একটি জন্মের প্রয়োজনে আর কোনো মায়ের মৃত্যু নয়

প্রকাশ | ২৮ মে ২০১৯, ১৮:১৯

ডা. ফাহমিদা শিরীন নীলা

আজ ২৮ শে মে। নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস। কেন আমরা এই দিনটি ঘটা করে উদযাপন করছি। কি প্রয়োজন? উদ্দেশ্য কি? এই সকল প্রশ্নের উত্তরের আগে কিছু তথ্য জেনে নেয়া জরুরি। এদেশে প্রতিদিন গর্ভজনিত কারণে মারা যাচ্ছে ১৪ থেকে ১৫ জন মা। সে হিসেবে সারা বছরে মারা যাচ্ছেন ৫ হাজার ৪৭৫ জন। এর মধ্যে ৫৪ শতাংশ মা মারা যাচ্ছেন হোম ডেলিভারির কারণে। শতভাগ হাসপাতাল ডেলিভেরির জন্য চেষ্টা করা হলেও এখন পর্যন্ত এর হার ৪৭ শতাংশ, যা হোম ডেলিভারির চেয়ে কম।

উপরের তথ্যগুলো থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট যে, এই দেশে মাতৃমৃত্যু হার যেভাবে কমার কথা ছিল তা কমছে না। কিন্তু কেন? কারণ, জনগণের অসচেতনতা, আপনাদের অসতর্কতা।

গর্ভকালীন সময়ে কমপক্ষে চারটা চেকআপ করা অত্যাবশক। এই শিডিউল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক নির্ধারিত। এখন পর্যন্ত কেবলমাত্র ৩৭ শতাংশ মা এই শিডিউল অনুসরণ করছেন। ফলে যারা চেকআপের আওতায় থাকছেন না, তারা বিভিন্ন গর্ভকালীন জটিলতায় ভুগলেও তা রয়ে যাচ্ছে অজানা। এরা ডেলিভারির আগে বা পরে কিংবা ডেলিভারিকালীন সময়ে জটিলতার চরম পর্যায়ে উপনীত হচ্ছে যা তাকে ঠেলে দিচ্ছে মৃত্যুর দিকে।

এসব ক্ষেত্রে অনেক মা বা তার পরিবারকে বলতে শুনি, আমরা কোনো ডাক্তার দেখাইনি কারণ কোন সমস্যা হয়নি। এটি হচ্ছে, সবচেয়ে সস্তা এবং হাস্যকর যুক্তি। মনে রাখবেন, আপনার প্রেসার বেড়ে গেলে, ডায়াবেটিস হলে, বাচ্চার কোন জটিলতা দেখা দিলে, ফুল নীচে থাকলে, বাচ্চার পজিশন উল্টাপাল্টা থাকলে আপনার শরীর বা আপনার গর্ভস্থ সন্তান আপনাকে ডেকে সাবধান করে দেবে না। খুব বেশী হলে কিছু উপসর্গের মাধ্যমে আপনাকে ইঙ্গিত দিতে পারে। তবে সে ইঙ্গিতও আপনি বুঝবেন কি না সন্দেহ আছে।

একটা উদাহরণ দিই। ধরুন, আপনার পায়ে পানি ধরেছে। চোখমুখ ফুলে গেছে। আপনার আত্মীয়-প্রতিবেশী বললো, এটা সব গর্ভবতীরই হয়। আপনি নিশ্চিন্তে বাড়িতে বসে থাকলেন। অথচ এটা যে আপনার প্রেসার বাড়ার লক্ষণ সেটা আপনি জানতেও পারলেন না। ফলাফল, হুট করে একদিন একলাম্পসিয়া বা খিঁচুনী। বাচ্চা তো বটেই আপনার জীবন নিয়ে পড়ে যাবে টানাটানি। এখানে একটা কথা না বলেই পারছি না, কখনোই পল্লী চিকিৎসকদের প্রেসার পরিমাপ বিশ্বাস করবেন না। 'আপনার প্রেসারই নাই' কিংবা 'আপনার তো লো প্রেসার' এই দুই ডায়ালগ তারা তোতা পাখির মতো মুখস্থ বলে।

তা যা বলছিলাম, ব্লাড প্রেসারের মতো আপনার শরীরে আরও অনেক পরিবর্তনই দেখা দিতে পারে যা রয়ে যায় আপনার অজানা। নিয়মিত গর্ভকালীন চেকআপ না করলে এই সকল অজানা, অনাকাঙ্খিত পরিবর্তন আপনার বা আপনার বাচ্চার মৃত্যুর কারণ হতে পারে। সুতরাং, গর্ভকালীন সময়ে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে না পারলেও অন্তত একজন এমবিবিএস ডাক্তারের কাছে নিয়মিত চারটি চেকআপ করান। আপনার নিকটস্থ সকল সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রেই এখন প্রসূতীপূর্ব চেকআপের ব্যবস্থা আছে। কখন কখন করাবেন এই চেকআপ? প্রথমটি আপনি গর্ভবতী এটা জানার সাথে সাথেই অর্থাৎ প্রথম তিন মাসের মধ্যে, দ্বিতীয়টি ছয় থেকে সাত মাসের মধ্যেই, তৃতীয়টি অষ্টম মাসে এবং চতুর্থটি নবম মাসে। এই চেকআপের ফলে একদিকে আপনি এবং আপনার শিশু যেমন সুরক্ষিত থাকবেন, অন্যদিকে আপনার ডেলিভেরী সংক্রান্ত বিষয়েও সঠিক এবং যথাযথ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবেন।

এবার আসি, ডেলিভেরি প্রসঙ্গে। ডেলিভেরি কেন বাড়িতে না করে হাসপাতালে করবেন? কারণ সেই একই। জটিলতা এড়াতে। ডেলিভেরিকালীন সময়ে হুট করেই যেকোন জটিলতা দেখা দিতে পারে। নরমাল ডেলিভারি একটা নরমাল ফিজিওলজিক্যাল প্রসেস হলেও এর যেকোন স্টেজে গিয়ে পুরো প্রসেস থমকে যেতে পারে। হুট করে এই সময় মা বা বাচ্চার জটিলতা দেখা দিতে পারে। এছাড়াও অনেকগুলো কারণ আছে যেগুলোতে কোনভাবেই নরমাল ডেলিভারি হবে না। যেমন, ফুল নীচে থাকলে, বাচ্চা উলটো থাকলে, বাচ্চার মাথা মায়ের জননপথের তুলনায় বড় হলে ইত্যাদি অনেক অনেক কারণ। ধরে নিলাম, আপনি ডাক্তার দেখিয়েছেন নিয়মিত। উনি আশ্বস্ত করেছেন, আপনার নরমাল ডেলিভারি হবে। কিন্তু এই দীর্ঘ প্রসেসের কোথাও এসে আটকে গেলে বাড়িতে বসে আপনি কি করবেন? হাসপাতাল পর্যন্ত নিয়ে আসতে আসতেই ঘটে যেতে পারে যেকোন দুর্ঘটনা। ধরে নিলাম, বাচ্চা সহজেই খুব ভালোভাবে হয়ে গেল।

ডেলিভেরির সময় ছিড়ে গেল যোনীপথ। বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখেছি, এসব ক্ষেত্রে দাইয়েরা বা বাড়ির লোকেরা বলে, ছিঁড়বেই তো! ওটাই স্বাভাবিক। ভুল। এই ধারণা পুরোপুরি ভুল। ঠিকমতো গার্ড দিতে পারলে ছিঁড়বে না। আর সামান্য ছিঁড়লেও হাসপাতালে থাকলে সাথে সাথেই তা রিপেয়ার করে আগের মতো করে দেয়া হবে। বাড়ি থেকে হাসপাতাল পর্যন্ত আসতে নির্ধারিত ছয় ঘণ্টা পার হয়ে যায় বলে অনেককেই সেই ছেঁড়া নিয়েই অপেক্ষা করতে হয় আরো তিন মাস। কারো কারো তো এতোটাই ছিঁড়ে যে যোনীপথ আর পায়ুপথ এক হয়ে যায়। তিন মাস মানবেতর জীবন যাপনের পর জটিল এক অপারেশনের মাধ্যমে তা আগের রূপে ফেরত আনতে হয় যা ব্যয়বহুল ও সময় সাপেক্ষ।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টা তা হল, হোম ডেলিভারি করাতে গিয়ে হতে পারে প্রচুর রক্তক্ষরণ যা মুহূর্তের মধ্যেই রোগীকে টেনে নিয়ে যাবে মৃত্যুর দুয়ারে। আপনার হাসপাতালে আসা তো দূরে থাক, আসার প্রস্তুতি নিতে নিতেই দুনিয়ার আলো নিভে যাবে। আপনারা জানেন কি না জানি না, প্রসব পরবর্তী রক্তক্ষরণ একজন ধাত্রীবিদের দুঃস্বপ্নের কারণ। এটা এতোটাই ভয়ানক। এমনকি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে যে ১৪ শতাংশ মা মারা যাচ্ছে, তার মূল কারণই হল, প্রসব পরবর্তী রক্তক্ষরণ। আর মোটের উপর তো ৩১ শতাংশ মা মারা যাচ্ছে এই একই কারণে। প্রসব পরবর্তী ২৪ ঘণ্টা তাই আমরা দেখছি অতি গুরুত্বপূর্ণ সময় হিসাবে।

এই যে এতোক্ষণ ধরে এত কথা বললাম, এর উদ্দেশ্য কি? মূল উদ্দেশ্যই হল, মাতৃমৃত্যু রোধ করা। নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করা। প্রতিটি মায়ের জীবন আমাদের কাছে অমূল্য। আমরা চাই না, আর একটিও শিশু মা-হারা হোক কিংবা একটিও মা শিশু হারা। আমরা চাই না, আর একটিও মা সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে প্রাণ হারাক কিংবা প্রায় প্রাণহীন জীবন যাপন করুন। তাই, নিরাপদ মাতৃত্ব দিবসে আমাদের চাওয়া আপনারা গর্ভকালীন সময়ে নিয়মিত প্রসবপূর্ব সেবা নিন, আপনার নিকটস্থ যেকোন স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে। বাড়িতে নয়, হাসপাতালে ডেলিভেরি করে নিরাপদ ডেলিভেরি নিশ্চিত করুন। সিজার সংক্রান্ত ভয় থাকলে ক্লিনিকে না গিয়ে সরকারি হাসপাতালে যান, যেখানে কেউ প্রয়োজনের বাইরে আপনার সিজার করবে না। প্রসব পরবর্তী জটিলতা এড়াতে অন্তত ২৪ ঘণ্টা ডাক্তারের অবজারভেশনে থাকুন।

আপনাদের সচেতনতাই আমাদের সাফল্যের পথ প্রশ্বস্ত করবে। একটি জন্মের প্রয়োজনে আর একটি মৃত্যুও যেন না হয়। সুস্থ থাকুন প্রতিটা মা,সুস্থ থাকবে জাতি।

লেখক:এমবিবিএস, এফসিপিএস (গাইনি), ফিগো ফেলো (ইটালি)

গাইনি কনসালটেন্ট, বগুড়া।