পর্যটকদের ডাকছে হাওর

জহির উদ্দিন বাবর
 | প্রকাশিত : ০৫ জুন ২০১৯, ১১:৫৪

দেশের সাতটি জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে হাওরের অবস্থান। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্যের আধার হাওরাঞ্চল পর্যটকদের যেন দুই হাত তুলে ডাকছে। দেশের নামকরা পর্যটনকেন্দ্রগুলোর চেয়ে হাওরের সম্ভাবনা কোনো অংশেই কম নয়। কিন্তু নানা সীমাবদ্ধতার কারণে পর্যটকদের আশানুরূপ সাড়া মিলছে না হাওরে। অথচ বিস্তীর্ণ হাওরাঞ্চল হতে পারে দেশের উল্লেখযোগ্য পর্যটন স্পট। এখান থেকে সরকার পেতে পারে বিপুল অঙ্কের রাজস্ব। পর্যটকদের আনাগোনায় পাল্টে যেতে পারে প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করা সংগ্রামী হাওরবাসীর জীবনধারা।

সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়াÑ এই সাতটি জেলার সাত লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর জলাভূমিতে ৪২৩টি হাওর নিয়ে হাওরাঞ্চল গঠিত। এর মধ্যে সুনামগঞ্জে সর্বোচ্চ ১৩৩টি, কিশোরগঞ্জে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১২২টি, নেত্রকোনায় ৮০টি, সিলেটে ৪৩টি, হবিগঞ্জে ৩৮টি, মৌলভীবাজারে ৪টি ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৩টি হাওর রয়েছে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি জেলার ৪৮টি উপজেলা নিয়ে গঠিত বিস্তীর্ণ এই হাওরাঞ্চলের আয়তন প্রায় ২৪ হাজার বর্গকিলোমিটার।

‘হাওর’ মূলত কোনো স্থায়ী জলাশয় বা জলাধার নয়। শুকনো মৌসুমে ধু-ধু প্রান্তর, বর্ষায় তা সমুদ্রসম রূপ ধারণ করে। যতদূর চোখ যায়, শুধুই অথৈ জলরাশি। যেন কূল নেই, কিনারা নেই! অনেক দূর ছোট ছোট গ্রামগুলো দাঁড়িয়ে আছে ছোট্ট দ্বীপের মতো। মনে হয় যেন হাওরের পানিতে ঢেউয়ের দোলায় ভাসছে সেসব গ্রাম। এ কারণেই বলা হয়ে থাকে, ‘বর্ষায় নাও, শুকনায় পাও, এইডাই উজান-বাডির বাও।’

হাওরের সৌন্দর্য উপভোগের রয়েছে নানা উপকরণ। এখানে পর্যটকরা নৌকায় বসে বিস্তীর্ণ নীল জলরাশির মায়ায় ডুব দিতে পারে। রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা পেতে কাটতে পারে সাঁতার। রাতের চাঁদের আলোর নিচে নৌকায় বসে স্বাদ নিতে পারে বাউল ও মরমি কবি-সাধকদের গানের। হাওরের শীতল হাওয়া ও পূর্ণিমার আলোয় রাতযাপন অনেক উপভোগ্য। বর্ষাকালে হাওরের কোলঘেঁষে থাকা সীমান্ত নদী, পাহাড়, পাহাড়ি ঝরনা, হাওর-বাঁওড়ের হিজল, করচ, নলখাগড়া বনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, নানা প্রজাতির বনজ, জলজ প্রাণী আর হাওরপারে বসবাসকারী মানুষের জীবন-জীবিকার নৈসর্গিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হওয়ার মতো খোরাক মিলবে পর্যটক ও দর্শনার্থীদের। আর হাজার হাজার দেশি-বিদেশি পাখির মিলনমেলা ও সবুজের সমারোহ শীতের মৌসুমে গড়ে ওঠা চোখজুড়ানো সৌন্দর্যে মনপ্রাণ ছুঁয়ে যাবে ভ্রমণপিপাসুদের।

হাওরের জীবন-জীবিকা আর এখানকার সহজ-সরল মানুষের জীবনাচারও পর্যটকদের আকর্ষণ করবে। হাওর ঘুরে দেখতে পারবেন এখানকার মানুষ কীভাবে জীবন-সংগ্রামে নিজেদের নিয়োজিত রেখেছে। তবে প্রকৃতি এখানে উজাড় করে সব কিছু দিলেও এর বিরূপ আচরণ হাওরবাসীর জন্য দুঃসহ যন্ত্রণার। জীবিকার একমাত্র অবলম্বন ফসলহানির ফলে হাওরবাসী দিন দিন নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। এক সময় যাদের গোলা ভরা ধান ছিল, জমি ভরা ফসল ছিল; মাছে-ভাতে বাঙালির প্রাচুর্যতার যেখানে কোনো কমতি ছিল না, সেখানে এখন কান পাতলেই শোনা যায় অনটনের আওয়াজ। এজন্য আগে হাওরের লোকেরা তেমন শহরমুখী না হলেও এখন বেশির ভাগই শহরমুখী। বিশেষ করে বর্ষার চার থেকে ছয় মাস হাওরে কোনো কাজ না থাকায় দলে দলে শহরে আসতে থাকে হাওরের কর্মোক্ষম মানুষ। এতে হাওরবাসীর জীবনে স্বচ্ছন্দ ফিরলেও হাওরের যে অনাবিল প্রাণপ্রাচুর্য তাতে যথেষ্ট ভাটা পড়েছে।

হাওরের যে বিপুল পর্যটন সম্ভাবনা জাতীয়ভাবে আমরা তা কাজে লাগাতে পারিনি। হাওরে পর্যটকের সংখ্যা খুবই কম। এর কারণ হলো পর্যটনের জন্য যেসব সুবিধা দরকার এর কিছুই নেই হাওরে। অনুন্নত যাতায়াত ব্যবস্থা ও নিরাপত্তার অভাবের কারণে পর্যটকরা সাধারণত হাওরমুখী হতে চায় না। পর্যটকদের হাওরমুখী করতে কর্তৃপক্ষেরও তেমন কোনো গরজ আছে বলে মনে হয় না। অথচ প্রতি বছর হাওরের পর্যটন খাত থেকে একটি বড় অঙ্কের রাজস্ব আদায়ের সুযোগ রয়েছে। আর এই পর্যটনকে ঘিরে হাজার হাজার লোকের কর্মসংস্থানেরও সুযোগ রয়েছে। সরকারিভাবে উদ্যোগ নিলে হাওর হতে পারে বাংলাদেশের অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট। অনেক অর্থকড়ি খরচ করে দেশ-বিদেশে ভ্রমণ করে পর্যটকরা যতটা না তৃপ্ত হন এর চেয়ে অনেক বেশি তৃপ্ত হতে পারেন হাওরে।

আজকাল হাওর অনেকটাই পাল্টে গেছে। নাগরিক জীবনের উত্তাপ হাওরেও ছড়িয়েছে। ইট-কংক্রিটের ‘আবর্জনা’ এখন হাওরকেও গ্রাস করছে অনবরত। এখন বিভিন্ন এলাকায় ছয় মাস চলাচলের উপযোগী রাস্তা থাকলেও তা ভবিষ্যতে স্থায়ী রূপ পেতে যাচ্ছে। হাওরের বুকজুড়ে নির্মাণ করা হচ্ছে অলওয়েদার সড়ক। হাওরজুড়ে রাস্তা আর ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণের যে মহাযজ্ঞ চলছে তাতে হাওরের চেহারা অনেকাংশে পাল্টে যাবে।

তবে হাওরের চেহারা পাল্টে যেতে আরও অনেক সময় লাগবে। এর আগে একবার হলেও ঘুরে আসতে পারেন হাওর। দেখে আসতে পারেন প্রকৃতি কীভাবে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছে সেখানে। দেশের অন্যান্য পর্যটন স্পটের চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম খরচে ঘুরে আসতে পারেন হাওর। অন্তত প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য যাদের মুগ্ধ করে তারা হাওরে গিয়ে ঠকবেন না।

হাওর ভ্রমণে যাবেন যেভাবে

হাওরে ভ্রমণের উপযুক্ত সময় বর্ষাকাল। সাধারণত জ্যৈষ্ঠ মাস থেকেই হাওরে পানি আসা শুরু করে। জ্যৈষ্ঠ থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত হাওর ভ্রমণের উপযোগী সময়। তবে ভরা বর্ষায় আবহাওয়া অনুকূল দেখে হাওরে যাবেন। প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে অনেক সময় ভ্রমণের আনন্দটাই মাটি হয়ে যায়। বিস্তীর্ণ জলরাশিতে বিশাল ঢেউগুলো পর্যটকদের মনে আতঙ্ক ঢুকিয়ে দিতে পারে।

হাওরে অনেক দিক থেকে প্রবেশ করা যায়। তবে কিশোরগঞ্জকে বলা হয় ‘হাওরের প্রবেশদ্বার’। ঢাকা থেকে ট্রেনে বা বাসে করে কিশোরগঞ্জের ভৈরব, বাজিতপুর, কুলিয়ারচর ও চামড়া বন্দর দিয়ে হাওরে যাওয়া যায়। প্রতিটি পয়েন্টেই রয়েছে সুন্দর সুন্দর নৌকা ও ট্রলার। এসব ট্রলারে রান্নাবান্না এবং রাতে ঘুমানোরও ব্যবস্থা রয়েছে। হাওরের হরেক রকমের সুস্বাদু মাছ দিয়ে তিন বেলা খাবারের আয়োজন এই ভ্রমণকে আনন্দময় করবে।

হাওরে ঘুরে বেড়ানোর উপযোগী বড় ট্রলারগুলোর ভাড়া নেবে প্রতিদিন ২০০০ থেকে ২৫০০ টাকা। তেল যা লাগে আপনি দেবেন। রাতে ট্রলারে ঘুমাতে না চাইলে হাওর এলাকার অষ্টগ্রাম, মিঠামইন, ইটনা, খালিয়াজুড়ি, নিকলি, মদন, মোহনগঞ্জ, আজমিরীগঞ্জ, তাহিরপুর প্রভৃতি উপজেলায় ডাকবাংলো আছে। সেগুলোতেও থাকতে পারবেন। উদার প্রকৃতিতে বেড়ে ওঠায় হাওরের মানুষ সাধারণ উদার হয়। আপনার ভ্রমণকে আরামদায়ক ও নিরাপদ করতে স্থানীয়দের কাছ থেকেও নিতে পারেন যেকোনো ধরনের সহযোগিতা।

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :