মোদির ফেরা: ভারতীয় মুসলমানদের নতুন করে ভাবতে হবে

প্রকাশ | ২৭ মে ২০১৯, ১৪:৩২ | আপডেট: ২৭ মে ২০১৯, ১৪:৫০

আমিনুল ইসলাম

তবে কি মোদির রাজ্যেই মুসলমানরা বেশি নিরাপদ?

এক ট্যাক্সিচালকের মুখে এই মন্তব্য শুনে আমি চমকে গেলাম। সময়টা ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাস। বাংলাদেশে নির্বাচন নিয়ে মহা শোরগোল। সরকার ও বিরোধী দলের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিতে দেশ অচল প্রায়। গিয়েছিলাম ওডিশা। হিন্দুদের অত্যন্ত পবিত্র তীর্থস্থান পুরী থেকে ট্যাক্সিতে করে যাচ্ছিলাম ভারতের বৃহত্তম হৃদ চিলকা হৃদ দেখতে। এই সেই হৃদ-যা দেখে অত্যন্ত মুগ্ধ হয়ে কবিতা লিখে ফেলেছিলেন-বুদ্ধদেব বসু। যার নাম-চিল্কায় সকাল।

কী ভালো আমার লাগলো

আজ এই সকাল বেলায়

কেমন করে বলি-

কী নির্মল নীল আকাশ-

কী অসহ্য সুন্দর-

যা হোক, ভারতজুড়ে মোদি ঝড়ের সূচনালগ্ন ছিল সেই সময়টা। নিশ্চিত হয়েছিল- আগামী নির্বাচনে মোদিই হবেন বিজেপির পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী। ১০ বছর টানা ক্ষমতায় থাকার কারণে কংগ্রেসের পরাজয়টা ছিল ¯্রফে সময়ের ব্যাপার। তার মানে মোদিই হতে যাচ্ছেন ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী।

ট্যাক্সিওয়ালা ছিলেন একজন বাঙালি। একসময় পুরীসহ সমগ্র ওডিশার দাপিয়ে বেড়াত বাঙালিরা। আলাদা রাজ্য হিসেবে ওড়িশা গঠনের পর বাঙালিদের দাপট কমেছে। তবুও পুরীতে অধিকাংশ লোকই বাংলা বলতে পারে। বাঙালি হিন্দুুদের কাছে পুরী হচ্ছে-আধ্যাত্মিক রাজধানী। যেহেতু আমি বাংলাদেশের একজন মুসলমান, ট্যাক্সিওয়ালার প্রতি আমার প্রথম প্রশ্ন ছিল- ‘কুখ্যাত গুজরাট দাঙ্গার কলঙ্ক বয়ে চলা একজন লোক ভারতের প্রধানমন্ত্রী হবেন-তাহলে ভারতের মুসলমানদের অবস্থা কী হবে?’

স্বল্পশিক্ষিত ট্যাক্সিওয়ালা যেন তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন এবার। বললেন- ‘এসবই অন্ধ কংগ্রেস সমর্থকের কথা। বলুন তো দাদা-স্বাধীনতার পরে ভারতে এখন পর্যন্ত কতগুলো দাঙ্গা হয়েছে?’

আমি বললাম-কয়েক হাজার তো হবেই।

তিনি বললেন-যে যে জায়গায় দাঙ্গা হয়েছে, সেসব জায়গার মুখ্যমন্ত্রীদের নাম বলতে পারবেন?

আমি বললাম-কী আজব প্রশ্ন। দাঙ্গার ঘটনার সাথে মুখ্যমন্ত্রীর নাম জানার কী সম্পর্ক?

ট্যাক্সিওয়ালা এবার বিজয়ের হাসি হেসে বললেন-‘দেখলেন তো, কত জায়গায় কত দাঙ্গা হয়, কেউ মুখ্যমন্ত্রীর নাম মনে রাখার প্রয়োজন পর্যন্ত বোধ করে না। আর গুজরাট দাঙ্গা মানেই মোদি। অথচ মোদি গুজরাট দাঙ্গা মোকাবেলায় কত ভূমিকা যে পরবর্তী সময়ে নিয়েছেন, সে খবর কি আছে আপনাদের? শুধু মোদি মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন বলেই তিনি দায়ী?’

ট্যাক্সিওয়ালা বলতেই লাগলেন- ‘মোদির সামনে কেউ দাঁড়াতে পারবে না ভবিষ্যতে। মোদি মানে উন্নয়ন। মনে রাখবেন-মোদি কিন্তু চোর না। আর কংগ্রেস হচ্ছে চোরদের সমিতি। তাই, কংগ্রেস চায় মোদির চরিত্রে চিরস্থায়ী ক্ষত ঢেলে দিয়ে নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে।’

দুই.

ট্যাক্সিওয়ালার কাছ থেকে মোদির এসব প্রশংসা শুনে ভাবলাম-একপাক্ষিক চিন্তা আমাদের সিদ্ধান্তকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। আমি মোদিকে গুজরাট গণহত্যার হোতা হিসেবে এতদিন জানতাম। এখন তো দেখছি এ লোক -অন্যরকম কথা বলে। তাহলে চোখ-কান খোলা রেখে এ জিনিসটা সম্পর্কে আমাকে জানতে হবে নিজের মতো করে। যেহেতু-পুরো ভারত ঘোরার সুযোগ আমার আছে, তাই এ জিনিসটা সম্পর্কে আমাকে জানতে হবে।

কলকাতায় ফেরত এসে সংগ্রহ করলাম-বিচারপতি সাচার কমিটির রিপোর্টের খসড়া। পড়ে তো চক্ষু চড়কগাছ। ভারতের কোন রাজ্যে মুসলমানরা কেমন আছে তার ওপর একটা রিপোর্ট। আমাদের পড়শি রাজ্য প্রগতিশীল পশ্চিমবঙ্গে সরকারি চাকরিতে মাত্র ১.২ শতাংশ মুসলমান চাকরি করে। আর মোদির রাজ্য গুজরাটে এই হার প্রায় ১৪ শতাংশ। যে পশ্চিমবঙ্গে প্রকাশ্যে গরু জবাই হয় ২৪ ঘণ্টা, মুসলমানদের কেউ আঘাত করে না-সেখানে মুসলমানদের এই অধঃপতন? তাহলে গুজরাটের মুসলমানরাই তো ভালো আছে। যে উত্তর প্রদেশে মুসলমানদের অঘোষিত অভিভাবক হচ্ছেন-সমাজবাদী পার্টির মুলায়ম সিং যাদব (যিনি আবার মাওলানা মুলায়ম নামেও পরিচিত), তাদের শাসনামলেই হয় একটার পর একটা দাঙ্গা। আর কী অবাক কা-! ২০০২ সালের পর গুজরাটে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে বিন্দুুমাত্র দাঙ্গার কোনো ঘটনা ঘটেনি।

তাহলে মোদিকে নিয়ে মুসলমানদের সমস্যা কী? অবশ্যই সমস্যা আছে। মোদি হচ্ছেন হিন্দুু ভারতের পুনর্জীবন দানকারী একজন তাত্ত্বিক গুরু ও সন্নাসী। তার স্বপ্নের ভারত হচ্ছে হিন্দুত্ববাদী ভারত। যে ভারতে মুসলমানসহ অন্যান্য সংখ্যালঘুরা থাকতে পারবে হিন্দুত্ববাদকে মেনে নিয়েই।

সংখ্যালঘুদের সমস্যাটা এখানেই। বিশ্বের সব দেশেই সংখ্যালঘুদের মনে একটা মানসিক ভয় কাজ করে। হোক সেটা ভারতের মুসলমান সম্প্রদায়, কিংবা বাংলাদেশের হিন্দুু সম্প্রদায়। সংখ্যালঘুদের আরেকটা সমস্যা হচ্ছে রাজনৈতিক। নির্দিষ্ট কোনো দলের ভোটব্যাংকে পরিণত হওয়ার ভয় থাকে। ভারতের মুসলমানদের এই দুই ধরনের ভয়ের মধ্য দিয়েই যেতে হচ্ছে।

তিন

প্রথমে রাজনৈতিক ভয়টা নিয়েই আলোচনা করা যাক। স্বাধীনতার পর থেকে ভারতের মুসলমানরা ভোট দিয়ে আসছে কংগ্রেসকে। বামসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক দলগুলোকেও ভোট দিয়ে আসছে। কিন্তুু মুসলমানরা বিজেপিকে কেন ভোট দেবে? যে দলটার জন্মই হয়েছে-মুসলিম বিরোধিতাকে পুঁজি করে-মুসলমানরা তাই বিজেপিকে ভোট দিতে পারে না। বিজেপিও খেলল মোক্ষম চাল। সমাজে তৈরি করল মেরুকরণ।

বিজেপি মনে মনে বলেই আসছে বহুদিন ধরে-দরকার নেই মুসলমান ভোটের। ভারতে ভোট হয় জাতপাতের সমীকরণ মিলিয়ে, বহু পাটিগণিতকে আশ্রয় করে। হিন্দুদের ভোট পেলেই জিতে যাবে বিজেপি। বাস্তবে হলোও তাই। হয়ত মুসলমানদের মধ্যে বিজেপিকে ভোট দেওয়ার প্রবণতা একটু হলেও বাড়তে পারে। কিন্তু মুসলমানদের কোনো ধরনের সমর্থন ছাড়াই বিজেপির এই বিজয়। ভারতে গত পাঁচ বছর ধরে মুসলমানরা লক্ষ্য করল তাদের ভোটের কোনো দাম নেই। তারা যাদের ভোট দেয় তারা ফেল করে। আর তারা যাদের ভোট দেয় না, তারা ক্ষমতায় যায়। বলাই বাহুল্য-ভারতের ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক জোট মুসলমানদের কাছে এখন আর ভোট চাইতেও যায় না।

এবার আসল প্রসঙ্গে আসি। এজন্য মূলত দায়ী কংগ্রেস। এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতাসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক দল। কংগ্রেসসহ এসব বিভিন্ন দল মুসলমান দরদি সাজে ¯্রফে ভোটের জন্য। কিন্তু মুসলমানদের উন্নতির দিকে মন নাই কারো। হাজার হাজার মক্তব আর মাদ্রাসায় ছেয়ে গেছে পশ্চিমবঙ্গে রাজ্যের উৎসাহে। মমতা এবং কংগ্রেস মুসলমান দরদি কিন্তু মুসলমানদের উন্নতিবান্ধব নয়। মুসলমানদেরকে অন্ধকারে রাখতে পারলেই যেন তাদের লাভ। অজ্ঞ মুসলমানরা ভোট দেবে কংগ্রেসকে। এটাই হয়ে আসছে। কিন্তুু এবার বিজেপির রাজনৈতিক খেলায় মুসলমানরা মূল্যহীন হয়ে পড়েছে। বিজেপি ভালো করে জানে ২০ কোটি মুসলমানকে ভারত থেকে বিতাড়িত করা পুরোপুরি অসম্ভব। তাই রাজনৈতিক মঞ্চে মুসলমানদেরকে তুচ্ছ করে কথা বলে বিজেপি। মুসলমান ভোটের তোয়াক্কা করে না তারা।

বিখ্যাত সাংবাদিক রাজদ্বীপ সারদেশাই যখন মোদিকে প্রশ্ন করেন-আপনি ভারতের যে প্রান্তেই যান না কেন আপনি তাদের সংস্কৃতির সাথে একাত্ম হয়ে তাদের মতো পোশাক পরেন, কিন্তু একটিবারের জন্য টুপি পরেন না কেন? মোদি রেগে গিয়ে উত্তর দেন-এসব আমি আমার পূর্বসূরি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের কখনো এসব পরতে দেখিনি। তাই পরব না। কতই না ভালো হতো মোদি যদি একটি বারের জন্য মুসলমানদেরকে ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করতেন। মুসলমানদেরকে অভয় দিতেন। তাহলে ভারতে গরুর মাংস পাওয়ার গুজব ছড়িয়ে মানুষ হত্যার ঘটনা অনেক কমে যেত। মোদি সেটা করবেন না রাজনৈতিক কারণে। কারণ মোদি জানে মুসলমানদের ভোট ছাড়াই তিনি ক্ষমতায় থাকতে পারবেন।

তাহলে মুসলমানদের উপায় কী? তারা কি ভারতবর্ষ ত্যাগ করবেন? কখনই নয়। মনে রাখতে হবে-ভারত রাষ্ট্রের আইনকানুন, বিচার বিভাগ, সংবিধানের জোর-এসব বাংলাদেশ-পাকিস্তান থেকে অনেক উপরে। মোদি এবং তার বাহিনী মুসলমানদের কিছুই করতে পারবে না, ভারত রাষ্ট্রের সাংবিধানিক শক্তির কারণে। সাম্প্রতিককালে কেউ কি শুনেছেন-কোনো ভারতীয় মুসলিম পরিবার পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশে এসেছে বসবাস করতে? এই যে আসামে নাগরিক পঞ্জি সংশোধনের নামে ৪০ লাখ নাগরিককে আপাত গৃহহীন করে রাখা হলো, তাদেরকে কি বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হবে? প্রশ্নই আসে না। এগুলো হচ্ছে ফাঁকা বুলি। বিজেপির রাজনৈতিক স্ট্যান্টবাজি।

মুসলমানদের উপায় হচ্ছে -কোনো রাজনৈতিক দলের লেজুরভিত্তিক সমর্থক হওয়া থেকে বিরত থাকা। শিক্ষায় বিনিয়োগ করে-অগ্রসর ভারতীয় সমাজের অংশ হয়ে ওঠা। আশার কথা, বিগত পাঁচ বছর যাবত ভারতের অনেক প্রদেশে মুসলমানরা সে কাজটাই করছে। ভোটের রাজ্যে তারা গুরুত্বহীন হয়ে উঠেছে আপাাতত। কিন্তু দক্ষ নাগরিক হলেই তারা ভারতের সম্পদে পরিণত হতে পারবে। তখন আর কেউ তাদেরকে উপেক্ষা করতে পারবে না। আর বিজেপির পরাজয়ে বিষন্ন হওয়ার কিছু নাই। এই প্রতিকূল পরিস্থিতিই মুসলমানদেরকে নতুন করে ভাবতে শেখাবে।

(আগামীকাল পড়–ন: ভারতীয় মুসলমানদের মানসিক ভয়)

লেখক : পরিচালক, ইংলিশ এডভেঞ্চার