স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আপনাকে বলছি

আরিফুর রহমান দোলন
| আপডেট : ০৯ জুন ২০১৯, ১৩:৪৫ | প্রকাশিত : ০৭ জুন ২০১৯, ১৪:২৯

বিষয়টি সীমাহীন লজ্জার। একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য চরম অপমানের। দুঃখের। রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থার পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা সংকট যে কতটা প্রকট, তার আর একটি নজির বটে। বাংলাদেশ বিমানের ক্যাপ্টেন ফজল মাহমুদ পাসপোর্ট ছাড়া কাতার বিমানবন্দরে পুলিশের হাতে আটক হয়েছেন। তিনি কিনা আবার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে বিমানে করে দেশে ফিরবেন তার চালক ছিলেন। বিস্ময়কর! হতবাক হয়ে যাই। এটি কীভাবে সম্ভব? কাতারের কাছেই কি শুধু ছোট হয়ে গেলাম আমরা? নাকি গোটা বিশ্বেই খবর হয়ে গেলো আমাদের ব্যবস্থাপনা সংকট কতটা প্রকট?

বরাবরের মতো এবারও দায়সারাভাবে বিষয়টি সামাল দেয়া হবে? আলামত তা-ই বলছে। প্রধানমন্ত্রীর ফ্লাইট থেকে ক্যাপ্টেন ফজল মাহমুদকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। তাকে কাতার পুলিশের কাছ থেকে দেশে আনার উদ্যোগের কথা বলেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

বেসামরিক বিমান ও পর্যটন সচিব মুহিবুল হক গণমাধ্যমকে বলেছেন, এটি ক্যাপ্টেনের ব্যক্তিগত গাফিলতি। আর আমাদের সদালাপী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, বিষয়টি নিয়ে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তদন্ত করছে। তদন্তের পর নাকি বোঝা যাবে কেন পাসপোর্ট ছাড়া পাইলট কাতারে গিয়েছিলেন। তদন্তের পর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

সদাশয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে প্রশ্নটা এখানেই। চাইলেই বাংলাদেশের বিমানবন্দর যেকোনো নাগরিক পার হতে পারেন? ইমিগ্রেশন পার না হয়ে কি চাইলেই বিমানে ওঠা সম্ভব? আমাদের অভিজ্ঞতা কী বলে: সাধারণভাবে একজন নাগরিক বিমানবন্দর হয়ে বিদেশ যেতে গেলে তাকে পাসপোর্ট প্রদর্শন করতে হয় ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষকে। যথাযথভাবে ভিসা আছে কি না পরীক্ষা করে উড়োজাহাজের বোডিং কার্ড দেখে তারপর ‘Exit’ সিল দেওয়া হয় পাসপোর্টে। যথাযথভাবে পাসপোর্টে ‘Exit’ সিল দেওয়া হলো কি না সেটি দ্বিতীয়বার পরীক্ষা করে ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের একজন কর্মী, যিনি সাধারণ পুলিশের কনস্টেবল।

দেশের সর্বোচ্চ নির্বাহী মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বহন করে আনবেন যে পাইলট তার ক্ষেত্রে কি নিয়ম-কানুনের কোনো বালাই থাকবে না? থাকবে না কোনো সতর্কতা? কোনো শৃঙ্খলা? আমার খুব জানতে ইচ্ছা করছে, কীভাবে পাইলট ফজল মাহমুদ বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন পার হলেন। বাংলাদেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবেই এটি জানার অধিকার আমার যে, ‘আমি প্রধানমন্ত্রীর পাইলট’ এই পরিচয় দিলেই কি ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের কাজ শেষ? না-কি আরও বাড়তি সতর্কতার প্রয়োজন ছিল?

অবাক হচ্ছি এই ভেবে যে আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের গাফিলতি, ভুলকে পুরোপুরিভাবে উপেক্ষা করে গেলেন। ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে হওয়ায় এই এড়িয়ে যাওয়া কি না জানি না। কিন্তু দায় তো কারো না কারো নিতেই হবে। এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ আছে কি? বাংলাদেশ পুলিশের ‘বিশেষ শাখা’ এসবিই মূলত ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ, যা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন। পাসপোর্ট ছাড়া কাতার চলে যাওয়া বাংলাদেশ বিমানের পাইলট ফজল মাহমুদের গাফিলতির চেয়ে আমাদের ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের গাফিলতি কি কোনো অংশে কম? বরং অনেক বেশি। দায়িত্বে অবহেলার জন্য শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনের দায়িত্বপ্রাপ্তদের কি কোনো শাস্তি হবে না? এই প্রশ্ন তো মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হিসেবে আসাদুজ্জামান খান কামালকেই করব। আদৌ কোনো উত্তর পাওয়া যাবে কি না জানি না।

কিছুদিন আগে কয়েকজন রোহিঙ্গা বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে বিমানবন্দর অতিক্রম করার চেষ্টা করেছিলেন। তাদের জিজ্ঞাসাবাদকালেই নাকি জানা যায় ইতিমধ্যে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়াসহ আরো কিছু দেশে চলে গেছে।

প্রশ্ন রোহিঙ্গারা বাংলাদেশি পাসপোর্ট পেল কী করে? পাসপোর্ট বহির্গমন অধিদপ্তর কোন মন্ত্রণালয়ের অধীনে? আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিঃসন্দেহে একজন ভদ্র, সদালাপী ও অমায়িক রাজনীতিক। কিন্তু তাঁর দপ্তরের অধীন বিভিন্ন সংস্থাগুলো আসলে কেমন চলছে? একটি ঘটনার পরই তো সার্বিক বিশ্লেষণের প্রয়োজন হয়। পুলিশের কনস্টেবল থেকে অন্য নিয়োগগুলোতে যে অনিয়মের খবর নানাভাব আলোচনায় নিয়ে আসা হয়, তার কারণ রাজনৈতিক প্রভাব। এই প্রচার ভেতরে ভেতরে করেন পুলিশেরই কেউ কেউ। কিন্তু বিভিন্ন জেলায় পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগের সময় বিষয়টি খুব ভালোভাবে জানা-বোঝার সুযোগ অনেকের হয় যে, এই নিয়োগগুলোতে সংশ্লিষ্ট জেলার পুলিশ সুপারের প্রভাব কতখানি। এই নিয়োগগুলোতে একটি অভিন্ন নিয়ম ও নীতিমালা করে পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগকেই কার্যত বিতর্কহীন করার উদ্যোগ কি আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিতে পারতেন না?

এমন অনেক প্রশ্ন তাঁর কাছে করতে এখন ইচ্ছে করছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিশ্চয়ই জানেন তাঁর দপ্তরের অধীনে বিস্ফোরক অধিদপ্তরের কাজ এবং রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনিয়মের বিষয়ে। আমার জানামতে, বিস্ফোরক অধিদপ্তর কাজের চেয়ে অকাজ করছে বেশি এবং সীমাহীন অনিয়ম সেখানে। দেশের যুবসমাজের একটা অংশ আজ মাদকের ছোবলে ঝিমোচ্ছে রীতিমতো। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর কোন মন্ত্রণালয়ের অধীন? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। নির্জীব, নির্বিকার, আধা সক্রিয় মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরকে আমরা কবে অধিকতর ও কার‌্যকরভাবে সক্রিয় হয়ে উঠতে দেখব? এই প্রশ্ন করা কি অন্যায় হবে? আর মন্ত্রণালয়ের প্রধান হিসেবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকেই তো এই প্রশ্নের জবাব দিতে হবে।

কথায় কথায় ভারতকে উদাহরণ হিসেবে টানা এখন আমাদের সংস্কৃতিই হয়ে গেছে। কেউই তার ঊর্ধ্বে নই আমরা। তাই এসব ক্ষেত্রে ভারতের দু-একটি উদাহরণ টানাই শ্রেয় মনে করছি। নরেন্দ্র মোদি প্রথমবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর একটি ট্রেন দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে কিছু বিতর্ক সৃষ্টির সাথে সাথেই সরিয়ে দেওয়া হয় রেলমন্ত্রী সুরেশ প্রভুকে। নরসিংহ রাও যখন প্রধানমন্ত্রী তখন একটি বিমান দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে গুরুত্বপূর্ণ কংগ্রেস নেতা ও বিমানমন্ত্রী মাধব রাও সিন্ধিয়া মন্ত্রিসভা থেকে সরে দাঁড়ান। এমন অনেক উদাহরণ আছে।

আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ক্ষেত্রে কোনোভাবেই সেটি হোক চাইছি না বা বলছি না। শুধু বলতে চাইছি, তিনি দায়িত্ব নিন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বহন করে আনবেন যে পাইলট তার ইমিগ্রেশন পার হওয়ার ক্ষেত্রে ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ যে সীমাহীন গাফিলতি দেখিয়েছে, তা মুখেও আনছেন না কেন প্রিয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। আপনি প্রকৃত একজন প্রশাসক হয়ে উঠুন। রাগ-অনুরাগের বশবর্তী না হয়ে আপনার দক্ষতা প্রয়োগ করুন।

আপনি নরম মনের, আপনি ঠান্ডা একজন মানুষ- এই সুনাম আপনার আছে। পাশাপাশি দেশের একজন নাগরিক হিসেবে এই সুনামও আপনার আমরা দেখতে চাই- আপনি একজন ভালো প্রশাসকও। দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভালো প্রশাসক মানে তো আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরো ভালো। এই তৃপ্তিতে থাকা সেটিই আমরা চাই। আপনাকে বলছি, মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব আপনার কাঁধে, আরও আরও কঠোর হোন।

লেখক: সম্পাদক, দৈনিক ঢাকা টাইমস, ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকম ও সাপ্তাহিক এই সময়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

রাজপাট বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা