মোদির ফেরা

ভারতীয় মুসলমানদের মানসিক ভয়

আমিনুল ইসলাম
 | প্রকাশিত : ২৮ মে ২০১৯, ২৩:০৬

ভারতীয় মুসলমানদের রাজনৈতিক ভয় নিয়ে আলোচনায় যেটা বলার চেষ্টা করেছি সেটা হলো যে-মুসলমানদেরকে ভোটব্যাংক হিসেবে ব্যবহার করে কংগ্রেসসহ বেশকিছু রাজনৈতিক দল ফায়দা তুলেছে। কিন্তুু মুসলমানদের শিক্ষা-স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থান নিয়ে বিশেষভাবে কেউ ভাবেনি। অন্যদিকে বিজেপি করেছে মেরুকরণ। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সূচনা করে আজ মুসলমানদের ভোটটাকেই গুরুত্বহীন করে তুলেছে। এর পেছনে মুসলমানদের মানসিক ভয়টাও কিন্তুু কম নয়।

কি সেই মানসিক ভয়? ভয়টা হচ্ছে-বিজেপি ক্ষমতায় আসলেই মুসলমানদের বিপদ-এই ধারণা পোষণ করে রাখা। সেই বিপদের জুজু দেখিয়েছে কংগ্রেস। মুসলমানরাও তা মেনে নিয়েছে। অনেকটা ২৫ বছর আগে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ জুজুর সমতুল্য। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলেই ভারতের কাছে দেশ বিক্রি হয়ে যাবে। মসজিদে উলুধ্বনি শোনা যাবে। একসময় এরকম স্লোগানে ভোটের বাজার মাত করে রেখেছিল আওয়ামী বিরোধীরা। সময়ের ব্যবধানে এগুলো মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়েছে। যা হোক, বিজেপির নাম শুনলেই মুসলমানরা দশ পা পিছিয়েছে। কংগ্রেসকে সমর্থন করতে যেয়ে উন্নয়নেও পিছিয়েছে দশ পা। তার মানে ভারতীয় মুসলমানরা সবদিক দিয়ে কোনঠাসা হওয়ার পথটাকেই বেছে নিয়েছে। হোক সেটা ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায়।

এবারের নির্বাচনে মোদি জিতে যাওয়ার পর বাংলাদেশের মুসলমানদের মধ্যে সে কি হাহাকার! ভাবখানা এই-এই বোধহয় ভারতের মুসলমানরা বাংলাদেশে চলে আসবে নিরাপদ আশ্রয়ে। কেউ কি ভারতের এমন কোনো মুসলিম পরিবারের সন্ধান পেয়েছেন-যিনি মোদি জেতার পরে ভারত ত্যাগ করতে চাইছেন? ভারতের মুসলমানরা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী হতে পারে, কিন্তুু মনে রাখবেন-তারা কখনোই ভারত ত্যাগের কথা ঘৃণাক্ষরেও চিন্তা করতে পারে না।

২. এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি। ভারতের বিনোদন জগতের সবচেয়ে বড় তারকার নাম কি? আশা করি উত্তরটা সবার জানা। বলিউড বাদশাহ শাহরুখ খান কিন্তুু একজন মুসলিম। ভারত রাষ্ট্রের চরিত্রটাই এমন-যেকোনো ধর্মের লোক এখানে যেকোনো পর্যায়ে যেতে পারে। ভারতের আইটি শিল্পের জার নামে পরিচিত আজিম প্রেমজি একজন শিয়া মুসলিম। যিনি আবার ভারতের শীর্ষ ১০ জন ধনীর একজন। তার বাড়িও কিন্তুু নরেন্দ্র মোদির রাজ্য গুজরাটে।

এখন পর্যন্ত তিনজন মুসলিম ভারতের রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। মুম্বাই নগরীতে ৪০ লাখ মুসলমানের বাস। মুসলিম বিশ্বের কয়টা শহরে ৪০ লাখ মুসলমান থাকেন? দিল্লীতেও আছে প্রায় ৫০ লাখেরও কাছাকাছি মুসলমান। কলকাতা শহরেও প্রচুর মুসলমান আছেন। মুসলমানরা আছেন ভারতের প্রতিটি জনপদে, প্রতিটি মহল্লায়, প্রতিটি সেক্টরে। ভারতের মুসলমানরা ভারতেই বসবাস করতে চান। অন্য কোনো মুসলিম দেশে বসবাস করতে চান না। তাই, অন্য কোনো মুসলিম দেশের মুসলমানদের বিচলিত হওয়ার কিছু নাই। ভারতীয় মুসলমানরা ভারতীয় হয়েই বাঁচুক-আমরা কেবল এটুকুই কামনা করতে পারি।

কিন্তু ভারতীয় মুসলমানদের মানসিক ভয় তাদেরকে আজ ব্যকফুটে ফেলে দিয়েছে। মুসলমান দরদী রাজনৈতিক দলেরা বারবার মুসলমানদের বুঝিয়েছে-সাবধান, বিজেপি আসলেই তোমাদের বিপদ। আমাদেরকে ভোট দাও, আমরাই তোমাদের দেখে রাখব। এটা তো অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে-বিজেপির জন্মই হয়েছে মুসলিম বিরোধিতাকে পুঁজি করে। কিন্তুু এই মুসলিম বিরোধিতা সৃষ্টি হলো কিভাবে? মুসলমানদের ভোট পাওয়ার জন্য যখন তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির মধ্যে নির্লজ্জ প্রতিযোগিতা শুরু হয়,তখনই বিজেপি শুরু করে এই ঘৃণ্য খেলা। এই খেলায় তারা আজ সফল।

তাই এসব মানসিক ভয় দূর করে মুসলমানদেরকে ভাবতে হবে-কংগ্রেস, বিজেপি বা যেকোনো রাজনৈতিক দল তাদের আর বন্ধু নয়। মুসলমানদের বন্ধু হবে-তাদের যোগ্যতা, দক্ষতা এবং শিক্ষা। তাদের সামনে উদাহরণ হবে আজিম প্রেমজি-যিনি কারো দয়ায় নয়, নিজের যোগ্যতায় একজন মুসলমান হয়েও হিন্দুপ্রধান রাষ্ট্রের ধনকুবের হতে পেরেছেন। শাহরুখ খান সুপারস্টার হতে পেরেছেন নিজের অর্জন দিয়ে। মুসলমান হিসেবে কারও দয়া-ভিক্ষা কামনা করে নয়। মুসলমানদের ভারতের সর্বক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়তে হবে।

তাদের যোগ্যতা যাতে এমন স্তর অতিক্রম করে-যেন বিজেপিই মুসলমান ভোট পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠে। বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ মুসলমানদের উইপোকা বলে সম্বোধন করেছেন। ধিক্কার জানাই অমিত শাহের এসব মন্তব্যকে। যদিও এগুলো রাজনৈতিক স্ট্যান্টবাজি। ভারতের মধ্যে পারসিক সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত কম। কিন্তুু তারা শিক্ষায়-দীক্ষায়, শিল্পে-বাণিজ্যে এত এগিয়ে যে তাদের মন যুগিয়ে চলে সব রাজনৈতিক দলই। টাটা গোষ্ঠীর কর্ণধার কিন্তুু একজন পারসিক। ভারতে শিল্প বিপ্লবের সূচনাই করেছেন পারসিক শিল্পপতিরা। ঠিক তেমনি জৈন, শিখ সম্প্রদায়ের লোকজন অত্যন্ত প্রভাবশালী। তারা আজ সর্বভারতে সমীহ আদায় করতে পেরেছন তাদের যোগ্যতার বদৌলতে। এখন সময় এসেছে-মুসলমানদেরকেও তাদের যোগ্যতা দিয়ে ভারতীয় সমাজের মূল ¯্রােতে নেতৃত্ব দেওয়ার।

৩. এতটুকু পড়ে কেউ ভুল বুঝতে পারেন যে-বিজেপির দোষ নিয়ে কেন আলোচনা করা হলো না। এই যে গরুর মাংস রাখার অজুহাতে, গরুর মাংস রাখার গুজব ছড়িয়ে, গরু রক্ষা করতে গিয়ে নিরীহ মুসলমানদের পিটিয়ে মারা হলো-এগুলো কোন দৃষ্টিতে দেখব। এগুলো অত্যন্তু বেদনাদায়ক, লজ্জাজনক এবং কলঙ্কিত বিষয় এবং আরও দুঃখের বিষয়-প্রধানমন্ত্রী এসব ঘটনা ঘটার পরে অধিকাংশ সময় নীরব থেকেছেন। উত্তরপ্রদেশের দাদরিতে গরুর মাংস রাখার গুজব ছড়িয়ে মুহম্মদ আখলাককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় অভিযুক্তরা নির্বাচনের প্রচারাভিযানে মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের সাথেই অংশ নিয়েছেন। এতসব প্রাণহানির ঘটনায়ও বিজেপি রাজনৈতিক কারণে নীরব থেকেছে। মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকারী নাথুরাম গাডসেকে দেশপ্রেমিক বলা, বেশ কিছু লেখক ও প্রতিবাদকারীর গুপ্তহত্যা এগুলো ভারতের রাজনীতির কলঙ্কময় দিক। বিজেপির আমলে এগুলো হয়েছে। আসামে নাগরিকপঞ্জি করতে গিয়ে ৪০ লাখ লোককে পরিচয়হীন করে রাখা হয়েছে। এর জেরে আত্মহত্যা করেছেন প্রায় ৫০ জন লোক। এর পেছনে রয়েছে উপমহাদেশের বিষাক্ত সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ছোবল। মোদি এবং বিজেপি রাজনীতি করেছেন সংখ্যাগুরু হিন্দুু ভাবাবেগে ভর করে। মুসলমানরা সেখানে প্রান্তিক। ভোটের রাজনীতিতে মুসলমানদেরকে গোনায়ই ধরে না বিজেপি। মুসলমানরাও বিজেপি থেকে মুখ ফিরিয়েছে। মুসলমানদের ভোট যারা পেয়েছে তারা লোকদেখানো মুসলিম তোষন করেছে।

তাই, এখন সময় এসেছে মুসলমানরা যেন নির্দিষ্ট কারো ভোটব্যাংক হয়ে নিজেদেরকে পেছনের সারিতে আর না রাখে। ৫ বছর যাবত বিজেপি ক্ষমতায়, থাকবে আরও পাঁচ বছর। মোদি ঝড় পরের পাঁচ বছরও থাকতে পারে। মুসলমানরা আতঙ্কিত না হয়ে নিজেদের কাজটুকু করতে পারলেই হলো। আর মুসলমানদের উন্নতি হলেই তারা ভারতে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারবে। কারও ছায়ার আশ্রয় খোঁজার দরকার পড়বে না।

লেখক: কলামিস্ট।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :