ব্যাংক খাতের বিনিয়োগকারীরা ‘ঠকেছে’ নগদে

প্রকাশ | ২৭ মে ২০১৯, ১০:০৮ | আপডেট: ২৭ মে ২০১৯, ১০:০৯

রহমান আজিজ, ঢাকাটাইমস
ফাইল ছবি

একটি বেসরকারি ব্যাংক শেয়ারপ্রতি দেড় টাকা করে নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করতে চাইলেও আটকে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। পরে বোনাস শেয়ার দিতে হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারধারীদের। আরেকটি ব্যাংক শেয়ারপ্রতি এক টাকা নগদে বিতরণ করতে চেয়েছিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক রাজি না হওয়ায় শেয়ারপ্রতি ৫০ পয়সা নগদে বিতরণ করেছে তারা।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোকে মুনাফা ঘোষণার আগে বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রস্তাব পাঠাতে হয়। অন্য কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থার মতামত নেওয়া জরুরি না হলেও ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এটা বাধ্যতামূলক।

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করতে না দেওয়ার বিষয়ে কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্য অবশ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বীকার করতে চাইছে না। তারা বলছে, ব্যাংকগুলোর পুঁজির গুণগত মান ও ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে ব্যাসেল-৩ নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। এতে বেশ কিছু ব্যাংক মূলধন বাড়াতে নগদ অর্থ হাতে রেখেছে বেশি। 

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত অধিকাংশ ব্যাংকের মুনাফা আগের বছরের চেয়ে বাড়লেও তাদের লভ্যাংশ কমেছে। একাধিক ব্যাংক নগদ মুনাফা বিতরণ করতে চাইলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক রাজি হয়নি। ফলে বোনাস শেয়ারেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে বিনিয়োগকারীদের।

তালিকাভুক্ত ৩০টি ব্যাংকের মধ্যে এবি আর আইসিবি ইসলামী ব্যাংক গত বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও কোনো মুনাফা দেয়নি। বাকি ২৮টি ব্যাংক সর্বনিম্ন ১০ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ১৫০ শতাংশ মুনাফা বিতরণ করেছে। তবে এই মুনাফার মধ্যে সিংহভাগই শেয়ার।

ব্যাংকগুলোর মধ্যে কেবল চারটি সম্পূর্ণ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। নগদ ও বোনাস মিলিয়ে ঘোষণা করেছে আটটি। আর ১৬টি ব্যাংক কেবল বোনাস শেয়ার দেবে। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির বোনাস শেয়ার ঘোষণার প্রবণতায় রাশ টানার আলোচনার মধ্যেই ব্যাংকগুলোর এই প্রবণতা নিয়ে খুব একটা খুশি নন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। কারণ, গত চার-পাঁচ বছর নগদ কিছু না কিছু বিতরণ করেছে এমন ব্যাংকও এবার কেবল বোনাস শেয়ার বিতরণ করেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি বেসরকারি ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘এ বছর আমরা পুরোটাই নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চাপে সেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছি। শেষ পর্যন্ত পুরো লভ্যাংশই আমরা বোনাস শেয়ার হিসেবে দিয়েছি।’

এই ব্যাংকটি আগের টানা পাঁচ বছরই মুনাফা হিসেবে বোনাসের পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নগদ বিতরণ করেছে। কোনো কোনো বছর নগদ লভ্যাংশ ব্যাংকের সুদ হারের চেয়ে বেশি ছিল। এতে বিনিয়োগকারীরা আর্থিক দিক থেকে লাভবান হয়েছিল। তবে এবার কোনো অর্থই পায়নি তারা।  

অন্য একটি বেসরকারি ব্যাংক এবার পাঁচ শতাংশ বোনাস শেয়ারের পাশাপাশি এক টাকা নগদে বিতরণ করতে চেয়েছিল। এই ব্যাংকটি গতবারও নগদে মুনাফা বিতরণ করতে চেয়েছিল। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক রাজি না থাকায় বোনাস শেয়ার দিতে বাধ্য হয় তারা। এবার প্রথমবারের মতো পাঁচ শতাংশ অর্থাৎ শেয়ারপ্রতি ৫০ পয়সা নগদে বিতরণের ঘোষণা দিয়েছে তারা, যদিও এর দ্বিগুণ অর্থ পেতে পারত বিনিয়োগকারীরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, ‘বোনাস লভ্যাংশ দিলে শেয়ারহোল্ডারদের নগদ আয় কমে যায়। এ কারণে অনেক বিনিয়োগকারী নগদ লভ্যাংশ পছন্দ করে। তবে ব্যাংকগুলো যদি তাদের মূলধন বাড়িয়েও আয়ের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারে তাহলে সবার জন্যই ভালো। কিন্তু ঠিকমতো মুনাফা করতে না পারলে সবার জন্যই ক্ষতি।’

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম অবশ্য ব্যাংকগুলোকে নগদ মুনাফা বিতরণে বাধা দেওয়ার অভিযোগ স্বীকার করেননি। তিনি বলেন, ‘বোনাস লভ্যাংশ দেওয়ার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চাপ সৃষ্টি করার কিছু নেই। ব্যাসেল-৩ অনুযায়ী ২০১৯ সালের মধ্যে সব ব্যাংককে ঝুঁকিকৃত সম্পদের সাড়ে ১২ শতাংশ মূলধন সংরক্ষণ করতে হবে। তারা সেটাই করছে। কিন্তু যাদের প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে তারা চাইলেও নগদ লভ্যাংশ দিতে পারছে না। এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চাপের কারণে নয় বরং তাদের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার কারণে।’

ব্যাসেল-৩ অনুযায়ী, বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহকে ২০১৫ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত মূলধন সংরক্ষণ করতে হবে তাদের ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের যথাক্রমে ১০, ১০.৬২৫, ১১.২৬, ১১.৮৭৫ এবং ১২.৫০ শতাংশ। যেখানে ব্যাসেল-২ অনুযায়ী ব্যাংকগুলোকে তাদের ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ শতাংশ মূলধন সংরক্ষণ করতে হতো। ব্যাংকের ঋণ, আমানত, খেলাপিসহ সব সম্পদই ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের অংশ।

আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং রীতিনীতি অনুযায়ী, একটি ব্যাংকের মোট ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ শতাংশ অথবা ৪০০ কোটি টাকার মধ্যে যেটি বেশি সেই পরিমাণ মূলধন রাখতে হয়। ব্যাসেল-৩ নীতিমালার আলোকে ২০১৬ সাল থেকে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ শতাংশের অতিরিক্ত হারে মূলধন রাখতে হচ্ছে। প্রতিবছর শূন্য দশমিক ৬২৫ শতাংশ হারে অতিরিক্ত মূলধন রেখে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে গিয়ে একটি ব্যাংককে ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ মূলধন রাখতে হবে। অতিরিক্ত এ মূলধনকে ব্যাংকিং পরিভাষায় আপদকালীন সুরক্ষা সঞ্চয় বা কনজারভেশন বাফার বলা হয়।

ব্যাংকের লভ্যাংশ

চলতি বছর কেবল নগদ মুনাফা দিয়েছে যেসব ব্যাংক, তার মধ্যে যমুনা ব্যাংক শেয়ারপ্রতি দুই টাকা, প্রাইম ব্যাংক এক টাকা ২০ পয়সা এবং ইসলামী ও এক্সিম ব্যাংক এক টাকা করে নগদে লভ্যাংশ বিতরণ করেছে।

নগদ ও বোনাস মিলিয়ে লভ্যাংশ ঘোষণাকারী ব্যাংকগুলোর মধ্যে ইবিএল ১০ শতাংশ বোনাস ও শেয়ারপ্রতি দুই টাকা নগদ, উত্তরা ব্যাংক ২ শতাংশ বোনাস ও শেয়ারপ্রতি দুই টাকা নগদ, আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক ২ শতাংশ বোনাস ও শেয়ারপ্রতি দেড় টাকা নগদ, পূবালী ব্যাংক ৩ শতাংশ বোনাস ও শেয়ারপ্রতি এক টাকা নগদ, সিটি ব্যাংক ৫ শতাংশ বোনাস ও শেয়ারপ্রতি ৬০ পয়সা নগদ, ব্যাংক এশিয়া, এনসিসি ও ঢাকা ব্যাংক ৫ শতাংশ বোনাস ও ৫০ পয়সা করে নগদ ঘোষণা করেছে।

আর লভ্যাংশ হিসেবে কেবল বোনাস শেয়ার ঘোষণাকারী ব্যাংকগুলোর মধ্যে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ১৫০ শতাংশ, প্রিমিয়ার ব্যাংক সাড়ে ১৫ শতাংশ, ব্র্যাক ও মার্কেন্টাইল ব্যাংক ১৫ শতাংশ করে, মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ১১ শতাংশ এবং ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, আইএফআইসি, ন্যাশনাল, ওয়ান, রূপালী, শাহজালাল, স্যোশাল ইসলামী, সাউথইস্ট, স্ট্যান্ডার্ড, ট্রাস্ট ব্যাংক এবং ইউসিবি ব্যাংক ১০ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ বিতরণ করেছে।

(ঢাকাটাইমস/২৭মে/আরএ/জেবি)