যৌবন হারিয়েছে বগুড়ার বেনারশি পল্লী

এনাম আহমেদ, বগুড়া
 | প্রকাশিত : ৩১ মে ২০১৯, ১১:৩২

ভরা মৌসুমেও ব্যস্ততা নেই বগুড়ার শেরপুর উপজেলার বেনারশি পল্লীর তাঁত কারিগরদের। ইন্ডিয়ান শাড়ির দাপটে গুণগত মানের দিক থেকে উন্নত হলেও মার্কেটে দেশীয় শাড়ির চাহিদা না থাকায় এবং মহাজনদের কাছে মাল দেয়ার পর ঠিকমতো আর্থিক লেনদেন না হওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে এ পেশার সাথে জড়িত কারিগররা জীবিকার তাগিদে রিকশা অথবা অটোভ্যান গাড়ি নিয়ে রাস্তায় নেমেছেন।

বগুড়া থেকে প্রায় ২৮ কিলোমিটার দূরে শেরপুর উপজেলার শাহবন্দেগী ইউনিয়নের ঘোলাগাড়ী কলোনি গ্রামে বেনারশি পল্লী। এই পল্লীর মানুষগুলোর আদি বাড়ি ভারতের বিহার রাজ্যে। ঘোলাগাড়ী কলোনি গ্রামের স্থানীয়রা তাদের বিহারি হিসেবে জানেন।

ঘোলাগাড়ি গ্রামেই আরেক পাড়ার নাম নদীয়াপাড়া। এই পাড়ার বাসিন্দারা ভারতের নদীয়া জেলা থেকে এসে বসতি গড়ার কারণে পাড়ার নামও হয়েছে নদীয়াপাড়া। ১৯৯৫ সালে একজন ব্যক্তি ঢাকা থেকে প্রশিক্ষণ নেয়ার পর তাঁত মেশিন বসিয়ে বেনারশি শাড়ি তৈরির কাজ শুরু করেন। এরপর ধীরে ধীরে ওই গ্রামে আরো প্রায় ৭৫টি তাঁত বসানো হয়। সে সময় ছিল ওই পল্লীর মানুষদের জন্য স্বর্ণযুগ। এখন পল্লীতে কমতে থাকে তাঁত মেশিন ও কারিগরের সংখ্যা।

বেনারশি পল্লী ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ তাঁত বন্ধ হয়ে আছে। সে সময় ৭৫টি তাঁতে বেনারশি তৈরি হলেও এখন এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে পঁচিশে। চালু তাঁতগুলোতে তৈরি হচ্ছে ঈদ উপলক্ষে কাতান এবং জামদানি শাড়ি। যেগুলোর দাম ১৮০০ টাকা থেকে বিশ হাজার টাকা দামের শাড়ি তৈরি হয় বেনারশি পল্লীতে।

তাঁত মালিকরা জানান, ১৮০০ টাকা পাইকারি দামে যে শাড়ি বিক্রি করেন ঢাকায় শোরুমে ওই শাড়ি বিক্রি হয় চার হাজার টাকা। বেনারশি পল্লীতে এখন বেনারশি শাড়ি তৈরি না হলেও তৈরি হচ্ছে জামদানি, কাতান, ধুপিয়ানসহ তাঁতের তৈরি নকশা করা শাড়ি। তাও আবার খুব সীমিত। দিন দিন চাহিদা কমে যাওয়ায় শাড়ি উৎপাদন কমে যাচ্ছে। পাশাপাশি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একের পর এক তাঁত।

তাঁত কারিগর আব্দুল ওয়াহেদ ঢাকা টাইমসকে জানান, ঢাকার মিরপুরের বেনারশি পল্লীতে ১৫ বছর কাজ করার পর এই গ্রামে ১৯৯৫ সালে নিজের বাড়িতে তাঁত বসিয়ে তিনিই প্রথম বেনারশি শাড়ি তৈরির কাজ শুরু করেন। দিন দিন শাড়ির চাহিদা বাড়তে থকলে ঘোলাগাড়ি কলোনি ও নদীয়াপাড়ায় নারী-পুরুষ উভয়েই তাঁতের কাজ শুরু করেন। তাঁতের সুন্দর নকশা আর দক্ষতার সাথে পারিপাটি করে কাজ করার কারণে এলাকাবাসীর মুখে মুখে এই গ্রামটি পরিচিত হয়ে ওঠে। বেনারশি পল্লীতে তৈরি শাড়ির চাহিদা এতটাই ছিল যে, ঢাকার বিভিন্ন শাড়ির শো- রুম থেকে আগাম টাকা দিয়ে তাদের শাড়ির অর্ডার দেয়া হতো। সারাবছর চাহিদার পাশাপাশি রমজান মাসে চাহিদা ছিল সবচেয়ে বেশি। গত কয়েক বছর ধরে ভারত থেকে শাড়ি আসায় তাদের কদর কমে গেছে। তাই ভাল নেই এই শিল্পের সাথে জড়িত মানুষগুলোও। বাধ্য হয়ে তারা পেশার পরিবর্তন করছেন।

তাঁত কারিগর ও মালিক খোরশেদ আলম ঢাকা টাইমসকে জানান, তাঁতে একটা শাড়ি তৈরি করতে তাদের সময় লাগে দুই থেকে তিন দিন। আবার যেগুলোতে হাতের কাজ বেশি সেই শাড়ি তৈরি করতে একসপ্তাহ পর্যন্ত সময় লেগে যায়। তার সাতটি তাঁত আছে যেখানে ১০ জন শ্রমিক কাজ করেন। প্রতি শ্রমিককে তিনশ’ থেকে সাড়ে তিনশ’ টাকা মজুরি দিতে হয়। প্রতিদিন তারা ১০ ঘণ্টার মতো কাজ করেন। বর্তমানে তাদের দিন খুব খারাপ যাচ্ছে।

ন্ডিয়ান শাড়ির কারণে দেশীয় শাড়ির কোন চাহিদাই নেই। এখানে আগে ৭৫ থেকে ৮০টির মতো তাঁত ছিল। এখন ২৫টির মতো তাঁত আছে। কিন্তু যে অবস্থা চলছে, মনে হয়- সেগুলোও বন্ধ হয়ে যাবে।

তিনি বলেন, গত শুক্রবার তিনি ঢাকার মিরপুরে গিয়ে ২২ হাজার টাকা মূল্যের শাড়ি মহাজনের কাছে দিয়েছেন। কিন্তু তাকে নগদ দেয়া হয়েছে মাত্র ছয় হাজার টাকা। বাকি টাকা শো-রুমে রাখার পর বিক্রি হওয়ার পর দেবে এটা বলেছেন। চাহিদা নেই এবং মহাজনরাও বাকিতে মাল নিচ্ছেন, তাই দিনদিন পেশাটা টিকিয়ে রাখা তার জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :