পশ্চিম আফ্রিকার পথ এবং প্রান্তরে

প্রকাশ | ০৯ জুন ২০১৯, ১০:০০ | আপডেট: ০৯ জুন ২০১৯, ১০:০৩

কাজী রাফি

পশ্চিম আফ্রিকায় নভেম্বর শুরুর সকালের বাতাসটা বড় স্নিগ্ধ। যদিও দুপুরের দিকে তাপমাত্রা চল্লিশ ডিগ্রি অতিক্রম করছে। তবু রাতে তা নেমে যাচ্ছে পঁচিশ ডিগ্রিতে। গত চার মাস মালির উত্তরাংশের মরুতে বৃষ্টিফোটারা মহার্ঘ্য হলেও রাজধানী বামাকোতে অন্য বছরগুলোর তুলনায় এবার বৃষ্টি হয়েছে ব্যাপক। খরস্রোতা নাইজার নদীতে তাই ঢলঢল যৌবন। রাজধানী বামাকোর আশপাশে ছড়িয়ে থাকা শুকনো খটখটে পাথুরে পাহাড়গুলোতে সবুজের জেল্লা। আর এই বৃষ্টির প্রভাবে মরুর শুকনা ভূমিতে এবার ভালো ভুট্টার চাষ হয়েছিল এবং চাষ ছাড়াই আকাশের দিকে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল আফ্রিকার ভয়াল ঘাস। তাই খেয়ে এখন ঘরে ঘরে ছাগল-দুম্বা, গরু আর উটের শরীরে ঘাসগুলোর মতোই বাড়ন্ত উদ্ভিন্নতা। তবে বাস্তবতা এই যে, প্রাণীগুলোর চকচকে স্বাস্থ্য ডিসেম্বরে গিয়ে শুকিয়ে শীর্ণ হয়ে যাওয়া ঘাসের মতোই শুষ্ক হয়ে উঠবে।

নভেম্বরের এমন এক সুন্দর সকালে মালির রাজধানী বামাকো থেকে যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছি দেশটির প্রাচীন এক জনপদ এবং আফ্রিকার এই অঞ্চলের ৭০০-৮০০ বছর আগের সমগ্র আফ্রিকার সবচেয়ে বড় সভ্যতার চিহ্ন বহনকারী নাইজার নদীর প্রান্তে গড়ে ওঠা তিম্বুকতোর উদ্দেশে। সাহারা মরুভূমির প্রবেশদ্বারে। দূরত্ব ১০৩৭ কিমি। আমার নেতৃত্বে বাংলাদেশের পঞ্চাশজন সেনাসদস্য ছাড়াও আমাদের প্রোটেকশনে টগোর ট্যাঙ্কাররা থাকছে। আকাশ টহলের অংশ হিসেবে থাকছে মিশরের বিমানবাহিনীর একটা হেলিকপ্টার। আছে রসদ বহনকারী বেসামরিক আরো সাঁইত্রিশটা বিশাল সাইজের কার্গো ট্রান্সপোর্টার। বলা বাহুল্য, আফ্রিকার যেসব দেশে জাতিসংঘ তার শান্তিমিশন কার্যক্রম চালাচ্ছে সেসব দেশে মানুষ পরিবহনের জন্য মহাসড়কগুলোতে যত বাস চলে এসব কার্গো চলে তার চেয়ে বেশি।

বলে রাখি, মাত্র ১৫ মিলিয়ন জনসংখ্যার মালি বাংলাদেশের চেয়ে আয়তনে প্রায় নয়গুণ বড়। যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে দেশটির অনেক জনগণ অপেক্ষাকৃত নিরাপদ স্থান হিসেবে বসবাসের জন্য রাজধানী বামাকোকে বেছে নেওয়ায় এই শহরের জনসংখ্যা ব্যাপক বেড়ে গেছে। তাছাড়া দেশটি মুসলমান-প্রধান হওয়ায় (প্রায় ৯০ ভাগ) এই দেশে এইডসের মাত্রা আফ্রিকার অন্য দেশ থেকে অনেক কম। পাঁচ মাস আগে পথে-ঘাটে, বাজার এলাকায় যে পরিমাণ মানুষ চোখে পড়ত; এখন আর তেমন পরিস্থিতি নেই। নিত্যনতুন করে রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম বাড়ছেই। আমার অধীনে আছে বাংলাদেশের দুজন সামরিক অফিসার। একজন মেডিসিন স্পেশালিস্ট ডাক্তার নোমান এবং কমিউনিকেশন অফিসার মেজর সারোয়ার। এই অপারেশনে অধিকাংশ সময় মোবাইল নেট (বিশেষত নাইজার নদীর পাশ দিয়ে মৌরিতানিয়ার বর্ডারের পাশ দিয়ে সাহেইল রিজিয়নে) কাজ করবে না বলে প্রতিটি যানের সাথে আমাদের যোগাযোগ রক্ষা করা ছাড়াও আমার সাথে এয়ার ফোর্সের (গ্রাউন্ড টু এয়ার) কমিউনিকেশনের দায়িত্ব তার।

মালিয়ান দোভাষী কামারাকে চোখে সানগ্লাস এবং মরুর তাপ থেকে বাঁচার জন্য মুখ-মাথা ঢেকে রাখা নীল বর্ণের শীতল আর নরম কাপড়ে (বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সরবরাহ করা হাজী-গামছা) অদ্ভুত দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে, এক ভীত ভূত পথ হারিয়ে আমাদের সঙ্গী হয়েছে।

বামাকো শহর পার হয়ে মসৃণ আর সুপরিসর রাস্তা থেকে সামনে, ডানে-বাঁয়ে যেদিকে চোখ যাচ্ছে দেখছি প্রচুর আমবাগান আর দিগন্তজুড়ে বৃষ্টির জল পান করে সবুজ হয়ে ওঠা ছোট ছোট কাঁটাজাতীয় গাছের ভেতর দু-একটা নাম-না-জানা মরুর বর্ষীয়ান বৃক্ষ। বৃক্ষগুলোর অধিকাংশই সবুজ পাতাসমৃদ্ধ হলেও হাতির শুঁড়ের মতো নিচের দিকে দুই বিশাল পাতাহীন ডাল ছড়িয়ে দেওয়া গাছগুলোর নাম কী, তা আমাদের দোভাষী কামারাও জানে না। বামাকো শহরের সবচেয়ে জনবহুল বাজার এলাকাকে বাঙালি অফিসার আর সৈনিকরা মিলে নাম দিয়েছে ‘গুলিস্তান’। আনন্দের ব্যাপার হলো, অনেক বামাকোবাসী সেই এলাকাকে ‘গুলিস্তান’ নামে ডাকতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। এই তথ্য মাথায় রেখে চা-বিরতির ফাঁকে আমি কামারাকে কাছে ডেকে দুষ্টুমি করে বললাম,

কামারা, ওই গাছগুলোর নাম আমি জানি।

হোয়াট ইজ দ্য নেম, স্যার?

এলিফ্যান্ট ট্রি। তোমাদের লোকদের শিখিয়ে দিয়ো। কামারা খুব খুশি হয়ে বলল,

ওকে, স্যার।

কয়েক কিমি বাঁয়ে নাইজার নদী বইছে আমাদের সমান্তরালে। দু-একটা পাথুরে পাহাড় দেখে মনে হচ্ছে যেন কৃত্রিম কোনো পাহাড় দিয়ে এই দিগন্তজোড়া উঁচু-নিচু ভূ-প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যকে মহামান্বিত করা হয়েছে। বিকেলের মধ্যেই আমরা সেগু নামক শহরটিতে পৌঁছালাম। সেগু স্টেডিয়াম নয়নাভিরাম। মাঝখানে সবুজ ঘাসের চত্বরকে রুক্ষ আবহাওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে তাদের যত্ন চোখে পড়ার মতো। গোসল খাওয়া শেষে বিশ্রাম। ততক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। শুক্লপক্ষের চাঁদের আলোয় চা-আড্ডার জন্য স্টেডিয়ামের নরম ঘাসের পাশে ট্র্যাকে চেয়ার টেবিল লাগিয়ে অপেক্ষা করছিল নোমান আর সারোয়ার। আড্ডা জমে উঠতেই চাঁদ হারিয়ে গেল। রাতের খাবার খেয়ে ট্র্যাকে কয়েক চক্কর হাঁটতে গিয়ে মনে হলো আমরা আফ্রিকায়। আমাদের সবার স্পঞ্জের স্যান্ডেলের তলা ভেদ করে পায়ের তলায় ফুটছে ঘাসফুলের ধারালো কাঁটা। ট্র্যাকের মাঝখানে এখানে-সেখানে গজিয়ে ওঠা ঘাসের ফুলকে রক্ষা করতেই সেই কাঁটাগুলোতে অমন ধার!

পরেরদিন দুইশ কিমি দূরের ‘সান’-এর উদ্দেশে আমরা আমাদের যাত্রা শুরু করলাম। যতদূর চোখ যায় এই দিগন্ত বিস্তৃত মরুর মাঝে সবুজের আভা লাগা কাঁটা গাছগুলোকে কেমন নিঃসঙ্গ লাগে। কিন্তু যত পথ পেরিয়ে যাচ্ছি, বড় গাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। গাছগুলোতে সবুজ যে পাতাগুলো প্রকৃতিকে মায়াবী করে রেখেছিল, তা ক্রমেই হারিয়ে গিয়ে রুক্ষ ভূমির সাথে তার পাতাহীন কাঁটাগাছগুলো সাহারার অস্তিত্ব স্পষ্ট করে তুলছে। ‘সান’ পৌঁছে যথারীতি পুনরায় এক স্টেডিয়ামে আমাদের যাত্রাবিরতি। বিকেলে স্টেডিয়ামের সর্বোচ্চ উঁচুতে দাঁড়িয়ে চারদিকের ভুতুড়ে নির্জনতর অসীম মাঠ দেখে আমার ভেতরটা কেমন যেন ছোট ছোট মরা গাছ আর তুলে নেওয়া ভুট্টার খড় দিয়ে ঢেকে থাকা অযুত বালিকাসমৃদ্ধ মাটির সেই মাঠটার মতোই হু হু করে উঠল। সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত চাঁদের স্নিগ্ধ আলোয় সেখানেই বসে কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। সেদিনই প্রথম উপলব্ধি করলাম, মরুর বাতাস কেমন মোহনীয়! শুক্লপক্ষের চাঁদের আলো এই দিগন্তে সেই জীবনসঞ্চারী আর অমৃতসম বাতাসে মিশে যে অনন্য দৃশ্যের ভেতর প্রাণ সঞ্চার করে, তা আমি যেন স্পষ্টতই উপলব্ধি করতে পারছিলাম। আমার নাসারন্ধ্র যেন আজ এত সজীব হয়ে উঠেছে যে, তা তীব্রভাবে চারপাশের ঘ্রাণের মাঝে আমার কৈশোরের স্বপ্ন দেখার অনুভূতিকে ফিরিয়ে আনছিল।

সান হতে পরের দুইশ কিমি পথে নাইজার নদীর সংস্পর্শটুকু মর্মে মর্মে, শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে উপলব্ধি করছিলাম। আমবাগান, তরমুজ, ফুটি তরমুজ, বাদামের চাষ হওয়া ভূমির দিকে তাকিয়ে বুঝতে সমস্যা হচ্ছিল যে আমরা আফ্রিকার কোনো মরুর দেশের অভিযাত্রী। সামরিক অভিযানে এই যাত্রা শুধু পথ অতিক্রম করা নয়। বিশাল কনভয় নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি সমগ্র এলাকা সার্ভিল্যান্স করে সামনে এগোতে হয়। যেখানে থামছি, একটু ঘন ছায়া খুঁজে সেখানে বসে আমরা তিন অফিসার আড্ডা দেওয়ার চেষ্টা করছি। দেশটিতে বিবদমান সশস্ত্র সংগ্রামী দলগুলোর এক মোক্ষম টার্গেট এখন আমরা। সামরিক এসব অভিযানে মৃত্যু কাঁধের পাশে নিশ্বাস ফেলে।

সেজন্যই দেশের জন্য, মায়ের জন্য, স্ত্রী-সন্তান আর আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধবসহ জীবনের জন্য আমাদের ভেতরে অদ্ভুত এক আকুতি! পথের পাশে মাটির যে দুই একটা দেয়ালসর্বস্ব বাড়ি তার বারান্দা নেই, নেই কোনো প্রাণের ছোঁয়া, ছায়া। তবে তার আশপাশে পরিত্যক্ত পলিথিন আর প্লাস্টিকের সাথে যত্রতত্র ছড়ানো কাঁটা গাছের ডাল, জীবন্ত কিছু মরুর গাছে খেলা করা বাতাসের ছন্দ আমাদের জীবনের অনিত্যতার সাথে অনন্ত সময়ের প্রবাহমানতাকে যেন ফুটিয়ে তুলছে।

বিশ্রামের সময় আমি কনভয়ের মাঝখানে আমার অফিসারদের অবস্থান থেকে তাদের আমার কাছে নিয়ে আসি। ক্যাম্পস টুলে বসে রাস্তার পাশে কোনো কিশোরীর (আফ্রিকায় নারীরাই ঘরের কাজ থেকে বেচাকেনার কাজটুকু বেশি করে) কাছ থেকে কেনা কুল, বাদাম, তরমুজ অথবা কেনা পেঁপে দিয়ে খেয়ে চা পান করতে করতে নোমানের কণ্ঠ থেকে আকুতি ঝরে,

স্যার, এই দেশটার জন্য আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। তরমুজ থেকে যেন রক্ত ঝরছে। আর কুলগুলো! এত মিষ্টি কুল আমার জীবনে আমি খাইনি। এই নভেম্বরে এত বড় বড় কুল এই মরুর দেশে পাওয়া যায়, ভাবতে অবাক লাগে। সারোয়ার তার কণ্ঠে কণ্ঠ মেলায়,

এই গরুগুলো নিজের দেশের সব সম্পদ নিয়ে যেতে দিচ্ছে ফরাসিদের। আমি পালটা প্রশ্ন তুলি,

এরা কী করবে, বলো? ইউরেনিয়াম আর ডায়মন্ড লুণ্ঠনে সামান্য এক মশাও যদিও লুণ্ঠনকারীদের কাছে বাধা মনে হয়, তাহলে তারা শুধু কামান দাগছে না, উড়িয়ে দিচ্ছে যুদ্ধবিমান।

ঠিক, স্যার। কিছুদিন আগে আমাদের সুপার ক্যাম্পের পেছনে (ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, অস্ট্রিয়াসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশসহ বাংলাদেশ এবং আফ্রিকার কয়েকটি দেশের ক্যাম্পের একত্র অবস্থানকে ‘সুপার-ক্যাম্প’ বলা হয়) একজন কৃষক একটা পিক-আপ ভ্যানে করে জমিতে গোবর দিচ্ছিল। নেদারল্যান্ডস সেটা তাদের রাডারে ধরে ফেলে মিডিয়ায় প্রোপাগান্ডা ছড়াল যে, টেররিস্ট আর্মড গ্রুপ সুপার ক্যাম্প আক্রমণের জন্য সন্ধ্যার আগে রেকি করেছে। ব্যস, তারপর থেকে সকাল-বিকাল দুটি ড্রোন আকাশে উড়ছে। সুপার ক্যাম্পকে সুরক্ষিত করতে যে পরিমাণ খরচ শুরু হয়েছে, তা মোগল সম্রাটরাও কল্পনা করতে পারেন না। অথচ ক্যাম্পের বাইরে মানুষ খাবার পায় না। অনেকেই দুপুরে শুধু একটা ভুট্টা পুড়ে খায়। নোমান বলল,

অথচ আটশ বছর আগে এ দেশের রাজা মানসা মুসা ষাটটি কাফেলার বিশাল বহর নিয়ে হজে গিয়েছিলেন। প্রতিটি কাফেলার উটের পিঠে ছিল বস্তা বস্তা সোনা। সেই সময় সমগ্র পৃথিবীর অর্ধেক সোনা মালি একাই উৎপাদন করত। বলা হয়, হজ থেকে ফেরার সময় মানসা মুসা মিশর থেকে তার সোনা বিতরণ শুরু করেন। তিনি এত সোনা বিতরণ করেছিলেন যে, সারা পৃথিবীতে সে বছর সোনার মূল্য অর্ধেকে নেমে এসেছিল। সারোয়ার সারাক্ষণ হাসিমুখে ফিচ ফিচ করে হাসলেও এবার মুখে বিরক্তি এনে বলল,

ও ব্যাটা আরেক ছাগল! সোনা বিতরণ করে নিজের কালো সোনার সাথে পুরো আফ্রিকার সব সোনা খুইয়েছে। এসব সোনার গন্ধ পেয়েই আটলান্টিকের পাইরেটসরা ঢুকে পড়েছে আফ্রিকায়...

আমরা এক-দেড়শ কিমি অতিক্রম করার পরই ছোট্ট একটা বিরতি নিচ্ছি। গাছের ছায়া খুঁজে বিশ্রাম আর আড্ডার ফাঁকে আমার দৃষ্টি চলে যায় নির্জন অসীম প্রান্তরে। সান আর মোপতি এলাকায় নাইজার নদীর জলের প্রভাবে আমবাগান, কুলবাগান আর প্রচুর কৃষিভূমির অস্তিত্বের সাথে দিগন্তবিস্তৃত এই ভূমি আমাকে নস্টালজিক তুলছে। গায়ে ময়লা আর বিবর্ণ পোশাক পরা আফ্রিকান কোনো কিশোর-কিশোরীর জন্য কেন যেন হৃদয়টা কাঁদছে। এই দেশের মাটির নিচে এবং ওপরে সম্পদ সৃষ্টির অনন্ত উৎস থাকলেও যাদের মূলত কোনো সম্পদ নেই (ইউরোপের) তাদের কোনো কিশোরীর লাবণ্য আর চাকচিক্যময়তার পাশে আমি হয়তো মালির একটা কিশোরীকে কল্পনা করছি। যতবার এই দৃশ্যকল্প কল্পনা করছি, ততবার সামরিক পোশাকের অন্তরালে একজনের লেখকের হৃদয় সিক্ত হয়ে উঠছে।

এরই মাঝে নাইজার নদীর ওপরের একটা সেতু অতিক্রম করলাম। এখানে বলে রাখি এই নদী থেকে সেই মানসা মুসার আমলেই শত শত কিমি কৃত্রিম খাল বানিয়ে নদীর পানিকে প্রবাহিত করা হয়েছিল সমগ্র দিয়াবালি অঞ্চলে। সেই খালগুলোর কারণে আজও মালির বিস্তীর্ণ এই অঞ্চলে বাংলাদেশের মতো ধান চাষ হয়।

মোপতি থেকে দোয়েনজায় অভিযানের পথে মূল রাস্তা বেশ কিছুটা দূরে বিস্তৃত এক পাথুরে পাহাড়ের নিচে এক জলাশয় আর তাতে সাদা পদ্মমতো হাজার হাজার ফুল দেখে চমকে উঠলাম। কনভয় থামার নির্দেশ দিলাম। আমাদের তিন অফিসারের জন্য তিন গার্ড নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম সেদিকে। আমরা যতই জলাশয়টার কাছাকাছি পৌঁছাচ্ছি, মরুর বালিময় ভূমি স্বাভাবিক মাটির মতো মনে হচ্ছে। একটু পর ভেজা ভেজা নরম মাটিতে শত শত প্রাণীর পায়ের খুরের ছাপ দেখলাম। আফ্রিকার রাখালরা এই পথ পেরিয়ে তাদের গরু-ছাগল, ভেড়া আর দুম্বাগুলো নিয়ে নাইজারের উপত্যকায় যাওয়ার পথে প্রাণীগুলোকে এখানে নিশ্চয় জল খাইয়ে নেয়। খালের গভীরতা নেই বললেই চলে। আশপাশে মরুর বড় বড় কাঁটা গাছে যেন নীল মেঘ জলের ফোয়ার ছড়িয়ে মিশে আছে। এমন অনিন্দ্যসুন্দর গাছগুলো মন্ত্রমুগ্ধের মতো আমাকে কাছে টানল। সেদিকে হাঁটতে গিয়েই পেলাম পাকা কুলে ভর্তি তিনটা কুলগাছ। ছোট ছোট কুলগুলোতে ভয়ংকর বুনো স্বাদ।

আর একটু সামনে গিয়ে হলুদ-নীল আর বেগুনি বর্ণের ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র পাতাসমৃদ্ধ কাঁটা গাছগুলোর নিচে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে নিতেই দেখলাম আমার জীবনের সেরা কোনো এক দৃশ্য। লাখ লাখ প্রজাপতি গাছগুলো থেকে বের হয়ে ওড়াউড়ি শুরু করল। মনে হচ্ছিল প্রজাপতির বৃষ্টি হচ্ছে। মনে পড়ল, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ‘শত বছরের নিঃসঙ্গতা’ উপন্যাসের উরসোলার মৃত্যুক্ষণটি। মার্কেজ তাহলে মিথ্যা দৃশ্যকল্প আঁকেননি! সেই ক্ষণেও হাজার হাজার প্রজাপতির নিঃসঙ্গ শহরটির দেয়ালে দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে রাস্তায়-মাটিয়ে লুটিয়ে পড়ছিল। জল নয় প্রজাপতির বৃষ্টিতে যেন ভরে যাচ্ছে পথঘাট। মাটি থেকে বায়ুস্তরে শুধু অসংখ্য প্রজাপতির মিছিল। না, এখানে পরিস্থিতি তেমন নয়। এই বর্ণময় ক্ষুদ্র পাতার কাঁটা গাছগুলোতেই এদের আবাস। প্রজাপতি কি নিজেদের বর্ণকে মিলিয়ে নিজেদের এমন রাজ্য খুঁজে বেড়ায়!

দোয়েনজায় পৌঁছালাম যাত্রা শুরুর চার দিন পর। টগোর ক্যাম্পে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অফিসারদের জন্য কোনো প্রিফ্রাবিক্যাটেড এসি রুম বরাদ্দ করতে না পারায় তাদের অপারেশন অফিসার এসে দুঃখ প্রকাশ করলেন। কিন্তু তার ভদ্রতার বিনিময়ে তাকে কিছু বলার ভাষা আমার ছিল না। এই নভেম্বরেও তাপমাত্রা পঁয়তাল্লিশ ছাড়িয়েছে। স্মার্টফোনের আবহাওয়া নোটিফিকেশন বলছে, ‘ফিলস লাইক ফিফটি থ্রি’। এই গরমে তারা আমাদের থাকার ব্যবস্থা করেছে তাঁবুর মধ্যে! আর ঠিক এই সময়ই ফোর্স হেড কোয়ার্টারের সমন্বয়হীনতার কারণে আমাদের যাত্রা চার দিনের জন্য স্থগিত হয়ে গেল। এই চারটা দিন গরম থেকে বাঁচার জন্য আমরা ক্যাম্পের কয়েকটা মাত্র গাছের একটা গাছের নিচে তাঁবুর আউটার ঝুলিয়ে বসার ব্যবস্থা করলাম। সকাল নয়টা থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সেখানে বসে বসে সামনে আমাদের অভিযানের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ মরুভূমির রাস্তাবিহীন পথ অতিক্রমে নিরাপত্তার সম্ভাব্য সব পথ আলোচনা, বই পড়া, চা আর আড্ডায় কাটালাম। কিন্তু সন্ধ্যার সময়টুকু হয়ে উঠল খুব মোহনীয়।

আমাদের তাঁবু ছিল সীমানাপ্রাচীরের পাশেই। আর তাঁবু থেকে বের হয়ে বাঁয়ের পথটুকু ঢালু হয়ে উঠে গেছে এক পাথুরে টিলার ওপর। সূর্যাস্তের পর আফ্রিকার নীলাকাশে শুক্লপক্ষের চাঁদটা হেসে উঠে যেন আমাদের সেই টিলার ওপর হাতছানি দিয়ে ডাকতে থাকে। চেয়ার নিয়ে আমরা বসে পড়ি। পশ্চিমের খোলা দিগন্ত। যত দূর চোখ যায় গরু আর দুম্বা নিয়ে কেউ কেউ তখনো ঘরে ফিরছে। মালির অক্সিজেনসমৃদ্ধ স্নিগ্ধ বাতাস আমাদের নাসারন্ধ্রকে আপ্লুত, মনকে উতলা আর প্রাণকে সজীব করে তোলে। সত্যি, এই বাতাসে কিসের যেন মায়াস্পর্শ! হৃদয়, মন-প্রাণ ভরানো এই এলোমেলো বাতাসে জীবনঘ্রাণের নস্টালজিয়া। চিত্তপটে দেশের মাঠ-ঘাট, মায়ের মুখ ভেসে ওঠে। স্ত্রী-সন্তান-পরিজনদের জন্য মন কেমন আনচান করে ওঠে।

আমরা কথা বলি আফ্রিকার হতভাগ্যতা নিয়ে, সংকট থেকে উত্তরণে দেশটির রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্ভাব্য সমীকরণ কী হতে পারে, তা নিয়ে। আমরা কথা বলি সারা পৃথিবীর এলোমেলো সব বিষয়আশয় নিয়ে। আমাদের আগাম স্বপ্ন এবং এগিয়ে আসা সমূহ বিপদের কারণে সেই স্বপ্নের কাছাকাছি পৌঁছাতে না পারলে, নিজেদের প্রাণ এই মরুর বাতাসে চিরতরে হারিয়ে ফেলার আশঙ্কা নিয়ে আমরা কথাহীন হয়ে যাই। তারপর আবার কথা বলি অকারণ। সেখানে বসেই রাতের খাবার সারি। ১৪ নভেম্বর ২০১৬ ছিল ‘সুপার নোভা/মুন’-এর দিন। বেলা ডোবার আগেই স্বাভাবিকের চেয়ে বড় একটা চাঁদ আকাশ থেকে উঁকি দিয়ে সেই উঁচু টিলায় বসে থাকা তিন তরুণের এসব স্বপ্ন আর দুঃস্বপ্নের কথা যেন শোনার চেষ্টা করছে।

তার পরের দিন ভোরে দোয়েনজা থেকে আমাদের বিশাল সামরিক বহরটা নিয়ে আমরা রওয়ানা দিই তিম্বুকতোর পথে। সমগ্র পথটিতে আমাদের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ স্থান হলো দোয়েনজা থেকে বাম্বারামোদি হয়ে বাকি পথটুকু। সাহারা মরুভূমির অস্তিত্ব স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকা মরুর এই রাস্তায় কালেভদ্রে বেসামরিক দু-একটা যান চলাচলের চিহ্ন থাকলেও পথটি মূলত ট্র্যাকলেস। তবে সামরিক-বেসামরিক যত যানবাহন এই পথে চলেছে তাদের অনেকগুলোর ধ্বংসাবশেষ রাস্তার পাশে পড়ে আছে।

অসংখ্য সামরিক যানবাহন, ঊনপঞ্চাশটা বিশাল কার্গো আর ট্যাঙ্কের চাকাগুলো এই কাঁটাগাছ আর পাহাড়সমৃদ্ধ নির্জন প্রান্তরে বালিপথের ধুলা যেভাবে উড়িয়ে দিচ্ছে, তা যেন বিশ্বচরাচরে একমাত্র উৎপাত। দুম্বা আর উটগুলো সচকিত হয়ে দৌড়ে পালাচ্ছে। না, এই পথে অভিযান সচল রাখা খুব দুষ্কর হয়ে পড়ছে। একটু পর পরই কোনো না কোনো যানের চাকা বালিতে ফেঁসে যাচ্ছে। সেগুলোকে রিকোভারি দিয়ে উদ্ধার করতে গিয়ে রিকোভারি যানও একসময় বালিতে আটকা পড়ল। টগোদের ট্যাঙ্ক আর রিকোভারির সহায়তায় তা উদ্ধার হলো। এভাবে প্রতি ঘণ্টায় মাত্র সাত কিমি পথের বেশি কোনোভাবেই অতিক্রম করা যাচ্ছে না। এই নির্জন প্রান্তরই ‘টেররিস্ট আর্মড গ্রুপে’র বিশেষত আল-কায়েদার অপারেশন এলাকা। কিছুদিন আগেই এই পথে আল কায়েদা বড় এক অ্যাম্বুস অপারেশনে টগোর এক কনভয় দলকে ধ্বংস করে সবাইকে হত্যা করার দৃশ্য ভিডিও করে তা জাতিসংঘে সামরিক দল প্রেরণকারী প্রতিটি দেশের সরকারপ্রধানকে পাঠিয়ে মালি থেকে সেসব দেশের সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছে। ডানপাশে চার-পাঁচশ ফিটের উঁচু পাহাড় মনে হয় চলে গেছে এই নির্জনতার দিগন্তকে পেরিয়ে। সামনে টগোর ট্যাঙ্ক এস্কর্ট একটা ছোট বন এবং তার মাঝে কালভার্ট এলাকা নিরীক্ষণ করছে। এই অপারেশনকে বাউন্ড ক্লিয়ারিং ড্রিল বলা হয়। পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। বাইশ কেজি ওজনের বুলেটপ্রুফ পড়ে থাকার কারণে এসির মধ্যেও ঘেমে-নেয়ে গেছি। এই তীব্র গরমে আমার সাড়ে চার হাজার সিসির জিপ ভেতরটা যথেষ্ট শীতল করতে পারছে না।

আমাদের মাথার ওপর হেলিকপ্টার চক্কর দিচ্ছে। মোবাইল নেট নেই। ওয়াকিটকি, জিপিস সিস্টেম, গ্রাউন্ড টু এয়ার কমিউনিকেশন সিস্টেম এসব নিয়ে আমি নিজেই এক স্যাটেলাইট। জিপ থেকে নামলাম। প্রস্রাবের বেগের কারণে হাঁটতে হাঁটতে দূরের এক কাঁটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে প্রাকৃতিক কাজটা সারতে সারতেই বায়নোকুলারে চোখ রেখে সামনের ধূ-ধূ প্রান্তরে তাকালাম। শুধু কাঁটাজাতীয় মধ্যম আর ছোট আকৃতির গাছ। আর বালি-কঙ্করে মিশ্রিত এক ভূমি। এক রাখাল তার বিশাল পাল নিয়ে তার অভিযাত্রার পথে। নির্জন আর নিঃসঙ্গ এই প্রান্তরে তার অমন দুশ্চিন্তাহীন, প্রায় নিশ্চল গতির জীবন দেখে আমারও কেন যেন রাখালের সঙ্গী হতে ইচ্ছা করল। রহস্যঘেরা এই ভূমিতে তার রাতগুলো কীভাবে কাটে? বালিরাশির এই রহস্যঘেরা দিগন্তে মোহনীয় চাঁদের আলো নিশ্চয় তাকে এক বড় দার্শনিক বানিয়েছে!

বায়নোকুলার রেখে জিপার লাগাতে গিয়ে খুব তীক্ষ্ণ আর ঝিঁঝিঁ পোকার মতো মৃদু শব্দ শুনে কান খাড়া করলাম। দেখি আমার পায়ের কাছে এক ঝিনুক। তা হাতে তুলে নিলাম। বাতাসে শব্দে তুলে সে আমাকে কিছু একটা যেন বলতে চাইছে। আমি হৃদয়কে অবারিত আর মনকে উন্মুখ করে গভীর মনোযোগের সাথে ঝিনুকটার দিকে তাকালাম। তার বেদনার কথা জানতে চাইলাম। সে যেন আমাকে বলল,

আটলান্টিক আমাকে এখানে ফেলে চলে গেছে। হাজার বছর ধরে আমি তাকে ডেকেই চলছি...

আমি মরা ঝিনুকটার আত্মাকে ছুঁয়ে দেয়ার চেষ্টা করলাম। মায়াভরে তার গায়ে হাত বুলিয়ে লম্বভাবে বিস্তৃত পাহাড়টার দিকে তাকালাম। কাঁটাসমৃদ্ধ ছোট ছোট গাছ, আর গুল্মের অনন্ত এই সমতলকে কল্পনায় সাগরতলে ভাবতেই আমার কাছে অনেক কিছু স্পষ্ট হয়ে উঠল। অনুভব করলাম, নুড়িপাথর আর বালির এই পাহাড় বস্তুত সাগরের বালিয়াড়ি (উঁহবং)। ঝিনুকটার কানে কানে বললাম,

এমন আকুল ডাককে পৃথিবীর কোনো প্রেমিকই এড়াতে পারে না। তোমার ডাকে সাড়া দিতেই একদিন আটলান্টিক এখানে আবার তার জলের ঢল নামাবে। দোভাষী কামারাকে ডাকলাম,

কামারা, তোমার দেশের ভৌগোলিক ইতিহাস কী বলে? এখানে কি কখনো সাগর ছিল?

জি স্যার। একজন জার্মান ইতিহাসবিদ তার এক গ্রন্থে দেখিয়েছেন ঠিক এই অঞ্চলটায় নয় থেকে দশ হাজার বছর আগে আটলান্টিক ছিল। তারপর সে বিস্ময়ভরা কণ্ঠে পুনরায় আমাকে জিজ্ঞাসা করল,

বাট স্যার, হোয়াট ডিড ইউ গিভ দিজ আইডিয়া? আমি মৃদু হেসে বললাম,

এমনি... নাথিং এলস। আই ওয়াজ জাস্ট কিউরিয়াস।

ভোর থেকে রওনা হয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাত্র সাতানব্বই কিমি পথ অতিক্রম করে আমরা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বাম্বারামোদিতে পৌঁছালাম। সেই সাগর-বালিয়াড়ির পাহাড়ের মাথার ওপরে চাঁদটা ঝুলে আছে। অপেক্ষাকৃত উঁচু সমতল থেকে তিন দিকের সমতল ভূমিতে তাকালাম। ময়দামাখা চাঁদের আলো গাছপালাহীন দিগন্তকে রহস্যময় মায়ায় জড়িয়ে রেখেছে। পাহাড়ের নিচে সাধারণ মানুষের বেশ কিছু বাড়িঘর। মালিয়ান সরকারের একটা আর্মি ক্যাম্প। তাকে কেন্দ্র করে দূরে দূরে পাঁচটা এমজি পোস্ট। শুনলাম, এখানে মাসে তিন-চারবার সশস্ত্র দলগুলো আক্রমণ করে এবং বেশিরভাগ সময় মালি আর্মি পোস্টের পাশে রাখা পিক-আপ ভ্যানে করে পোস্ট ছেড়ে পালিয়ে যায়। আমাদের সৈন্য এবং সামরিক সকল যানের অবস্থানকে সুসংহত করতে তাদের মাঠের মাঝখানে রেখে তার চারপাশে ট্যাঙ্কগুলোকে অবস্থান নিতে বললাম। ক্যাম্পের বারান্দায় আমাদের তিনজনের মোবাইল তাঁবু টানানো হলো। জলের দারুণ অভাব। রাতের রান্না হতে অনেক সময় লাগল। খেয়ে তাঁবুতে শুয়ে পড়তেই সব উদ্বেগ যেন হাওয়ায় উবে গেল। তাঁবুতে প্রবেশপথে মশারির ভেতর দিয়ে চাঁদের আলো এসে খেলছে আমার বিছানায়। মরুর স্নিগ্ধ আর এমন নির্মল আলো শরীরে মেখে মরে যাওয়ার সৌভাগ্য কয়জনের হয়!

ভোর রাতে মালিয়ান ক্যাপ্টেনকে চা খাইয়ে বিদায় নিলাম। (সাত দিন পর একই পথে ফিরে আসার সময় তাঁকে আর পাইনি। সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের আক্রমণে তিনিসহ এই ক্যাম্পের আরো চারজন নিহত হয়েছিলেন। যদিও ক্যাম্পের পরিবেশ দেখে তা বোঝার উপায় ছিল না। কেননা, এসব হত্যা আর মৃত্যু এদের জীবনে নিত্যনৈমত্তিক ঘটনামাত্র।) এবার তিম্বুক্তোর পথে যত এগিয়ে যাচ্ছি গাছপালা তত বাড়ছে। বুঝতে পারছি সামনে নাইজার। জলের অস্তিত্ব স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সেজন্যই ক্রমশ ঘাস, লতাগুল্ম এবং ঘাস আর গাছপালায় সবুজ রঙের জেল্লা। শুধু মনে হচ্ছে এই বুঝি একটা গ্রাম সামনে। কিন্তু সবই মনুষ্যবিহীন, লোকালয়হীন।

নাইজার নদীর কাছাকাছি এসে যে দৃশ্য দেখলাম তা ভোলবার নয়। নদীর মোহনা বিস্তৃত হয়ে ছড়িয়ে গেছে অনেক দূর পর্যন্ত। ছনজাতীয় ঘাসের সাথে টলটলে নীল-সবুজ পানি আলো আর প্রতিচ্ছবির খেলা নিয়ে মহাব্যস্ত। প্রখর সূর্যালোকের তপ্ত মরুভূমির তেপান্তর পেরিয়ে যে অভিযাত্রী দল হঠাৎ এমন জলের খেলা দেখে তারা ছাড়া অন্য কারো কাছে এর মাহাত্ম্য আর অনুভব শুধু ভাষায় বর্ণনা করে বোঝানো যাবে না। মে-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশটির দক্ষিণাঞ্চলে তুমুল বৃষ্টি হয়। বর্ষা শেষের ঢল শুধু নয়, উত্তরের নাইজার থেকে প্রবাহিত জলের ধারায় এ নদী প্লাবিত হয়। উত্তরের পাহাড়ের ঢলে নাইজারকন্যার যৌবনে এখন ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ।

আমরা যখন নদীতীরে তখন আমাদের কনভয়ের সামনে অনেক বেসামরিক যান (আশ্চর্য রাস্তায় কোথাও এদের দেখা মেলেনি!)। হিসাব করে দেখলাম ছোট্ট দুই ফেরিতে (যার কোনোটাই একসাথে বড় দুই ট্রাকের বেশি বহন করতে পারে না) আমাদের বহর অতিক্রম করতে কমপক্ষে তিন দিন সময় লাগবে। পুরো জলমগ্ন চরাচরে রাস্তা ছাড়া একটাই মাত্র ভূমির অস্তিত্ব পাওয়া গেল, যেখানে পাঁচটা পরিবার কাঠ-ছনের ছাপরা দিয়ে ঘর বানিয়ে বসবাস করে। তাদের মাঝে খাবার বিতরণ করে সেখানেই একপাশে জলের ধারে রান্নার ব্যবস্থা আর অন্য পাশে অফিসারদের জন্য রাতের তাঁবু টানানোর সিদ্ধান্ত হলো। বিকেলের আলো ম্লান হয়ে এলে জলে ভাসা প্রান্তরের অনবদ্য রূপটা যেন আরো পরিস্ফুট হয়ে উঠল। আকশের নীল রঙ নেমে এলো মর্ত্যে আর ঠিক তখন বড় চাঁদটা আগুনের পি- হয়ে পুবদিগন্তে জলের ভেতর থেকে যেন তুলল তার মাথা। এই অনিন্দ্যসুন্দর দৃশ্য বর্ণনার অতীত। আমি জলে পা ভেজালাম। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকলাম আর হারিয়ে গেলাম এই অনাবিল, হৃদয়জাগানিয়া অনাবিল সৌন্দর্যমণ্ডিত অপরূপ এক জগতে।

এই ভ্রমণ-গদ্য শেষ করতে চাই এক মালিয়ান কন্যার গল্প বলে। নদীতীরের দ্বিতীয় মধ্যাহ্নবেলা। সেদিন ছিল নদীর অপারে তিম্বুক্তোর দিকে হাট-বাজারের দিন। মেশিনচালিত নৌকায় করে হাটে যারা যাচ্ছেন তাদের বেশিরভাগই নারী (বলে রাখি, ঘর সামলানো ছাড়াও সমগ্র আফ্রিকায় ব্যবসা-কৃষিকাজ, কেনাবেচায় মেয়েদের আধিপত্য বেশি। পুরুষদের মাঠে রাখালের কাজ, যান চালনা এবং বহন আর নির্মাণসংক্রান্ত কাজে আমি বেশি সংশ্লিষ্ট দেখেছি)। তারা বিক্রির জন্য তাদের উৎপাদিত সামগ্রী, জ্বালানির কাঠ, উট-ভেড়া আর ছাগল নিয়ে নৌকায় আরোহণ করছিল। পরবর্তী নৌকার আগমনের জন্য অপেক্ষা করছিল এক কিশোরী। তাকে দেখলাম এক খড়ির স্তূপের পাশে হেলান দিয়ে গান গাইতে। একটু পর পর সে গানের তালে তালে কোমর দুলিয়ে দুলিয়ে নাচছিল। আফ্রিকান নারীদের মুখের লাবণ্য এবং ত্বকের রঙের ঘাটতিটুকু স্রষ্টা খুব সম্ভবত পূরণ করে দিয়েছেন তাদের অনন্য দেহ সৌষ্ঠব দান করে। আমি স্পষ্টই শুনতে পেলাম যে মেয়েটি বাংলায় একটি গান গাইছে। আবার আমার দোভাষী কামারাকে ডাকলাম,

কামারা সে বাংলায় গান গাইছে কীভাবে? মেয়েটির দিকে তাকিয়ে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে কামারা জানাল,

নো স্যার, সি ইজ সিংগিং ইন বামবারা।

নো, সি ইজ নট।

ইয়েস স্যার, সি ইজ। কামারার আত্মবিশ্বাস দেখে আমি চেয়ার ছেড়ে উঠলাম। মেয়েটির কাছে গিয়ে ইংরেজিতে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম,

কী গান গাইছ তুমি? মেয়েটি ইংরেজি জানে না। সুতরাং কামারা আমার কথাগুলো তাকে অনুবাদ করে বাম্বারা ভাষায় শোনাতে থাকল। মেয়েটির কোমর দোলানো থেমে গেল। লাজুক হাসি হাসল সে। এমন করে কিছু একটা বলল যে, আমার মনে হলো, সে কী গাইছে তা সে জানে না। তবে কামারা আমাকে বলল,

স্যার, সে বাম্বারা ভাষার গান গাইছে। আমি খুব বিরক্ত হলাম,

কামারা, সে যে গানটা গাইছে সেটা তুমি গাও তো। কামারা এবার দ্বিধান্বিত ভঙ্গিতে লাজুক হাসি হাসল,

আমার যে গলা! কিন্তু স্যার, আপনার তো বাম্বারা ভাষা সম্পর্কে ধারণা নেই। অথচ আপনি না জেনেই জোর করে একটা ধারণা করছেন। আমি তো এই দেশের বাসিন্দা, নাকি?

কামারা, ওর গাওয়া বাম্বারা গানটা আমি গাই। কামারা ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। আমি মেয়েটির কাছাকাছি হয়ে মৃদুস্বরে গুনগুন

‘হৃদয়ে লিখেছি তোমারই নাম, হাওয়ায় হাওয়ায় ছড়িয়ে দিলাম

তুমি আমার অনন্ত আশা, তোমায় নিয়ে নীল স্বপ্নে ভাসা...’

আমার কণ্ঠে গান শুনেই মেয়েটি দারুণ খুশি হয়ে উঠল এবং অজান্তেই কিশোরী কন্যাটি তার ধারালো গড়নের কোমরটি দোলাতে থাকল। আমি এবার কামারাকে বললাম,

তুমি কি বাম্বারা ভাষা আসলে জানো? শোনো কামারা, তোমাদের আফ্রিকার (কেনিয়া) বিখ্যাত লেখক ইনগুগি ওয়া থিওং’গো বলেন যে, নোয়িং অ্যাদার ল্যাঙ্গুয়েজ উইথ মাদার-ল্যাঙ্গুয়েজ ইজ ইমপাওয়ারমেন্ট বাট নোয়িং সো মানি ল্যাঙ্গুয়েজ উইদাউট মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ ইজ ইনস্লেভমেন্ট। তুমি তো তোমার মাতৃভাষাটাই চিনতে পারছ না।

নো স্যার, ইউ আর নট সিংগিং ইন মাই মাদার টাং।

ইয়েস, এখন তুমি ঠিক বলছ। আই’ম সিংগিং ইন বাংলা, ইন মাই মাদার টাং। এবং মেয়েটি এই গানটাই গাইছে।

কামারা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আমার চোখে এমন করে তকিয়ে আছে যেন, দৃষ্টি সরিয়ে নিলেই এই জগৎ-বিশ্ব ধসে পড়বে। আমি মেয়েটিকে তার মোবাইলটা আমার হাতে দেয়ার জন্য অনুরোধ করি। সে নির্দ্বিধায় আমার হাতে ফোনটা দিতেই তার একটু আগের গানটা তাকে পুনরায় প্লে করানোর জন্য অনুরোধ করি। আমার পক্ষ নিতেই যেন মেয়েটা তার সস্তা ফোনটাতে ভিডিও চালিয়ে দিল। দেখি নায়ক রিয়াজ আর নায়িকা পূর্ণিমা বেখাপ্পা ঢঙে নাচছে। আফ্রিকার তন্বীর শরীরে এই গানের দোলা যেভাবে দোলায়িত হচ্ছিল, তা আমাদের নায়ক নায়িকার নাচের চেয়ে অনেক শৈল্পিক। তবু এই নাইজার নদীর মোহনায় যেন কোনো সাগরের সংক্ষিপ্ত এই সৈকতে, এই দিগন্তছড়ানো মরুর বাতাসে আমার দেশের গানের তাল-লয়-সুরের সাথে আমাদের চেনা স্নিগ্ধ দুটি মুখ; রিয়াজ-পূর্ণিমার জন্য কেমন ভালোবাসায় হৃদয়টা দুলে উঠল। মনটা বিষণ্ন হয়ে উঠল, সেই তরুণ বাঙালি তরুণ সেনা সদস্যের জন্য যে তার একরাশ স্নিগ্ধ ভালোবাসার চিহ্নের উপহার হিসেবে মেয়েটিকে দিয়ে গেছে অল্প দামের মোবাইল। কিন্তু অনেক দামের আমার মাতৃভাষার চলচ্চিত্রের অনেকগুলো গান। যেসব গান মেয়েটার মুখস্থই শুধু নয়, তার তাল-লয়-সুরের ভাঁজে ভাঁজে মিলিয়ে রেখেছে সে নিজ শরীরের ছন্দ আর আবেগ।

আমি কামারাকে ডেকে মোবাইলের ভিডিও থেকে একটা একটা গান বের করে তাকে দেখিয়ে বললাম,

তুমি হয়তো এসব সুন্দরী বাম্বারা নায়িকাকে চেনো না। এসো এদের সাথে তোমার পরিচয় করিয়ে দিই। এ হচ্ছে, আদ্যালিচিয়া পূর্ণিমা দ্য মুটিয়ে, এ হচ্ছে মানাভিলে জয়া আফ্রোদিলে, এ হচ্ছে ভায়লে পরিমনি দ্য ভায়োলেন্ট...

কামারা লজ্জাবনত মস্তকে দোপাশে না-সূচক মাথা দোলাতে দোলাতে আরক্তিম মুখে, প্রায় অস্ফুট স্বরে বলছে,

নো... নো স্যার..। আই’ম সরি ...

নাইজার নিজ প্রবাহের বাইরে দিগন্তজোড়া ছাপিয়ে দেয়া জলের ওপর দু-একটা নৌকা চলছে বটে, তবে এই নিস্তব্ধ প্রান্তরে নৌকাগুলো বইছে গান ছাড়াই। বাংলাদেশের সুরের বেদনায় টলমল কোনো নদী কল্পনা করতে গিয়ে আমি স্পষ্টই উপলব্ধি করি বাংলার মানুষের প্রাণে, মাঝিদের হৃদয়ে আগের সেই আবেগ নেই। ছলাৎ ছলাৎ ঢেউয়ের সাথে তাদের হৃদয় আর আগের মতো আবেগাপ্লুত হয় না। মাঝির কণ্ঠে জাগছে না প্রাণ আকুল করা কোনো সুর। তার নির্ভীক আর উদাত্ত কণ্ঠে এখন সুরের বদলে আগামী দিন নিয়ে, এই জীবন নিয়ে বড় শঙ্কা। গ্রামের অল্পবিদ্যায় ভীষণ অহংকারী কোনো দলীয় ক্যাডার ছাতামাথায় তার নৌকায় হয়তো বসে আছে। আছে ফরমাল ডি হাইড মেশানো ফল, আর ভারতের সীমান্ত দিয়ে পাচার হয়ে আসা মানহীন কীটনাশকের বিষে আক্রান্ত বাংলার শস্যভাণ্ডারের কিছু অংশ। হয়তো শস্য শব্দের আড়ালে আছে ইয়াবা অথবা ফেনসিডিল।

‘সব সখিরে পার করিতে নেবো আনা আনা, তোমার বেলা নেবো সখি তোমার কানের সোনা,... তোমার কাছে পয়সা নেবো না’ এই গানের মতো প্রেমময় স্বচ্ছ ব্যক্তিত্বকে বাঙালি আর ধারণ করে না। ত্যাগের মহিমায় জীবনকে উদ্ভাসিত করার ভাবনাকে তারা এখন কলুর বলদের চেতনা বলেই মনে করে। ‘বুকটা ফাইট্যা যায়’-এর এই কালে কলুষিত রাজনীতির পঙ্কিল কাদা ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে বাংলার আনাচ-কানাচে, সবুজ-শ্যামল প্রান্তরে।

আমার কল্পনা থামে না। দেখি যে, নৌকা থেকে নামার পর মাঝির ভাড়া দেয়ার পরিবর্তে গ্রামে ফেরার জন্য একই ঘাটে তার জন্য দিনভর তাকে অপেক্ষা করার হুমকি দেবে। মানুষকে বেঁচে থাকার নামে পুঁজিবাদের মৃত্যুমিছিলে শামিল করার যে অভিযাত্রা, সেখানে সুর থাকে না। থাকতে পারে না। কণ্ঠে গান জেগে ওঠে না। উঠতে পারে না।