নিং গুড ইভিনিং জানাতেন। ওয়ার্ল্ড কাপ দেখতে আসা ও সুইডেনে আমার বাসায় আসা শাহান মামার আর হলো নাl এতদিন পর দেখা হবে এই আশায় বসেছিলাম। কিন্তু তা আর হলো না। আজ শুধু কামনা করি আল্লাহ যেন তাকে ক্ষমা করে দেনl মামু তুমি আমার মনে প্রাণে সবসময় চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

লেখক: সুইডেন প্রবাসী

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :