কোথায় হারিয়ে গেল সেই দিনগুলো

সৈয়দ শিশির
 | প্রকাশিত : ০৯ জুন ২০১৯, ১০:১০

নেই যে ঈদের সেই আনন্দ

ঈদ মানে খুশি, আনন্দ। দীর্ঘ এক মাসের সংযম সাধনার রোজা পালনের পর সারা বিশ্বের মুসলমানরা ঈদের দিন আনন্দে মেতে ওঠে। এদিন সকালে ঈদের নামাজ আদায় করে মুসলিমরা। এরপর শুরু হয় ঈদের কোলাকুলি এবং হাত মেলানো। তারপর মিষ্টি মুখ। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা নতুন কাপড় পরে প্রজাপতির মতো এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করে। অবশ্য গরিব অসহায়দের চিত্রটা ভিন্ন! কিন্তু আজ থেকে তিন যুগ আগেও ঈদের দিনে সর্বত্র যে দৃশ্য চোখে পড়ত তা আর চোখে পড়ে না। এক টাকা ঈদ সালামি পাওয়ার আনন্দে এ সময়ের শিশুরা মেতে ওঠে না। দল বেঁধে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন কিংবা প্রতিবেশীদের বাড়িতে ছুটে যায় না তারা। বরং বসে থাকে ইন্টারনেট নিয়ে। ঈদের দিন বিকেলে আগে আয়োজন করা হতো নানা ধরনের খেলাধুলার। আজ আর সেইসবের কিছুই নেই।

মেলা আজও আছে, তবে প্রাণ নেই!

মেলা বাংলাদেশের মানুষের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। এদেশে প্রতি বছর পাঁচ হাজারের বেশি মেলা বসে। আবহমানকাল থেকে চৈত্রসংক্রান্তি থেকে শুরু করে ১২ মাসই মেলা আছে। আর একেক এলাকার মেলার বৈশিষ্ট্য একেক রকম। চৈত্রসংক্রান্তির মেলা কিশোরগঞ্জের গ্রামে যেমন হয়, ফরিদপুরে তার থেকে আলাদা। চৈত্রসংক্রান্তি যেমন আছে তেমনি শ্রাবণসংক্রান্তিও আছে। হয়তো শ্রাবণসংক্রান্তির মেলা সব জায়গায় হয় না। গবেষকদের ধারণা, বাংলায় নানাধরনের ধর্মীয় কৃত্যানুষ্ঠান ও উৎসবের সূত্র ধরেই মেলার উৎপত্তি হয়েছে। সেদিক দিয়ে বাংলাদেশের মেলার প্রাচীনত্ব হাজার বছরেরও অধিক পুরোনো। এদেশের প্রাচীন পর্যায়ের উৎসব ও কৃত্যানুষ্ঠানকেন্দ্রিক মেলাগুলোর মধ্যে প্রথমেই আসে জীবনধারণের আহার্য কৃষিশস্য এবং বিশেষ করে কৃষির সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত রোদ ও মেঘের কথা। প্রাচীন বাংলার মানুষ চাঁদ ও সূর্যকে ‘বুড়া-বুড়ি’ নামে যেখানে পূজা করেছে, সেখানে পূজা উৎসবে পূজারিরা সমবেত হতে থাকলে একসময় ধীরে ধীরে ‘বুড়া-বুড়ির মেলা’ প্রবর্তিত হয়। এর সঙ্গে আসে মেঘের জন্য বরুণ বা বারুণী। উল্লেখ্য, বুড়া-বুড়ির মেলাটি পরে সূর্য মেলা, সূর্য ঠাকুরের ব্রত, চৈত্রসংক্রান্তির ব্রতের মেলা, চড়ক মেলা, শিবের গাজনের মেলায় রূপ নিয়েছে। অন্যদিকে মেঘের দেবতা বরুণ-বারুণী স্নানের মেলা হিসেবে রূপ গ্রহণ করে। বাংলাদেশে প্রচলিত প্রতিটি মেলা আয়োজনের পেছনে কোনো না কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকে।

জরিপে জানা যায়, বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে রথযাত্রা উপলক্ষে ৬২টির মতো মেলা বসে। তার মধ্যে ঢাকার ধামরাইয়ের রথের মেলাটি খুবই প্রাচীন। সনাতন ধর্মীয় অনুষ্ঠান শারদীয় দুর্গোৎসবকে উপলক্ষ করেই এ দেশে সর্বোচ্চসংখ্যক মেলা বসে থাকে, যার সংখ্যা ৭৩টির অধিক। সর্বজনীন দুর্গাপূজা সনাতন ধর্ম সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ও বর্ণাঢ্য ধর্মীয় উৎসব। ফলে দুর্গোৎসব উপলক্ষে অনুষ্ঠিত মেলাগুলো ছড়িয়ে আছে সারা দেশে। মুসলমান সম্প্রদায়ের উৎসবকেন্দ্রিক মেলার মধ্যে মহররমের মেলাগুলোই অধিক বর্ণাঢ্য। শিয়া মতবাদী মুসলিমরা কারবালার মর্মান্তিক ঘটনাকে স্মরণ করে শোভাযাত্রা বা তাজিয়া মিছিল বের করে এবং মেলা বসে।

বলতে চাচ্ছি, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, বিভিন্ন সময়ে বর্তমানেও মেলা হচ্ছে। কিন্তু এমন একটা সময় ছিল যখন গ্রামীণ মানুষের অফুরন্ত আনন্দের উৎস ছিল মেলা। গ্রামীণ মেলায় গ্রাম বাংলার রূপ যেন সার্থকভাবে ফুটে উঠত। বলা যায়, লোক জীবন ও লোক সংস্কৃতির অন্তরঙ্গ পরিচয় মেলাতে সার্থকভাবে ফুটে উঠত। মেলায় গ্রামীণ মানুষের নতুন আত্মপ্রকাশ ঘটত। এই আত্মপ্রকাশের মধ্যে একটা সর্বজনীন রূপ থাকত। মেলায় আগতদের জন্য মনোরঞ্জনে নানা ব্যবস্থা থাকত। মেলা যে মিলনক্ষেত্র, তাই ধর্ম-বর্ণ ও সম্প্রদায় নির্বিশেষে মানুষের আনাগোনা। নাগরদোলা, লাঠি খেলা, পুতুল নাচ, যাত্রা, ম্যাজিক ও সার্কাস ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষ আনন্দ-ফুর্তিতে মেতে উঠত। কখনো সার্কাসের জোকার ও সঙের কৌতুকে হেসে লুটিয়ে পড়ত কেউ কেউ। কামার, কুমার, ছুতার, কৃষক, কাসারুর সাজানো পসরার বিকিকিনি চলত অবিরাম। নতুন নতুন নকশা ও কারুকাজের চাহিদা বাড়ত। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা লোক সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদান পূর্ণতা পেত। স্বল্প পুঁজির অবহেলিত পেশাজীবী যেমন কামার, কুমার ও তাঁতি তাদের তৈরি পণ্য সহজে বিকিকিনি করতে পারত। এককথায়, নানা উৎসবের ছিল মেলার দিনগুলো।

কিন্তু কালের বিবর্তনে সব কিছু হারিয়ে যাচ্ছে। সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোও এই মেলাকে কেন্দ্র করে জারি-সারি, ভাটিয়ালী, বাউল গানের আসর বসাত। বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন মেলা বসত। মেলা বসত সাধারণত স্কুল-কলেজের মাঠ, গ্রামের মন্দির, নদীর তীর বা বড় বৃক্ষের নিচে। বিভিন্ন উৎসবকে সামনে রেখে মেলার আয়োজন করা হতো। এখন বসন্তকে কেন্দ্র করে শহরে আয়োজন হয় অনেক উৎসব। গ্রাম থেকে হারিয়ে গেছে এসব উৎসব। গ্রামে এখন আর বাসন্তি রঙের শাড়ি পরে, তাজা লাল, হলুদ গাঁদা ফুলের মালা খোঁপায় বা বেণীতে পরে মেঠো পথে তরুণীদের ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় না। ছেলেমেয়েরা বায়না করে না ‘মেলায় যাব’ বলে। অথচ এক সময় সবাই মিলে উপভোগ করত এই মেলা। হরেক রকম খাবার-দাবারের ব্যবস্থা থাকত মেলায়। বাড়িতে বাড়িতে আত্মীয়স্বজনের সমাগম থাকত।

মানিকগঞ্জ জেলার ঘিওরের রাধা চক্করের মেলা ৫০০ বছরের পুরোনো। কথিত আছে, বৈশাখ মাসে আউশ-আমন ধানের চাষ দেওয়ার জন্য মাটিতে যেন উর্বরতা থাকে সেজন্য বৃষ্টির প্রার্থনা করা হতো; আর সেই সময়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা রাধা-গোবিন্দ বিগ্রহ স্থাপন করেন। শুরু করেন রাধা চক্করের মেলা। প্রতি বছর বৈশাখের দ্বিতীয় বৃহস্পতিবার শুরু হয়ে মেলা চলত এক সপ্তাহ। মেলায় পূজা অর্চনার পাশাপাশি ছিল নাগরদোলায় চড়া ও সার্কাস দেখার ব্যবস্থা। ছিল স্থানীয়ভাবে তৈরি মিষ্টান্ন-আমেত্তি, জিলাপি, চমচম, রসগোল্লা, রাজভোগ, কালোজাম, দই, ঘি ও সন্দেশের দোকান। গ্রামীণ কারুশিল্পীদের তৈরি অসংখ্য উপকরণ, হরেক রকমের খাদ্যসম্ভার, চিনির সাজ, কদমা, বাতাসা, বিন্নি খই, মুড়ি, ভ্রাম্যমাণ দোকানিদের নানারকমের পণ্যসামগ্রী মেলায় উৎসবের আবহ ছড়িয়ে দিত।

পিরোজপুরের ঐতিহ্যবাহী নীলমেলাও হারিয়ে গেছে। মূলত বৈশাখী মেলাই ওই অঞ্চলে নীলমেলা নামে পরিচিত ছিল। গ্রামীণ এই উৎসবকে আরো রঙিন করে তুলতে মেলা, গৃহস্থ বাড়ির উঠোন কিংবা হাট-বাজারে নাচত নীল নাচের দল। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় এ দলগুলো হারিয়ে গেছে। নীল নাচও নেই, নেই নীলমেলাও। জানা যায়, প্রতিটি নীল নাচের দলে ১০-১২ জন রাধা, কৃষ্ণ, শিব, পার্বতী, নারদসহ সাধু পাগল (ভাংরা) সেজে সকাল থেকে মধ্যরাত অবধি নীল নাচ গান পরিবেশন করত। চৈত্রসংক্রান্তি মেলার শেষ দিনে নীল পূজা শেষ হতো এ নীল নাচের মধ্য দিয়ে। নীল পূজা মূলত হিন্দু ধর্মীয় উৎসব হলেও চৈত্রসংক্রান্তির উৎসবের সঙ্গে মিলে তা সর্বজনীন এক উৎসবে পরিণত হয়।

সন্ন্যাস পূজা উপলক্ষে একসময় পোড়াদহে বসত ‘সন্ন্যাস মেলা’। বর্তমানে এর নাম পোড়াদহের মেলা। এই মেলাটি মূলত মাছের মেলা। মেলায় বড় বড় মাছ ওঠে। আর মেলার সময় ওই এলাকার জামাইরা বেড়াতে আসেন, আর এই জামাইরাই মাছের বড় ক্রেতা। এরা পছন্দসই মাছ কিনে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি যান। এই মেলা ২০০ বছরের বেশি পুরোনো। আগে বিশাল আকৃতির মাছই ছিল এই মেলার প্রধান আকর্ষণ। কিন্তু এখন আর আগের মতো বড় মাছ আসে না। আগের মতো জৌলুসও নাই মেলার। এই মেলা শেষ হওয়ার পরই হয় বউমেলা। নারীরা মাছের মেলায় যেতে পারেন না। তারা বউমেলায় যান।

বাংলার এই মেলাগুলো যেমন আমাদের সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে তেমনি এই মেলাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় পণ্যের পসরা বসে। গ্রামীণ জনপদে নামে উৎসবের ঢল। এর একটি বড় অর্থনৈতিক দিকও আছে। বাংলাদেশে এমন মেলাও হয় যেখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব কিছু পাওয়া যায়। কিন্তু ইদানীং শহুরে মেলার নতুন আয়োজন আসছে। অনেক মেলার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান। বলা যায়, বৈচিত্র্য আর নানা আয়োজন এইসব মেলাকে দিয়েছে বহুমাত্রিকতা। কিন্তু তারপরও হারাতে বসা গ্রামীণ মেলার সেই জৌলুস যে নেই।

হায় বায়োস্কোপ!

এক সময়কার গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী বিনোদন ছিল বায়োস্কোপ দেখা। এটি এখন আর আগের মতো চোখে পড়ে না। আগে বিভিন্ন হাট-বাজারে দর্শকদের বায়োস্কোপ দেখিয়ে ৩০ থেকে ৪০ টাকা পর্যন্ত আয় হতো। বর্তমানে দিনের খরচ বাদে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত আয় করা যায় বায়োস্কোপ দেখিয়ে। আগে ৫০ পয়সায় জনপ্রতি বায়োস্কোপ দেখালেও এখন তা ১০ টাকায় উত্তীর্ণ হয়েছে।

কোথায় হারিয়ে গেল ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা!

আজকের বৃদ্ধরা শৈশবের খেলাধুলা না দেখতে পেয়ে ভুলে গেছেন অনেক খেলার নাম। এক সময় গ্রামের শিশু ও যুবকরা পড়াশোনার পাশাপাশি খোলা মাঠে দলবেঁধে খেলত এসব খেলা। শিশু ও যুবকদের মনে জড়িয়ে থাকত শৈশবের দুরন্তপনা। কিন্তু আধুনিক সভ্যতার ছোঁয়া ও কালের বিবর্তনে হাজার বছরের ইতিহাস থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে এসব খেলাধুলা ও খেলার মাঠ। অথচ এসব খেলা দেখার জন্য এক সময় ছেলে-বুড়ো সবাই ব্যাকুল হয়ে থাকত।

এসব খেলাধুলা এক সময় আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতির ঐতিহ্য বহন করত। বর্তমানে অধিকাংশ গ্রামীণ খেলা বিলুপ্তির পথে। গ্রাম বাংলার খেলাধুলার মধ্যে যেসব খেলা হারিয়ে গেছে তাদের মধ্যে হা-ডু-ডু, কাবাডি, গোল্লাছুট, হাঁড়িভাঙ্গা, বুদ্ধিমন্তর, কাঠি ছোঁয়া, দড়ি লাফানো, দড়ি টানাটানি, চেয়ার সেটিং, রুমাল চুরি, কানামাছি, নৌকাবাইচ, ঘোড়দৌড়, আগডুম বাগডুম, কপাল টোকা, বউরানী, ছক্কা, লাঠি খেলা, রাম সাম যদু মদু, চোর-ডাকাত, মার্বেল, সাতচাড়া, ষাঁড়ের লড়াই, মোরগ লড়াই, চিল মোরগ উল্লেখযোগ্য। ঐতিহ্যবাহী হারিয়ে যাওয়া এসব খেলাধুলা এখন আর তেমন কোথাও চোখে পড়ে না।

লেখক: কবি ও সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

ফিচার এর সর্বশেষ

যে পাঁচ সমস্যায় আক্রান্তরা গুড় খাওয়ার আগে একবার ভাবুন, নইলে...

সাজেদুর রহমান শাফায়েতের স্বপ্ন পৃথিবী ঘুরে দেখা

খাওয়ার পরপরই চা পান উপকার না ক্ষতি? কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা

জ্বরের মধ্যে যে পাঁচ খাবার খেলেই বিপদ! জানুন, সাবধান হোন

গরমে হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে ডায়াবেটিস রোগীদের! সুস্থ থাকবেন যেভাবে

মুখে দুর্গন্ধের কারণে হা করতেও অস্বস্তি লাগে? সমাধান কী জানুন

লিভার ভালো রাখে লাউ! ওজন এবং উচ্চ রক্তচাপও থাকে নিয়ন্ত্রণে

কিডনি ভালো রাখে আমের পাতা! উচ্চ রক্তচাপও থাকে নিয়ন্ত্রণে

ইফতার ও সাহরিতে বাহারি আয়োজন ধানমন্ডির দ্য ফরেস্ট লাউঞ্জে

বারবার ফোটানো চা খেলেই মারাত্মক বিপদ! বাঁচতে হলে জানুন

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :