ঢাকা টু লন্ডন: হরেক রকম বিস্ময়

দেলোয়ার হোসেন, লন্ডন থেকে
| আপডেট : ০৮ জুন ২০১৯, ১৫:৪০ | প্রকাশিত : ০৮ জুন ২০১৯, ০৮:৩৮

তাপমাত্রা মাইনাস ৫০। বাতাসের গতি ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার। ভৃপৃষ্ট থেকে প্রায় ৩০ হাজার ফুট উপর দিয়ে ঘণ্টায় ৯৫০ কিলোমিটার গতিতে ছুটে চলেছে বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বিজি ওয়ান ফ্লাইটের দৈত্যাকৃতির বিমানটি। হাজার হাজার টন এই দুর্ধর্ষ বিস্ময়কর দানব যানটির কাছে একেবারেই নস্যি।

আল্লাহ তায়ালার সবচেয়ে আশ্চর্য, সেরা ও বিস্ময়কর সৃষ্টি হলো মানুষ। এই মানুষের মধ্যে আবার কত পার্থক্য দেখুন। আমার মতো সাধারণ মস্তিস্কের মানুষের কাছে যেগুলো রহস্য, অলৌকিক, অসম্ভব মনে হয়, কিছু বিস্ময়কর মানুষের কাছে আবার সেগুলো সরল, বাস্তব, যৌক্তিক এবং স্বাভাবিক। এই বিস্ময়কর মানুষগুলোর কাছে মানবজাতির কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।

ঢাকা টু লন্ডন। ১২ ঘণ্টার বিরস বিমান ভ্রমণ। রানওয়ে থেকে বিমান ওঠা বা নামার সময়টুকু ছাড়া বিমানভ্রমণ তো বিরসই। বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গ পেরিয়ে বিমান ছুটে চলেছে সুবিশাল ভারতের উপর দিয়ে। তার কিছুক্ষণ আগে আমরা পেরিয়ে এসেছি বিস্ময়কর এক দেশ ও আশ্চর্য নগরী। বাংলাদেশ ও ঢাকা। ৫৫ হাজার বর্গমাইলে ২০ কোটি মানুষ। এখানে শুধু মানুষের বাম্পার ফলন নয়, বাম্পার ফলন খাদ্যশষ্য-ফলমূলের। বাগানে বাগানে এখন নানা রং ও স্বাদের রসালো ফলের সমাহার। লিচু, আম, কাঁঠাল, তাল, জাম, তরমুজে সয়লাব বাংলাদেশের হাটবাজার।

সোনার বাংলা বটে! তবে ‘কিছু মানুষ’ ও অতি মানুষের কারণে এই সোনার বাংলা আজ হুমকির মুখে। জনসংখ্যা দেশের জন্য সম্পদ। কিন্তু তারও তো একটা সীমা পরিসীমা আছে! অত্যধিক জনসংখ্যার চাপ পড়েছে সম্পদের ওপর। সেই চাপে হিমশিম থাচ্ছে বাংলাদেশ। ঢাকা সিটিতেই ৩ কোটি মানুষ। রাজধানীর রাস্তায় যেন তিল ধারণের জায়গা নেই। ফুটপাতে পা ফেলার উপায় নেই। আর আইন কানুন, নিয়মনীতি? আইনের শাসনের দিক দিয়েও বাংলাদেশ বিস্ময়! ভালো কাজের জন্য পুরস্কারের বদলে জারি হয় বদলির আদেশ! ক্ষমতাধররা গাড়ি হাঁকান উল্টো পথে।

আমার ভারতীয় বন্ধু মনিষ কাম্বলের কাছে বাংলাদেশ ও ঢাকা বিস্ময়ের অপর নাম। ‘এত অল্প জায়গায় এত মানুষ, কীভাবে সম্ভব?’ বাংলাদেশ নিয়ে মুম্বাই বিশ্ববিদালয়ের এ প্রফেসরের যেন বিস্ময়ই কাটে না! জানিয়েছেন, ভবিষ্যতে বাংলাদেশ নিয়ে নাকি তার গবেষণা করার ইচ্ছা আছে। মনিষের সঙ্গে আমার পরিচয় গত বছর মার্চে। ভারত, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কাকে নিয়ে ত্রিদেশীয় সিরিজ দেখতে সস্ত্রীক কলম্বোতে গিয়েছিলেন। বউ ব্যাংকের জিএম পদমর্যাদার কর্মকর্তা। বাচ্চা কাচ্চা নেই। প্রাণবন্ত জুটি। ছুটি পেলেই একসঙ্গে বেরিয়ে পড়েন ঘুরতে।

মনিষ দম্পতির কাছে বাংলাদেশ যেমন বিস্ময়কর, বিস্ময়কর বাংলাদেশ ক্রিকেট দলও। সীমিত ওভার ম্যাচে বাংলাদেশ যেভাবে খেলছে তাতে তারা অভিভূত। আমার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর বাংলাদেশ দল নিয়ে নাকি আগের চেয়ে বেশি কৌতূহলি তারা। বাংলাদেশ জিতলে আমাকে অভিনন্দন জানাতে ভুল করেন না সাদা মনের মিস্টার ও মিসেস কাম্বল।

আমার কাছে মনিষের ভারতও এক বিস্ময়। বহুবার ভারত ভ্রমণ করেছি। আসূমদ্রহিমাচল কত যে রং রূপ। নানা ধর্ম, বর্ণ, ভাষার ১২০ কোটি মানুষ। মরুভূমি থেকে হিমশীতল বরফ- হাজারো বৈচিত্রের দেশে কি নেই! একজন পর্যটনের জন্য ভারত বড়ই আকর্ষণীয় স্থান। তবে সেই ভারত ক্রমশ অন্য ভারত হয়ে ওঠছে। একজন মুসলিম নামাজী পর্যটকের জন্য ভারত এখন কতটা নিরাপদ এই প্রশ্ন আমার মনে। সাম্প্রদায়িক ও উগ্রবাদের জয়জয়াকারে ভয়ার্ত এবং সন্ত্রস্ত ভারতের কোটি কোটি সংখ্যালঘু। অবশ্য ভারতে উদার, ভালো মানুষেরও অভাব নেই। কিন্তু সেই উদার মানুষের সংখ্যা দিন দিন কমতে শুরু করছে দেখছি।

আফগানিস্তান। আমার কাছে আরেক বিস্ময়। বিমান ছুটছে, নিচে জনমানবহীন শুভ্র পাহাড়ের সারি। কঠিন উপত্যকা। কি কঠিন ভূমিরুপ! পরিস্থিতি, পরিবেশ মানুষকে কঠিন, যোদ্ধা ও সংগ্রামী করে তোলে। আফগানদের বেলায়ও হয়েছে তাই। নিরন্তর তাদের টিকে থাকতে হয় কঠিন সংগ্রামের মাধ্যমে। এ কারণেই জন্ম থেকে তারা যোদ্ধা, সংগ্রামী। আফগান ক্রিকেট দলের শুভাকাঙক্ষী আমি। পাকিস্তানের উদ্বাস্ত শিবিরে টেপ টেনিস বলে ক্রিকেট খেলতে খেলতে তারা আজ ক্রিকেটের নয়া বিস্ময়। চেষ্টা আর ইচ্ছাশক্তির কাছে কোনো বাধাই অতিক্রম্য নয়, অদম্য রশিদ খানরা সেটা প্রমাণ করেছেন।

মধ্য এশিয়ার দুর্গম অঞ্চল পেরিয়ে পূর্ব ইউরোপ হয়ে বিমান ছুটছে লন্ডনের দিকে। ইউরোপকে দেখে ঈর্ষা হয়। আল্লাহ দুইহাত ভরে দিয়েছেন। যে দিক তাকাবেন শুধু সবুজ। পুরো ইউরোপ যেন অভিন্ন দৃশ্য, পটে আঁকা একটি সবুজ ছবি।

আমার আপাতত গন্তব্য লন্ডন। এক সময়ের বিশ্বের এক নম্বর নগরী ও বিশ্ব রাজধানী। কালের পরিক্রমায় ব্রিটেন তার গৌরবময় অতীত হারিয়েছে। বিশ্বজোড়া ব্রিটিশদের দুর্দান্ত প্রতাপ ভেসে গেছে আটলান্টিকের জলে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য এখন ইতিহাসের পাতায়। বাতাস বইছে নিউইয়র্কের দিকে। সারা দুনিয়ার চোখ আর গন্তব্য এখন আমেরিকা ও নিউইয়র্ক।

ব্রিটেনের কষ্ট হয়। বলা হতো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যায় না। সেই ব্রিটেন এখন ছোট একটি দেশ। অদূর ভবিষ্যতে স্কটল্যান্ড আলাদা হয়ে যাবে, এটা নিশ্চিত। ওয়েলশও স্কটল্যান্ডের পথে হাটতে চাইছে। এই দুইটা রাজ্য যদি স্বাধীন হয়ে যায় তাহলে কি হবে ব্রিটেনের? ইংল্যান্ড ও ছোট নর্দান আয়ারল্যান্ডকে নিয়ে গ্রেট ব্রিটেন নামটাকি তখন মানানসই হবে?

তবে ছোট দেশ হয়েও সারা দুনিয়ায় ব্রিটেনের এখনও যা প্রভাব প্রতিপত্তি সেটাও কম বিস্ময়কর নয়। আর লন্ডন তো লন্ডনই। আটলান্টিকের পাড়ে টেমস নদীর তীরে লন্ডন দাঁড়িয়ে আছে স্বমহিমায়। অন্যরকম ঐতিহ্য, আভিজাত্য আর গৌরব নিয়ে। যেখানে নিউইয়র্ক, প্যারিস, টোকিও অনেক পিছিয়ে। গুড আফটারনুন, লন্ডন।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :