ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশ এবং আমরা...

আরিফুর রহমান দোলন
| আপডেট : ০২ জুন ২০১৯, ১১:২৬ | প্রকাশিত : ০১ জুন ২০১৯, ১৩:৫৯

ঘটনাটি হয়তোবা খুব ছোট। কিন্তু বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে ঘটনাটি হৃদয়ে গেঁথে যাওয়ার মতো।

বৃহস্পতিবার ভারতের শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এনডিটিভি নরেন্দ্র মোদি ও তার সরকারের মন্ত্রীদের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করছিল। একজন সংবাদকর্মী হিসেবে আগ্রহ ভরেই টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রেখেছিলাম। ভারতীয় রাজনীতিতে অপাঙক্তেও হয়ে যাওয়া এক সময়ের শীর্ষস্থানীয় বিজেপি নেতা এলকে আদভানি কিংবা মুরোলি মনোহর জোশি শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে পা রাখতেই সঞ্চালক উচ্ছ্বসিত হয়ে তাদের নাম উচ্চারণ করছিলেন।

কী আশ্চর্য! ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশি রাষ্ট্র বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি সভাস্থলে আসলে সঞ্চালক উচ্চারণ করলেন, ‘হেয়ার ইজ দ্য বাংলাদেশি ডেলিগেশান’। ব্যস ওই পর্যন্তই। নির্লিপ্ত ও অগুরুত্বপূর্ণভাবে এই উচ্চারণ আমাদেরকে অবহেলারই নামান্তর। একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের রাষ্ট্রপতিকে গুরুত্বহীনভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়তো ভারতীয় গণমাধ্যমের পক্ষেই সম্ভব। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি কি শুধুমাত্রই বাংলাদেশি ডেলিগেশান! নাকি অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ কোনো পদাধিকারী?

ভারতের অধিকাংশ গণমাধ্যম সব সময় বাংলাদেশ, বাংলাদেশের অর্জন, বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বকে দায়সারা গোছের প্রচার দিয়ে থাকে। এটি যেন রীতিমতো তাদের প্রথায় পরিণত হয়েছে। বিপরীতে আমরা? প্রতাপ চন্দ্র সারেঙ্গি নামে জনৈক বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদির মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভূক্ত হয়েছেন। কট্টর হিন্দুত্ববাদী বজরং দলের একসময়ের ওড়িষা শাখার প্রধান প্রতাপ সারেঙ্গিকে নিয়ে রীতিমতো হৈ চৈ বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। প্রতাপ চন্দ্রের কুঁড়েঘরের ছবি, তার ত্যাগ তিতীক্ষার বিবরণ আরও কত কী নিয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে প্রচার এখনো শেষ হয়নি। চলছে। অথচ আওয়ামী লীগের গত মেয়াদের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী একেএম ছায়েদুল হকের জীর্ণশীর্ণ বাড়ি কিংবা তার সাদামাটা জীবন-যাপন নিয়ে আমাদের গণমাধ্যমে ইতিবাচক কোনো খবর সেই অর্থে প্রকাশ, প্রচার হয়নি। ভারতীয় গণমাধ্যম তো প্রশ্নই ওঠে না।

প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা নওগাঁর একাধিকবারের সাংসদ ইমাজউদ্দিন প্রামাণিক সরকারের গত মেয়াদে পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী ছিলেন। তাঁকে কেউ কখনো জুতা পরতে দেখেছেন? অতি সাদামাটা পোশাক পরিধান করা তার স্বভাব। ইমাজউদ্দিন প্রামাণিক কমদামি স্যান্ডেল পরেই ঢাকা, নির্বাচনী এলাকা এমনকি বিদেশ সফরও করেন। আমাদের গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় যারা তাদের নজরে এটি আসলে ভালো লাগতো।

দিনের পর দিন কারওয়ান বাজারে নিজে ব্যাগ হাতে ‘উচ্ছিষ্ট’ সবজি কেনা বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগ নেত্রী মতিয়া চৌধুরীর অভ্যাস। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি উত্তরায় ১৩০০ বর্গফুটের ছোট ফ্ল্যাটে থাকেন। আমরা এগুলো এড়িয়ে যাচ্ছি।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভালো এবং মন্দ দুটোই রয়েছে। একইভাবে ভারতের রাজনীতিতেও। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যিনি হলেন, সেই অমিত শাহ্ গুজরাটে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় প্রধান অভিযুক্ত। নানা কারণে বিতর্কিতও বটে। ভারতীয় গণমাধ্যম তার কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার পর বিষয়টি সন্তর্পণে এড়িয়ে গেছে। বরং কৌশলে প্রতাপ চন্দ্র সারেঙ্গির সা

দামাটা জীবনযাপনের খবর প্রচার করে কার্যত ভারতীয় রাজনীতিবিদদের ভাবমূর্তি ঊর্ধ্বে তুলে ধরার কৌশল নিয়েছে। বুঝে অথবা না বুঝে আমরা সেটি ক্ষেত্র বিশেষ অনুসরণ করছি। কিন্তু কেন?

বিজেপির কয়েকজন সাধারণ সম্পাদকের একজন রাম মাধব। তিনি বাংলাদেশ সফরে যতবার এসেছেন আমাদের গণমাধ্যমে সব সময় শিরোনাম হয়েছেন। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের একমাত্র সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ভারত সফরে গিয়ে সেখানকার গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছেন এর নমুনা কেউ দেখাতে পারবেন? বিজেপির কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর একজন সদস্য রাহুল সিনহা। সারাদেশে ভোটের বাজারে বিজেপির মহাজৌলুশের সময়েও যিনি পশ্চিমবঙ্গের উত্তর কলকাতা আসন থেকে পরাজিত হয়েছেন। বিজেপির কেন্দ্রীয় পর্যায়ে রাহুল সিনহার যে গুরুত্ব আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে সমপর্যায়ের গুরুত্ব সুজিত রায় নন্দী কিংবা অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেনের।

গত বছর বাংলাদেশ সফরে এসে রাহুল সিনহা আমাদের গণমাধ্যমে যে প্রচার নিতে পেরেছেন সেই স্বীকৃতি কি কোনোদিনও সুজিত রায় নন্দী, আফজাল হোসেনরা ভারতীয় গণমাধ্যমে পাবেন? পাবেন না।

আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ বা এই পর্যায়ের বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ভারত সফরে গেলে কখনো সেখানকার গণমাধ্যম বিষয়টি আমলেও নেয় না। অথচ বাংলাদেশের গণমাধ্যম ভারতের তৃতীয় শ্রেণির একজন শিল্পী ঢাকা আসলে তার ইন্টারভিউ করার জন্য হামলে পড়ে। এটি কিসের লক্ষণ?

ক্রিকেটে বিশ্বের অন্যতম সেরা অল রাউন্ডার সাকিব আল হাসানের সাক্ষাৎকার ভারতের গুরুত্বপূর্ণ কোনো গণমাধ্যমে প্রচার হয়েছে, এমন নজির কয়টা দেখানো যাবে? কিন্তু বিপরীতে আমরা? সাকিবের চেয়ে কম ট্যালেন্ট এমন ভারতীয় ক্রিকেটারদের নিয়ে আমাদের গণমাধ্যমে কত কী-না করি।

ভারতের লোকসভা নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যম টানা এক-দেড় মাস যেভাবে কাভারেজ দিয়েছে বাংলাদেশের সর্বশেষ নির্বাচন নিয়ে তার ছিটেফোঁটা উৎসাহ কি ভারতের গণমাধ্যমে ছিল? পাঠককে জানানোর সব দায় শুধু বাংলাদেশের গণমাধ্যমেরই?

সম্পাদক, দৈনিক ঢাকাটাইমস, ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকম ও সাপ্তাহিক এই সময়

সংবাদটি শেয়ার করুন

রাজপাট বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা