বৃত্তের বাইরে

প্রকাশ | ০৮ জুন ২০১৯, ১০:১১

আলম রায়হান

লোকটা ধীরলয়ে হাঁটে। কেবলই হাঁটে। কিন্তু কেন হাঁটে? এত দিনকার সংসারের বাইরে এসে কেন তার এই পথচলা। সে কি রবীন্দ্রনাথের খাঁচার পাখির বিবেচনাকে তুচ্ছজ্ঞান করেছে! খাঁচার পাখি বুঝে ছিল, উড়াল দেয়ার শক্তি তার নেই। যে কারণে খাঁচার বাইরে বের হয়নি। আবার এমনও হতে পারে, খাঁচার বাইরে অনিশ্চিত জীবনে না নামার ক্ষেত্রে এটি ছিল তার বাহানা। হয়তো অলস আরামে খুবই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল পাখিটি। এজন্য খাঁচার বাইরে আসতে চায়নি। আবার সঙ্গীও চাচ্ছিল। একই অবস্থা হয়তো ছিল বনের পাখিরও। এ হচ্ছে প্রাণিকুলের প্রবণতা। একটির পর একটি চাইবে। একই সময় অনেকগুলো চাইবে। কিন্তু কোনোটিই ছাড়তে চাইবে না। কেবল প্রাপ্তির বাসনা! এ প্রবণতায়ই দুই ভুবনের দুই পাখি নিজের অবস্থানে একে অপরকে চেয়েছে। কিন্তু কেউ নিজের অবস্থান ত্যাগ করেনি।

তাহলে প্রাণিকুলের প্রবণতা ত্যাগ করে নিরন্তর হাঁটতে থাকা এই লোকটা সংসার খাঁচার বাইরে পা বাড়াল কেন? হয়তো পাখি যা বোঝে অনেক সময় মানুষ তা বোঝে না! হতে পারে। আর এটি তো প্রমাণিত সত্য, জাহাজডুবির বিষয়টি সবার আগে টের পায় ইঁদুর। ইঁদুর এতই জ্ঞানী। একসময় জাহাজ থেকে ইঁদুর লাফিয়ে পড়ার ধরন দেখে বোঝা যায়, জাহাজ ডুবছে! কিন্তু রাস্তার এই লোকটা প্রচলিত ধারণার বাইরে এসে রাস্তায় হাঁটা শুরু করল কেন! সে কি ইঁদুরের মতো জ্ঞানী। যে কারণে সে জীবন নামক জাহাজ থেকে লাফিয়ে পড়েছে। নাকি কোনো কিছু না ভেবেই লোকটা রাস্তায় নেমেছে। কিন্তু না ভাবার তো কথা নয়। নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থা হাজির হওয়ার আগে মানুষ অনেক কিছু ভাবে, সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। পাড়া-প্রতিবেশী, নিকটজন-দুর্জন, স্বজন-কুজন, চাকর-বাকর-কর্মচারী, অধস্তন। সবাকেই নিয়ন্ত্রণ করতে চায় মানুষ। এমনকি মানুষ উপরস্থ ব্যক্তিকেও নিয়ন্ত্রণ করতে চায় মওকা পেলে। আর এই নিয়ন্ত্রণ প্রবণতা আক্রান্ত মানবজাতি পরিবারের সদস্যদের নিয়ন্ত্রণে সব সীমা ছাড়ায়। এ ক্ষেত্রেও একপর্যায়ে ব্যর্থ হয়। কিন্তু অন্য ক্ষেত্রে মানলেও পরিবাবের ওপর নিয়ন্ত্রণহীন দশা কেউই মানতে চায় না। কারণ পরিবারকে মনে করে সবচেয়ে আপন, একান্তই নিজের। সেই পরিবারকেই ছেড়ে লোকটা রাস্তায় নামল। ভাবা যায়!

এত সহজে কেউ পরিবার ছাড়ে। মানুষ তো আঁকড়ে থাকে। নিয়ন্ত্রণ তলানি অবস্থায় পৌঁছালেও ঘুরপাক খায় পরিবারকে কেন্দ্র করে। মানুষ বিভিন্ন সময় নতুন করে ভাবতে শুরু করে। এ ধারায় একসময় তার কাছে অকাঠ্যভাবে ধরা দেয়, জগৎসংসারে পরিবারই সব। নতুন এ ভাবনায় একপর্যায়ে পত্নী, পরে পুত্র-কন্যা, অতঃপর নাতি-নাতনি নিয়ন্ত্রণে মরিয়া হয়ে ওঠে মানুষ। এ সবই সুখের লাগিয়া! অনেকে আবার পত্নীর পাশাপাশি উপপত্নীতেও সুখ খোঁজে। একসময় এ বিষযটি ছিল অপ্রকাশ্যে ও নিয়ন্ত্রিত। মুক্তবাজার অর্থনীতির ধারায় এটি এখন ওপেন সিক্রেট এবং নিয়ন্ত্রণহীন। এ ক্ষেত্রে আকাশের সীমান্ত রেখা খোঁজে অনেকে। খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার মতো।

পরিবারকেন্দ্রিক প্রথম দুই ধাপের নিয়ন্ত্রণ প্রয়াসে ব্যর্থতার গ্লানি অনেকটাই ঘুচে যায় নাতি-নাতনি নিয়ন্ত্রণ সাফল্যে। অধিক বয়সী ও কম বয়সী শিশুদের মিতালী যেন স্বর্গের প্রতিচ্ছবি। এ সময় অতীতের সব ব্যর্থতার বঞ্চনা ভুলে গিয়ে তৃপ্তি অনুভব করে অনেকে। আসলে এই তৃপ্তিও রংধনুর মতো। বিষয়টি অনেকের কাছেই পরিষ্কার হয় যখন নাতি-নাতনি কৈশোর পেরিয়ে সামনের দিকে এক পা দুই পা করে আগায়। অবশ্য এই দশার মুখোমুখি হওয়ার আগেই অনেকেই পরপারে দু’পা বাড়িয়ে দেয়। ফলে তার আর জানা-ই হয় না, আঁকড়ে ধরা তার শেষ অবলম্বনও আসলে ছিল মরীচিকা। আর যারা যাই-যাই করেও টিকে থাকে, তারা থাকে বড়-ছোট বাথরুম নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায়। তখন তো তার কাছে পাটগাছ আর বটগাছ, দুই-ই সমান। এ সময় সে দেহ ও চিন্তার উভয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারায়। একপর্যায়ে মানুষ হয় নির্বোধের চরম! অনেকে জন্মকালীন অবস্থার চেয়েও অধিক অসহায়ভাবে জগৎ থেকে বিদায় নেয়। এর আগে সে সবচেয়ে বেশি অবহেলার শিকার হয় তাদের কাছ থেকে যাদের সবচেয়ে আপন ভেবেছিল। এ ক্ষেত্রে সুলতান সুলেমান আর হরিপদ শিল সমার্থক।

নিরন্তর হাঁটতে থাকা লোকটা কেন রাস্তায় নামল? সমস্যা হচ্ছে লোকটার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ নেই। কথা বলতে পারলে জানা যায় অনেক অজানা বিষয়। মুখ খুললে ভেতরটা আর লুকিয়ে রাখা যায় না। হোক তা ছোটখাটো চাকরির গোবেচারা প্রার্থী, বা হোক ছিঁচকে থেকে মস্ত বড় অপরাধী। চোখ আর চেহারা ভেতরটা অনেকটাই উন্মোচিত করে। মুখের আওয়াজ বিষয়টি করে আরো পরিষ্কার। কাজেই নিরন্তর হাঁটতে থাকা লোকটির সঙ্গে কথা বলতে পারলে তার পরিচয় পাওয়ার একটি উপায় ছিল। হয়তো তার এই নিরন্তর পথচলার কারণও জানা যেত। কিন্তু সে তো কোনো কথাই বলে না! তবে হয়তো সে কিছু বলতে চায়। যে কারণে প্রায়ই তার ঠোঁট নড়ে। কিন্তু এই পর্যন্তই। বোধগম্য কোনো শব্দ বের হয় না। যে শব্দ বের হয় তাও মোটেই অর্থবোধক নয়। ফলে তা থেকে কিছু বোঝার কোনো উপায় নেই। তবে এটা স্পষ্টই বোঝা যায়, সে কথা বলার চেষ্টা করে বলে ঠোঁট নড়ে। আবার এমনও হতে পারে, ঠোঁট নড়ে অন্য কারণে।

মানুষের শরীর এক অদ্ভুত সৃষ্টি। কখনো নড়ে নিজের ইচ্ছায়, কখনো নড়ে নিয়ন্ত্রণহীন। আবার কখনো মোটেই নড়ে না। যে চোখ সর্বদা নড়তে থাকে সেই চোখও নিথর হয়ে যায়। যে চোখ মনের কথা বলে, সেই চোখ একেবারে হয়ে যায় পাথরের চোখের মতো। মরা মাছের চোখও মনে হতে পারে।

মানুষের সঙ্গে মাছের চোখের বড় ধরনের ফারাক আছে। মরা মাছের চোখে থাকে এক ধরনের করুণ আর্তি। মানুষের থাকে ভয়ানক এক চাহনি। মাছের চোখ হয়তো মানুষকে বলে, তোমার লালসায় আমার মরণ। মরা মাছের চোখের এই করুণ আর্তি কারো নজর কাড়ে না। বরং অনেকে চোখ দেখে বোঝার চেষ্টা করে, কত আগে মাছটি মরেছে। মাছের মরার বিষয়টি মুখ্য নয়, রসনা মুখ্য। ফরমালিন দিয়ে পচন ঠেকানো গেছে। রং দিয়ে মাছ জল থেকে সদ্য তোলা একটি অবস্থা সৃষ্টি করা যায়। কিন্তু মরা মাছের চোখ বদলে দেওয়ার কৌশল এখনও রপ্ত করতে পারেনি ভেজাল কারবারিরা। যে চোখে থাকে কেবল করুণ আর্তি।

কিন্তু জীবিত অবস্থায় মাছের চোখে বয়ে যায় কেবল আনন্দের বন্যা। আর বানের জল হলে তো কথাই নেই। তখন জলের মাছ ডাঙায়ও ওঠে। মাছের চোখে সে কী আনন্দের ছোটাছুটি! কিন্তু মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাছের চোখে একটি করুণ আর্তি ফুটে ওঠে। আর যত সময় যায় ততই এই আর্তি আরো করুণ হতে থাকে। এদিক থেকে মানুষের চোখ পুরো উল্টো।

জীবিত অবস্থায় মানুষের চোখে নানান ছবি খেলা করে। কখনো হাসে, কখনো কাঁদে, কখনো শান্ত, কখনো অশান্ত। কখনো আবার ক্রুদ্ধ! কিন্তু মানুষ মরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চোখ কেবল ক্রুদ্ধ রূপ ধারণ করে। সেখানে কেবলই থাকে একটি ছবি। হয়তো এ কারণেই মৃত ব্যক্তির জন্য প্রথমেই তার চোখের পাতা বুজে দেয়া হয়। কিন্তু পুরো চোখ বোজানো না থাকলে তখন চোখের ওপর তুলা দিয়ে চাহনি আড়াল করা হয়। হিন্দুদের তো তুলসীপাতা দেয়ার একটি সনাতনী রেওয়াজ আছেই। এসবই হচ্ছে মরে যাওয়া ব্যক্তির চাহনি আড়াল করার চেষ্টা। যে চাহনি হয়তো চির অবহেলার শিকার হয়ে সবাইকে অভিশাপ দিতে থাকে। যদিও আশীর্বাদ-অভিশাপ বিষয়টিও অনেকটা গোলমেলে বিষয়। এর কার্যকারিতা নিয়েও অনেকের সন্দেহ-সংশয় থাকা বিচিত্র কিছু নয়। যে সংশয় ছিল একসময় আরজ আলীরও।

জীবনবৃত্তের বাইরে নিরন্তর হাঁটতে থাকা লোকটি যেমন কোনো কথা বলে না, তেমনই তার চোখ দেখারও কোনো উপায় নেই। একে তো ছোট চোখ, তাও আবার কোঠরাগত। এর ওপর আবার ভুরু-চুলের জঙ্গলের বাড়াবাড়ি। মাঝেমধ্যে কেবল লোকটার ঠোঁট দেখা যায়। ফলে তার চোখ দেখার আশা দুরাশা। আর চোখ না দেখার মতোই তার কথাও কেউ কখনো শোনেনি।

আবার তাকে কোথাও বসতেও দেখেনি কেউ। অথবা দেখেছে এমন কাউকে পাওয়া যায়নি। অবশ্য এমন কাউকে কেউ খোঁজেনিও। কে খুঁজবে? কার সময় আছে! নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াবার লোক এখন তেমন আর অবশিষ্ট নেই। আর এখন তো সেই বনও নেই। দখল দূষণে বন উজাড়। এরপর হয়েছে নদী দখল। যদিও নদী উদ্ধারের নামে দাউদ চুলকানোর মতো একটি বিষয় দেখছে দেশের মানুষ। তবু ভালো! মন্দের ভালো বলে একটি প্রবচন আছে।

ঘটনাচক্রে যেন জানা গেছে, নিরন্তর হাঁটতে থাকা লোকটার নাম আরজ আলী। সঙ্গে জানা গেছে আরো কিছু বিষয়। আবার এ জানাটাও ইতিহাসের মতোই গালগপ্পও হতে পারে। ইতিহাস পড়ার সময় মনে হবে, লেখক নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে ঘটনার সময় নোটবুক নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু আসলে তো তা নয়। নিরন্তর হাঁটতে থাকা লোকটির বিষয়ে জানার বিষয়টিও এমনই ইতিহাস হতে পারে। অনুমাননির্ভর এ ইতিহাসের ছায়ার বাইরে তার ব্যাপারে জানার কোনো আগ্রহ তেমন কারো আছে বলেও মনে হয় না। আবার তার এই নিরন্তর পথচলা সবার নজরে পড়েছে, তাও মনে করারও কোনো কারণ নেই। এতে অবশ্য কোনো কিছু অশুদ্ধ হওয়ার কথা নয়। কারণ একটা লোকের নিরন্তর হাঁটা লক্ষ করার মতো বিষয়ও নয়। উলঙ্গ হয়ে হাঁটলেও তবু একটা কথা ছিল!

ছোটবেলায় আরজ আলী তাদের শহরে এক পাগল দেখেছে। সে উলঙ্গ থাকত। আর এ অবস্থায়ই হাঁটত। তবে তার দিকে কারো মনোযোগ ছিল না। মাঝেমধ্যে খাবারের দোকানের সামনে গিয়ে সে হাত পাততো। ঝামেলা বিদায় করতে দোকানি নিমিষে তার হাতে রুটি-কলা-বিস্কুট যা হোক, একটা কিছু ধরিয়ে দিত। এভাবে হাত পেতেই চলত তার দিবানিশি। আধুনিক সময়ে যেমন ব্যাংকের কাছে হাত পেতেই চলে অনেক ধনবানের জীবন। এরাও নানা পাগলামি করে। এরা সেয়ান পাগল।

আরজ আলীর শহরে পাগলটি একবার ঝোলা গুড়ের মধ্যে হাত ডুবিয়ে সেই হাত আবার মুড়ির বস্তায় ঢুকিয়েছিল। এর পর সে হাতে লেগে থাকা গুড়-মুড়ি খেয়েছে পরম তৃপ্তিতে। সে এক দেখার মতো দৃশ্য! বিষয়টি পুরো বাজারে চাউর হয়ে গিয়েছিল। এ ঘটনা আরজ নিজেও দেখেছে। কিন্তু এই পাগল কখনো উনুনের ফুটন্ত তেলে, নর্দমার পানিতে অথবা কেরোসিনের ড্রামে হাত ডুবায়নি। মাছি ভনভন মাছের বাজারেও তাকে কেউ দেখেনি কোনোদিন। এদিকে ব্যস্ত শহরেও কোনো পাগল গাড়ি চাপা পড়েছে বলে কোনো খবর কখনো পাওয়া যায়নি।

পাগলদের এই সাবধানতার উৎস কী? এ এক অদ্ভুত বিষয়। তাহলে পাগলরাও কি সেয়ান হয়! অবশ্য সব মানুষই কোনো না কোনো মাত্রায় পাগল ও সেয়ান। অনেক কিছু হারানোর পরও মানুষের সেয়ান প্রবণতা থেকেই যায়। এ এক গোলকধাঁধার মতো মনে হতো আরজ আলীর কাছে। সে আরো ভাবত, দু-একটি ঘটনা ছাড়া অন্যের প্রয়োজনের বাইরে মানুষ মানেই একা। এমনকি জড়পদার্থও পরমাণুতে একক। এই বাস্তবতা বিবেচনায় কি আরজ আলীর আজকের এই একক দশা? নাকি অনিবার্য পরিণতি বিবেচনায় রেখেইে সে একক অবস্থানকে বেছে নিয়ে রাস্তায় নেমেছে! হয়তো শেষ দিনগুলো সামাজিকতা-নিয়মনীতির বাধ্যবাধকতার বৃত্তের বাইরে গিয়ে সে জীবনকে উপভোগ করতে চায়!

বৃত্তের বাইরে যাওয়ার প্রবণতা মানুষের স্বভাবজাত। এ ব্যাপারে মানুষের আসলে ব্যাঙের স্বভাব। বলা হয় ব্যাঙ এক স্থানে থাকতে চায় না, কেবল লাফায়। মানুষও আসলে এক স্থানে না থাকার প্রবণতায় ভোগে। তবে ব্যাঙের মতো শারীরিকভাবে যত লাফায় তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি লাফায় মানসিকভাবে। মানুষের মন কেবল লাফাতেই থাকে। সবারই আসলে বৃত্ত ভাঙার প্রবণতা আছে। কিন্তু বৃত্ত ভাঙতে পারে কেবল গুটি কয়েক মানুষ। হয়তো আরজ আলী এদেরই একজন। তা হলে আরজ আলী কি এক অর্থে সৌভাগ্যবান? এ এক জটিল প্রশ্ন।

এত সব প্রশ্নের মধ্যে প্রধান হচ্ছে, আরজ আলীর এই পথচলার শেষ কোথায়? নাকি মানুষের পথচলা শেষ হয় না? বিভিন্ন ধর্মে বলা হয়, মরণের পরও অন্য এক জীবন আছে। বর্ণনামতো মুসলমানদের আর এক জীবনের সূচনা হয় মরণের পরই। এ বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মধ্য দিয়ে গেছে আরজ আলী। আর দশটা শিশুর মতো জন্মগত সূত্রে সে মুসলমান ধর্মের আনুষ্ঠানিকতার অনুশীলনে ছিল।

অন্য ধর্মের কারো ঘরে জন্মানে হয়তো সেই ধর্মেরই অনুসারী হতো। তার শহরের নিখিল সেন যেমন। কার ঘরে জন্মালে কী হতো সে আলোচনা এখন অপ্রয়োজনীয়। তবে ধর্ম নিয়ে নানান বিবেচনা মোটেই অবান্তর নয় বলে মনে করে আরজ আলী। যে কারণে মসজিদের সামনে থেকে হাঁটার সময় এখনো আরজ যথেষ্ট তাজিম সহকারে হাঁটে। আর নিখিল সেন তার বাড়ির পাশে একটি হাইরাইজ ভবনে যে আঠারোটি পরিবারের মাথা গোঁজার ঠাঁই গোজার ক্ষেত্রে অনুপ্রাণিত করেছেন তারা সবাই সনাতন ধর্মের।

আর মুক্তিযুদ্ধের সময় সারা দেশে পাকিস্তান বাহিনী আর তাদের দোসরদের ধর্ষণ-তা-বকে ছাপিয়ে গভীর ব্যথার স্মৃতি হয়ে রয়েছে নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোটের বিজয়ের পর ভোলায় নির্বিচার ধর্ষণের ঘটনা। জীবনের শেষ লগ্নেও, যা জন্য খুবই বেদনাদায়ক স্মৃতি হয়েই ছিল তার। নিখিল সেনের মতো একই অনুভূতি হয়তো হতো আরজ আলীর, যদি সে নিখিল সেনের মতো হিন্দু পরিবারে জন্মাত। আসলে জন্মগত ধর্ম অনুশীলনে না থাকলেও বলয় থেকে খুব কম মানুষই বের হতে পারে। তা নিখিল সেনই হোক, অথবা হোক আরজ আলী। ধর্ম নিয়ে পরিণত বয়সে এমনটাই ভেবেছে আরজ আলী।

যৌবনে আরজ আলী ধর্ম নিয়ে অন্যরকম ভাবত। সব ধর্মের বিষয়ে তার উন্নাসিক মনোভাব ছিল। তেজোদীপ্ত যৌবনে সে ধর্মের খোলসের বাইরে নিজেকে ভাবত অন্যরকম মানুষ। কিন্তু এ ভাবনা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। আবার সে ধর্মের খোলসে ফিরে গেছে। একপর্যায়ে আরজের মনে হয়েছে, মানুষ আসলে শামুকের মতো। ধর্মের খোলসের বাইরে একটু বের হলেও নানান বাস্তবতার কারণে অল্পতেই আবার গুটিয়ে যায়। আর মানুষ যৌবনে যে অন্যরকম ভাবে তখন সে খেয়াল করে না, ধর্মের বিষয়ে তার শেকড় কত গভীরে গেছে। এই শেকড়ের টানে এবং ধর্মকেন্দ্রিক নানান অনাচারের ধাক্কায় মানুষকে কোনো না কোনো ধর্মের ব্রাকেটে থাকতেই হয়। সে ক্ষেত্রে জন্মগত ধর্মই অগ্রগণ্য।

অনেকে আবার অন্য ধর্ম গ্রহণ করে নানান সুবিধার হিসাব-নিকাশে। আবার অত্যাচারের ভয়েও জন্মগত ধর্ম বদলের ঘটনা আছে অনেক। তবে প্রায় সব মানুষ কোনো না কোনো ধর্মের ছাতার তলে থাকে। কিন্তু কতজন ধর্ম মেনে চলে, তা কিন্তু বলা কঠিন। তবে প্রকৃত অর্থে ধর্ম মানা মানুষের সংখ্যা জগৎসংসারে খুব বেশি নয়। এরপরও জগৎজুড়ে ধর্মকেন্দ্রিক রক্তপ্রবাহ ধরনিকে কলুষিত করছে নিরন্তর। এসবই ভাবত আরেজ আলী প্রায় এত দিন। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে এখনো হয়তো এসবই ভাবে। কিন্তু সে কারোরই তেমন নজরে পড়ছে না। কিন্তু একদিন অনেকের নজরে পড়ল আরজ আলী। এজন্য চোখ নয়, কাজ করেছে নাক।

নিরন্তর হাঁটার বদলে আরজ আলী পরিত্যক্ত এক টোলঘরের সামনে ফুটপাথে কাত হয়ে পড়েছিল। অনেকেই দেখেছে। কেউ বিষয়টি আমলে নেয়নি। কিন্তু লাশের গন্ধ ছড়ানোর পর এলাকাবাসীর হুশ হলো। খবর গেল থানায়। ব্যস! সবকিছু যেন কেমন পাল্টে গেল। নানান রকমের সতর্কতা, বিভিন্ন ধরনের কানাঘুষা। কেউ কেউ এমনও বললেন, লোকটা খুব ভালো ছিল। কিন্তু কিসের ভিত্তিতে এই বায়বীয় কথা বলল তা জানা যায়নি। অনেক জটলার পর পুলিশের গাড়ি এলো। লাশ গেল মর্গে। সেখান থেকে স্বর্গে গিয়েছিল কি না, তা জানা যায়নি। তবে পোস্টমর্টেম রিপোর্টে জানা গেল, লোকটি আত্মহত্যা করেছে। তবে এটি সত্য না মিথ্যা, তা জানা যায়নি। তবে এটি জানা কথা, পোস্টমর্টেম রিপোর্টে মিথ্যা তথ্য দেয়ার ঘটনা অনেক আছে। যে কারণে অনেক সময় কবর থেকে গলিত লাশ তুলে আবার পোস্টমর্টেম করা হয়। কিন্তু এবারও যে রিপোর্ট সঠিক দেয়া হয়েছে, তারই বা নিশ্চয়তা কী! ফলে মৃত্যুর পর কী হবে, তা নিয়ে যেমন নানান রকমের বয়ান আছে তেমনই মৃত্যুর কারণ নিয়েও ধোঁয়াশা কম হয় না। কাজেই আরজ আলী আত্মহত্যা করেছে নাকি অন্য কারণে মরে গেছে, তা নিশ্চিতভাবে আর জানার উপায় নেই। তবে পোস্টমর্টেমে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়ায় পুলিশের বেশ সুবিধা হয়েছে। কারণ কপর্দকহীন একজন মানুষের মরণ নিয়ে পুলিশকে কোনো ঝামেলা পোহাতে হয়নি। মরে যাওয়া অজানা একটি লোকের বিষয় নিয়ে মাথা ঘামিয়ে পুলিশের লাভ কী? পুলিশ কি অঙ্কের বোকা বানর যে অকারণে তৈলাক্ত বাঁশে ওঠার জন্য লাফালাফি করবে!

পোস্টমর্টেমের কথা যদি সত্য হয় তা হলে একটি একটি প্রশ্ন সামনে আসে। তা হচ্ছে, আরজ আলী আত্মহত্যা করল কেন? বলা হয়, মানুষের কাছে জীবন যখন অসহনীয় হয়ে ওঠে; যখন তার মনে হয়, কী দরকার এই জীবনের, তখন সে আত্মহত্যা করে। এরা দুর্বলচিত্তের লোক। কিন্তু আরজ আলীকে এই ফরম্যাটে ফেলা যাবে না। চিরকালই আত্মহত্যাকে সে একটি ফালতু কাজ মনে করেছে। তা হলে নিজেই এ কাজ করল কেন সে? তা হলে কি, বৃত্তের বাইরে বন্ধনহীন স্বল্পমেয়াদি মুক্ত জীবনও শেষতক তার কাছে অসহনীয় হয়ে উঠেছিল নাকি বৃত্তের মধ্যে থাকা দীর্ঘ জীবনের স্মৃতির বোঝা বৃত্তের বাইরেও তাকে দগ্ধ করেছে নিরন্তর? এ প্রশ্নের আর কোনো উত্তর মিলবে না। আসলে মানুষকেন্দ্রিক অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর কোনো দিনই মেলে না!