দেশের সার্বভৌমত্ব কার ও কীভাবে?

প্রকাশ | ০৫ জুন ২০১৯, ১২:০৬

যতীন সরকার

জনসংখ্যা, নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, সুগঠিত সরকার বা গভর্নমেন্ট ও সার্বভৌমত্বÑ এই চারটি অপরিহার্য উপাদান নিয়েই যে গড়ে ওঠে রাষ্ট্র, এ কথাটি তো একালের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাও জানে। প্রথম তিনটি উপাদান সম্পর্কে তেমন কোনো বিতর্ক নেই। কিন্তু রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের বিষয়টিই একান্ত বিতর্ক কুটিল। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব কার ও কেমনÑ এ নিয়ে যেমন আছে নানা প্রশ্ন, তেমনি এর সীমা-পরিসীমার ব্যাপারটিও এ যাবত প্রায় অমীমাংসিতই থেকে গেছে।

এ রকম অমীমাংসিত থাকার অনেক কারণ। রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কীয় বিভিন্ন মতবাদ থেকে যেমন সার্বভৌমত্ব নিয়ে নানান মতভিন্নতার সৃষ্টি হয়েছে, তেমনই মতভিন্নতার উদ্ভব ও বিস্তার ঘটেছে সমাজ ও রাষ্ট্রের বিবর্তন ধারার বাঁকে বাঁকে। তবে মানবসমাজ তথা রাষ্ট্রের উৎপত্তি ও ক্রমপরিণতিকে যারা শ্রেণি সংগ্রামের দর্পণে অবলোকন করেন, সেই মার্কসবাদীদের শরণ নিলেই বিষয়টির প্রকৃত তাৎপর্যের উপলব্ধি ঘটা সম্ভব বলে আমি মনে করি। ৎ

সমাজ বিবর্তনের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে মার্কসবাদীরা দেখিয়েছেন যে, আদিম সমাজ ছিল শ্রেণিহীন ও রাষ্ট্রহীন। আদিম সমাজ ভেঙে গিয়ে যখনই বা যেখানেই শ্রেণিবিভক্ত দেখা দিয়েছেÑ অর্থাৎ জনসাধারণ বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ হয়ে গেছে এবং এক শ্রেণি অন্য শ্রেণির শ্রমফল আত্মসাৎ করতে আরম্ভ করেছেÑ তখনই এবং সেখানেই জনগণকে দমন করার যন্ত্র হিসেবে ‘রাষ্ট্র’ দেখা দিয়েছে। সোজা কথায়, রাষ্ট্র হলো একশ্রেণির ওপর আরেক শ্রেণির পীড়নের যন্ত্র। সেই পীড়নের যন্ত্রটি যাদের হাতে থাকেÑ অর্থাৎ যে শ্রেণি কর্তৃত্বশীল হয়ে ওঠেÑ সেই শ্রেণিটিই হয় রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। অন্য সকল শ্রেণির মানুষই থাকে সার্বভৌমত্ব বঞ্চিত। এভাবেই দাস সমাজে দাসমালিক শ্রেণি, সামন্ততান্ত্রিক সমাজে সামন্ত শ্রেণিরই থাকে সার্বভৌমত্ব। সংখ্যালঘু কর্তৃত্বশীল শ্রেণিই বিভিন্ন প্রকার রাষ্ট্রে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী থাকে, আর বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণই থাকে সার্বভৌমত্ব বঞ্চিত।

ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থাও অবশ্যই এর ব্যতিক্রম নয়। এ ব্যবস্থাতেও রাষ্ট্রযন্ত্র দিয়ে উৎপাদনের উপাদানসমূহের মালিকানা ভোগকারী কর্তৃত্বশীল শ্রেণি কর্তৃত্বহীন সকল শ্রেণিকে দমন করে। গণতান্ত্রিক বুর্জোয়া সাধারণতন্ত্রে বিপুল সংখ্যাধিক জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল এবং এই শাসনকেই সেই সংখ্যাধিক জনগণের শাসন বলে ঘোষণাও করা হয়েছিল। আসলে কিন্তু সে-ঘোষণা ছিল নিতান্তই ফাঁকা আওয়াজ মাত্র। এ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত কোনো রাষ্ট্রেই জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়নি। অপরিমেয় ধন-প্রাণ-মানের বিনিময়ে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে যে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ঘটেছে, সে রাষ্ট্রেও প্রকৃত প্রস্তাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ সার্বভৌমত্ব বঞ্চিতই থেকে গেছে।

অথচ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংবিধানে তো ‘জনগণই রাষ্ট্রের মালিক’Ñ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এমন কথাই লিখে রাখা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে জনগণ কি রাষ্ট্রের মালিকানা তথা সার্বভৌমত্ব ভোগ করতে পারছে?

পারছে না যে, সে-বিষয়টি সকলের কাছেই দিবালোকের মতো স্পষ্ট। এটি নিজে বুঝে নেয়া বা অন্যকে বোঝানোর জন্য কোনোরূপ বাক্বিস্তারেরই প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু কেন পারছে না এবং কী করে পারবেÑ সে ব্যাপারটি এত সহজে বোধগম্য নয়। যে জনগণ রাষ্ট্রের মালিক রূপে সংবিধানে স্বীকৃত, তাদের সেই মালিকানা তথা সার্বভৌমত্ব কাদের দ্বারা কীভাবে অপহৃত হলো, সে বিষয়টি বুঝে নেয়ার জন্যই প্রয়োজন সঠিক তত্ত্ব আলোচনা, তথ্য বিশ্লেষণ ও বিজ্ঞানসম্মত যুক্তি বিচারের পথে হাঁটা।

স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের প্রায় অব্যবহিত পরেও যে সংবিধান প্রণীত হয়েছিল, সেই সংবিধান প্রণেতাদের আন্তরিকতা ছিল, শুভবুদ্ধি ছিল এবং ছিল সুগভীর প্রজ্ঞাও। তাই তারা সেই সংবিধানে জনগণকেই রাষ্ট্রের মালিক রূপে নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন এবং চারটি শক্ত স্তম্ভের ওপর দেশের জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার নিশ্চয়তা বিধান করেছিলেন। কিন্তু এই সংবিধান প্রণেতাদের আশপাশে যারা বিচরণ করছিলেন, তাদের সকলের দৃষ্টিভঙ্গি কোনোমতেই এক ও অভিন্ন ছিল না।

সংবিধান প্রণেতা ও তাদের আশপাশে বিচরণকারীদেরই নয় শুধু, অভিন্ন ছিল না স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী সকল গোষ্ঠীর চিন্তাভাবনাও। একটি গোষ্ঠী তো সংগ্রামে যোগ দিয়েছিল শোষণের অবাধ স্বাধীনতাপ্রাপ্তির লক্ষ্যেই। সে গোষ্ঠীটি ছিল খুবই প্রতাপান্বিত এবং সংগ্রামে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাদের একেবারে ভেতর মহলে এই মতলববাজ গোষ্ঠীটি শিকড় গেড়ে বসেছিল। তবে সশস্ত্র সংগ্রামের কালে সে- গোষ্ঠীর কেউই সহজে প্রতাপের প্রকাশ ঘটাতে পারেনি। কারণ তখনকার পুরো পরিস্থিতিই ছিল এ-গোষ্ঠীর জন্য একান্ত প্রতিকূল। সাম্রাজ্যবাদের সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতাই যেহেতু ছিল এ গোষ্ঠীটির শক্তির উৎস এবং যেহেতু আমাদের স্বাধীনতা-সংগ্রামটি পরিচালিত হচ্ছিল তখনকার শক্তিশালী সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী শিবিরের সক্রিয় সহায়তায়, সেহেতু সাম্রাজ্যবাদের গোঁ ধরা কোনো গোষ্ঠীর পক্ষে তখন স্পর্ধার স্পষ্ট প্রকাশ ঘটানো সম্ভব ছিল না। তাছাড়া সেই সংগ্রামের পুরোভাগে যাদের অবস্থান ছিল, তাদের অধিকাংশই এসেছিল দেশের শোষিত-নির্যাতিত মানুষদের মধ্যে থেকে। শোষণমুক্ত দেশ ও সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়েই তারা সংগ্রামে যোগ দিয়েছিল।

অর্থাৎ এতদিন ‘সবার পিছে সবার নিচে’ ছিল যারা, স্বাধীনতা সংগ্রামে তারাই অবস্থান নিয়েছিল সবার সামনে। কিন্তু সবার উপরে তাদের উঠতে দেওয়া হয়নি, নেতৃত্বের আসনটি তাদের দখলে আসেনি। স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্বেও অধিষ্ঠিত ছিল পরশ্রমভোগী মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তরাই।

সেই পরশ্রমভোগীরা যদিও ছিল সংখ্যালঘু, তবু সংখ্যাগুরু পরশ্রমজীবীরা সেই সংখ্যালঘু পরশ্রমজীবীদের ক্ষমতা থেকে নামাতে পারেনি, নিজেরা নেতৃত্ব গ্রহণ করতে পারেনি। নেতৃত্ব গ্রহণ করার যোগ্যতাই তাদের অর্জিত হয়নি। সমাজ ও রাষ্ট্র তারাইÑ যে সার্বভৌম, তারও সুষ্ঠু উপলব্ধি তাদের ছিল না। তাদের ভেতর এ রকম উপলব্ধির সঞ্চার ঘটানোর দায়িত্বও কেউ গ্রহণ করনি।

এমনকি যেসব প্রগতি চেতন ব্যক্তি ও গোষ্ঠী সশস্ত্র স্বাধীনতা-সংগ্রামে মূল নেতৃত্বের কাছাকাছি অবস্থান নিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ও গুরুত্ববহ অবদান রেখেছিলেন, তারাও গরিষ্ঠ সংখ্যক জনগণকে অধিকার সচেতন করে তুলতে পারেননি। তাই জনগণের মালিকানা ও সার্বভৌমত্বের কথাটি কেবল সংবিধানের পাতাতেই লিপিবদ্ধ থাকে, বাস্তবে সেই মালিকানা ও সার্বভৌমত্ব অপহৃত হয়ে যায়। অপহরণ করে নিয়ে যায় যারা, তারাই হয় রাষ্ট্রের শাসক, সার্বভৌম ক্ষমতারও অধিকারী হয়ে ওঠে তারাই। তাদের কুৎসিত হাতেই সংবিধানটি হয় স্তম্ভচ্যুত,Ñ গণতন্ত্র গণঅধিকার বঞ্চিত, জাতীয়তাবাদ বিকৃত, ধর্মনিরপেক্ষতা উৎপাটিত, সমাজতন্ত্র উপহসিত।

দেশটিতে এ রকম অচিন্তনীয় ও অবাঞ্চনীয় অবস্থার সূচনা ঘটে স্বাধীনতার চার বছর অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই। এর পর থেকে অবস্থার কেবল অবনতিই ঘটতে থাকে। এ রকমটি ঘটতে থাকার হেতু কেবল দৈশিক নয়, বৈশ্বিকও বটে।

বৈশ্বিক হেতুটিই বরং অধিকতর ও প্রবলতর রূপে ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে। সেই বৈশ্বিক হেতু মানে বিশ্বজুড়ে সাম্রাজ্যবাদের বিশেষ করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের গণবিরোধী কর্মকাণ্ডের ব্যাপক বিস্তৃতি। সাম্রাজ্যবাদ অনেক চেষ্টা করে যে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে পর্যুদস্তু করতে পারেনি এবং খোন্দকার মোশতাকদের মতো সাম্রাজ্যবাদের এদেশীয় বিশ্বস্ত সেবাদাসরাও যে সে-সময়ে কামিয়াব হতে পারেনিÑ একটু আগেই আমরা তার দৈশিক ও বৈশ্বিক হেতুকে চিহ্নিত করেছি। কিন্তু দুঃখ এই, অচিরেই দৈশিক ও বৈশ্বিক পরিস্থিতির ধারা প্রবাহ উল্টোমুখী হয়ে যেতে থাকে। স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বকারী দল আওয়ামী লীগ যখন স্বাধীন দেশ রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলো, তখন সে দলটির কাছে মানুষের প্রত্যাশা ছিল অনেক।

অথচ প্রত্যাশার তুলনায় প্রাপ্তি ছিল খুবই নগণ্য। বরং সে সময়ে নানা অবাঞ্ছিত ঘটনা পরস্পরা জনগণের ভেতর অনেক ক্ষোভ ও হতাশার জন্ম দিতে থাকে। এরই সুযোগ গ্রহণ করে সাম্রাজ্যবাদের এ দেশীয় দোসরসহ বিভিন্ন মতলববাজ গোষ্ঠী। এদের সক্রিয় সহযোগী রূপেই সাম্রাজ্যবাদ এদেশটিতে অনুপ্রবেশের মওকা পেয়ে যায়। তারই অনিবার্য ফল স্বাধীন রাষ্ট্রের মহান স্থপতির সপরিবারে নিহত হওয়া এবং স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বিরোধিতাকারীদের ক্ষমতার মঞ্চে আরোহণ করে মুক্তিযুদ্ধের অমৃত ফল অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া।

বৈশ্বিক পরিস্থিতি সাম্রাজ্যবাদের অনুকূলে যেতে থাকে বিগত শতকের সত্তর দশকের মাঝামাঝি থেকেই। চীন-সোভিয়েত বিভেদ ও বিরোধ তো তুঙ্গে পৌঁছে গেছে এর অনেক আগেই। আর তারই পাশাপাশি সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক শিবিরের অভ্যন্তরেও যে অবক্ষয়ের কীট বাসা বেঁধে চলছিল, তারই সুস্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ ঘটে বিংশ শতাব্দী শেষ দশকে পৌঁছার আগেই।

সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙন ও সমাজতান্ত্রিক শিবিরের অবলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গেই বিশ্বের একক পরাশক্তি রূপে স্পর্ধিত আত্মঘোষণা না দিয়ে মঞ্চাবতরণ করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। সে সময়ে সাম্রাজ্যবাদ বিশ্বজুড়ে নতুন করে তার প্রভুত্ব বিস্তারের যে আয়োজন করে সে বিষয়টি কিউবার বিপ্লবী নায়ক ফিডেল ক্যাস্ট্রোর নির্মোহ পর্যবেক্ষণ ধরা পড়েছিল এভাবেÑ

‘সাম্রাজ্যবাদ ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে তার উদ্বৃত্ত পুঁজির বেনিফিসিয়ারি হয়ে নিজেদের পুঁজি গড়ে তুলতে এবং তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে লুণ্ঠনের প্রক্রিয়ায় শরিক হতে।’

তৃতীয় বিশ্বের অন্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশও সাম্রাজ্যবাদ নির্দেশিত লুণ্ঠন-প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েছে।

সাম্রাজ্যবাদের প্রবর্তনাতেই এ দেশে লুণ্ঠনবাজ বা লুটপাটতন্ত্রীরাই অনেক ক্ষমতার অধিকারী হয়ে বসেছে, সংবিধান ঘোষিত ‘জনগণের মালিকানা’ কথাটি লজ্জায় মুখ লুকোতে বাধ্য হয়েছে। দেশে ‘মূলধারার রাজনৈতিক দল’ বলে যাদের পরিচয় প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে (অর্থাৎ যে দলগুলোই এতদিন ধরে পরপর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকছে) তাদের সকলেই ব্যতিক্রমহীনভাবে আজ সাম্রাজ্যবাদের প্রসাদভোগী বা প্রসাদপ্রত্যাশী।

বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সেনা ছাউনিতে জন্ম নেওয়া রাজনৈতিক দল বা তাদের সহযোগীদের সাম্রাজ্যবাদের আশীর্বাদ নিয়েই রাষ্ট্রক্ষমতায় বসে থাকতে চাওয়ার মধ্যে বিস্ময়ের কিছু নেই। অথচ বিস্ময়বিমূঢ় ও বেদনাহত হয়ে যাই আমাদের নিজেদের দিকে তাকিয়ে। আমরা যারা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বকে অঙ্গীকার করে নিয়ে স্বাধীনতার জন্য মরণপণ যুদ্ধ করেছিলাম, যে যুদ্ধে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদই আমাদের প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, যুদ্ধোত্তর স্বাধীন দেশেও আমাদের সেই সাম্রাজ্যবাদের হুমকির মোকাবেলা করে চলতে হয়েছিল, আজকে সেই আমরাই কী করে সাম্রাজ্যবাদের কাছে নীরবে আত্মসমর্পণ করে বসলাম?

এই প্রশ্নটির জবাবের মধ্যেই নিহিত আছে স্বাধীন দেশের ‘জনগণের মালিকানা’ তথা সার্বভৌমত্ব হারানোর হেতু। অর্থাৎ বৈদেশিক শক্তি তথা সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে দৈশিক শক্তির অন্তর্ভুক্ত লুটপাটতন্ত্রীদের অশুভ সম্মিলনই জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার পথে প্রচণ্ড বাধার সৃষ্টি করে রেখেছে। অথচ এই একান্ত নির্ভেজাল সত্যটিকে আমরা বুঝেও বুঝতে চাই না, চরম আত্ম প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে বিবেককে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে চাই। তবে মনে রাখা উচিত, কেবল ঘটমান বর্তমান কালেই আমরা এ রকম অবাঞ্ছিত ও আত্মঘাতী অবস্থান গ্রহণ করিনি। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের নানা অশুভ তৎপরতার বিরুদ্ধে সংগ্রামরত ছিলাম যখন, তখনো আমরা এমনটিই করেছি।

এখনো তথাকথিত ‘ভদ্রলোক’ গোষ্ঠীই নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার লক্ষ্যে সংগ্রামকে নিয়ন্ত্রণ করেছে, ‘ছোটলোক’দের অধিকার প্রতিষ্ঠার সব পথ বন্ধ করে রেখেছে। অর্থাৎ সে সময়েও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামে রত ভদ্রলোক নেতারা এখনকার মতোই সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রজাকুলকে সার্বভৌমত্ব-বঞ্চিত রাখার ব্যাপারে ছিল সাম্রাজ্যবাদের নিষ্ঠাবান সহযোগী। তীক্ষè দৃষ্টিতে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করে সেই ১৯১৪ সালেই রবীন্দ্রনাথ তার ‘লোকহিত’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন,Ñ

“আমাদের ভদ্রসমাজ আরামে আছে,

কেননা আমাদের লোকসাধারণ নিজেকে বোঝে নাই।

এই জন্যই জমিদার তাহাদিগকে মারিতেছে, মহাজন

তাহাদিগকে ধরিতেছে, মনিব তাহাদিগকে গালি দিতেছে,

পুলিশ তাহাদিগকে শুষিতেছে, গুরুঠাকুর তাহাদের

মাথায় হাত বুলাইতেছে, মোক্তার তাহাদের গাঁট

কাটিতেছে, আর তাহার কেবল সেই অদৃষ্টের নামে

নালিশ করিতেছে যাহার নামে সমন জারি করিবার

জো নাই। আমরা বড়জোর ধর্মের দোহাই

দিয়া জমিদারকে বলি ‘তোমরা কর্তব্য করো’ মহাজনকে

বলি ‘তোমার সুদ কমাও, পুলিশকে বলি ‘তুমি অন্যায়

করিও না’,Ñ এমন করিয়া নিতান্ত দুর্বলভাবে কতদিন

কতদিক ঠেকাইব। ...তাহাতে কোনো এক সময়ে

এক মুহূর্তের কাজ চলে, কিন্তু চিরকালের এ ব্যবস্থা নয়।

সমাজে দয়ার চেয়ে দায়ের জোর বেশি।’’

ঐ প্রবন্ধেই সংখ্যাগরিষ্ঠ ‘লোকসাধারণের’ প্রতি ‘ভদ্র সম্প্রদায়ের’ আচরণ সম্পর্কে আরো স্পষ্টভাষায় তিনি লিখেন,Ñ

“লোকসাধারণকে] সর্বপ্রকারে

অপমানিত করা আমাদের চিরদিনের অভ্যাস। যদি নিজেদের হৃদয়ের দিকে তাকাই তবে একথা স্বীকার করিতে হইবে যে, ভারতবর্ষকে আমরা ভদ্রলোকের ভারতবর্ষ বলিয়াই জানি।”

রবীন্দ্রনাথ যখন এসব কথা লিখেছিলেন, তার তেত্রিশ বছর পরে শাসক ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা শাসিত ভারতবর্ষের ভদ্র সম্প্রদায়ের সঙ্গে বোঝাপড়া করে ‘ভারত’ ও ‘পাকিস্তান’ নাম দিয়ে দেশটিকে দুভাগ করে দিয়ে তাদের প্রত্যক্ষ শাসনের অবসান ঘটিয়ে চলে যায়। এর প্রায় সিকি শতাব্দী পরে পাকিস্তানের পূর্ব অংশ ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নামে স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে আত্মপ্রকাশ করে। আমাদের সেই স্বাধীন দেশটির কথাই তো এতক্ষণ ধরে বয়ান করছিলাম।

আর বেশি ধানাই পানাই না করে সোজাসুজিই এখন বলে ফেলতে পারি। ১৯১৪ সালে রবীন্দ্রনাথ সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ শাসনাধীন ভারতবর্ষকে যেমন ‘ভদ্রলোকের বাংলাদেশ’ বলেই জানি। সংখ্যালঘু ভদ্রলোকদের অধীন হয়েই কালযাপন করতে হচ্ছে সংখ্যাগুরু প্রাকৃতজন বা ‘লোক সাধারণকে’। সংবিধান-ঘোষিত ‘রাষ্ট্রের মালিকানা’ তথা সার্বভৌমত্ব তাদের ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেছে।

তাই বলে ভদ্রলোকেরাই কি রাষ্ট্রটির মালিকানার নাগাল পেয়ে গেছে? তারাও কি স্বাধীন? তারাই কি দেশটির আসল শাসক?

উত্তরে বলা যায়, আপাতদৃষ্টিতে যাদেরকে এদেশের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত বলে মনে হয়, প্রকৃত প্রস্তাবে তারাও আজ নয়া সাম্রাজ্যবাদের অদৃশ্য সুতার বাঁধনে বাঁধা। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দৃশ্যমান শাসনের অবসানের পর পাকিস্তানের কাঁধে ভর করে থাকা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অদৃশ্য শাসনের হাত থেকে স্বাধীন বাংলাদেশও আমরা মুক্ত হতে পারিনি। আমাদের মুক্তি সংগ্রামই আজও অসমাপ্ত রয়ে গেছেÑ এমন কথা আমরা অনেকেই বলি বটে, কিন্তু কথাটির তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পেরেছি বলে মনে হয় না। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামে না নেমে এবং সে সংগ্রামে বিজয়ী না হয়ে মুক্তি সংগ্রামের সমাপ্তি কিছুতেই ঘটবে না, ভদ্র অভদ্র নির্বিশেষে দেশের কোনো মানুষেরই সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে না।