কত লক্ষ কোটি ঝিনুকে একটা মুক্তা পাওয়া যায়?

প্রকাশ | ০৯ জুন ২০১৯, ১৪:৪৫ | আপডেট: ০৯ জুন ২০১৯, ১৭:২০

সানবীর রূপল
লেখকের সঙ্গে সময় টেলিভিশনের প্রয়াত বার্তা সম্পাদক জাকারিয়া মুক্তা (বায়ে)

১. ২০১০ এর ডিসেম্বরে সময় টেলিভিশনে যোগ দেয়ার পর ২০১১/২০১২র ডিসেম্বরে একটা বড় রকম ঝামেলা শুরু হয়।আমি তখন ন্যাশনাল ডেস্কে কাজ করি। মুক্তা ভাই তখন সেই ডেস্ক ইনর্চাজ। হাউকাউ করে গরম রাখা নিউজরুমে তিনি বড্ড চুপচাপ স্নিগ্ধ হাসির মানুষ। নানা ঝঞ্ঝার এক পর্যায়ে অভিমান করে অফিসে যাওয়া বন্ধ করে দিলাম। অভিমানের সঙ্গী বন্ধু নীপা রাজকুমারী। বেশ কয়দিন কেটে গেলো। আমরা দুইজন দলছুট। নিজেরা কথা বলি সবরকম খোঁজ খবর আসে আমাদের কাছে। এখানে চাকরি করবো না বলে সিদ্ধান্ত মোটামুটি হয়েছে। তবু মানসিক একটা অস্থিরতা আর টান অনুভব করি আতুর ঘরের প্রতিষ্ঠান সময়ের মায়ায়। এক রাতে মুক্তা ভাই ফোন করলেন। রাজ্যের সব অভিমান অভিযোগ শুনলেন সব। বললেন, রূপল আপনি কাল আসবেন আমি কথা বলবো।আমি দায়িত্ব নিচ্ছি। বললেন, আপনি না আসলে আমার ভালো লাগবে না। মুক্তাভাই আপনার কথা উপেক্ষা করার শক্তি আমার ছিলো না। আপনার একটা শব্দ উপেক্ষা করার ক্ষমতা কখনো হয়নি। সারা দুনিয়ার মানচিত্র আপনার মাথায় ছিলো। চিৎকার চেঁচামেচি ছাড়া কতশত ভুল আপনি হাসিমুখে শুধরে দিলেন। অন্য কারো মতো চিৎকার করে বোঝাতে হয়নি আপনি জ্ঞানী, বিনয়ী, পরিশ্রমী, কুরাজনীতিহীন, শ্রদ্ধার পাত্র। আমি সেই অফিসেই কাজ করছি এতোদিন।কিন্তু আপনি তো চলে গেলেন!!

২. সময়ের সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে একটা সমিতি করলাম। অনেকদিন পর যখন সমিতি মুখ থুবড়ে পড়ার দশা তখন আপনি যোগ দিলেন সমিতিতে। আমিসহ কয়েকজন সিদ্ধান্ত নিলাম বের হয়ে যাবো।আপনি ডেকে সবকিছু শুনলেন। বললেন, রূপল আমি চাই আপনি সমিতিতে থাকেন। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে আমরা নতুন উদ্যমে শুরু করবো। আমি শুধু বললাম, আপনি থাকলেই কেবল আমি থাকবো আমার কোন কথা নেই। আমি আছি।সমিতিরও অনেকটা খড়া কেটেছে।কিন্তু আপনি তো থাকলেন না মুক্তাভাই!

৩. ২০১৭ ফেব্রুয়ারিতে এক সন্ধ্যায় বইমেলায় দেখা হলো মুক্তা ভাইয়ের সঙ্গে। আমি ঘুরছি গ্রামের বাচ্চাদের জন্য একটা লাইব্রেরি করবো সেজন্য বই কিনতে হবে।সাথে পরিচিত লেখকের বই কিনে নিবো।পছন্দের বইও কিনবো কিছু। মুক্তা ভাইয়ের সঙ্গে হাঁটছি সঙ্গে যোগ দিলেন আর এক সহকর্মী শান্তনু চৌধুরী।দাদার একটা বই কেনার ফাঁকে আমি বাচ্চাদের জন্য বই দেখছি। মুক্তা ভাইয়ের প্রশ্ন, বাচ্চাদের বই কেন? বললাম,গ্রামের বাচ্চাদের জন্য একটা লাইব্রেরি করতে চাই। চট করে বললেন,আপনার লাইব্রেরির জন্য প্রথম বই আমি কিনে দিতে চাই। নিজেও বই বাছাই করলেন। সে ভালো লাগা আপনাকে বোঝানো যাবে না ভাই। আপনার কোন সন্তান নেই কে বলেছে? কত ছেলে মেয়ে আপনার স্বংস্পর্শে আপনার সন্তানের মতো হয়ে গেছে আপনি জানেন?

৪. সময়ের পাশেই কয়েকজন মিলে একটা রেস্টুরেন্ট শুরু করলেন। শুরুতে আমরা প্রায়দিন আড্ডা দিতাম। একদিন দুপুরে আমি একা গেলাম খেতে। আপনি এসে পাশে বসলেন। তারপর ঘন্টা পেরুলো আপনার সঙ্গে। অফিস, ব্যক্তিগত জীবন, ইচ্ছা অনিচ্ছা, ভালো লাগা মন্দ লাগা, নতুন বিজনেসের খুঁটিনাটি। কী সাবলীল বললেন সব কিছু! মনে হলো সুখ দুঃখ পাওয়া না পাওয়া কত সহজ স্ক্রিপ্টের মতো। বেশি লোককে আমি পা থেকে মাথা পর্যন্ত তাদের অগোচরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খেয়াল করি।মুক্তা ভাই আপনি তাদের একজন ছিলেন। লজ্জা পেয়ে বলেছিলাম, আপনার চেহারার সঙ্গে আমার বাবার চেহারা স্বভাবের অনেক মিল। আপনি স্বভাবসুলভ হেসে বললেন, একজন আরেক জনের সঙ্গে অনেক কিছুতেই মিলে যায়।

৫. হাসপাতালের বেডে আপনাকে সিসিইউতে দেখতে গেলাম। অক্সিজেন মাস্ক খুলে বললেন, রূপল এখন ভালো আছি।তেমন কোন সমস্যা হচ্ছে না। তারপর অনেকক্ষণ কথা। আপনার মানসিক শক্তি ছিলো প্রবল। শরীরিক সামর্থ্য উথরে যেতে চাইতেন মানসিক শক্তি দিয়ে। সেদিন রাতেই আপনি চলে গেলেন আইসিইউতে। খবর পেয়ে মধ্যরাতে সজল মিত্র রিচার্ডকে নিয়ে আবার হাসপাতালে। আরো অনেকেই এরইমধ্যে হাসপাতালের বারান্দায়। রাত বাড়লো আপনি চলে গেলেন কোমায়। ফিরবেন কি ফিরবেন না জানিনা। সেদিন ধরেই নিয়েছিলাম আর হয়তো ফিরবেন না। তবে সে যাত্রায় বেঁচে ফিরলেন।এবার আর ফিরলেন না।রাশেদ লিমনকে দেখেছি সব সময় আপনার জন্য যেভাবে ছুটেছে তা ভালোবাসা ছাড়া কিছু না। আমরা আপনাকে সত্যি ভালোবেসেছি। হয়তো আপনার মতো নির্লোভ, অহংকারহীন, সাদা মনে পারিনি। স্টিফেন হকিং এর মতো করে প্রতিষ্ঠান আপনাকে হয়তো রাখতে পারেনি। তবে আপনি লক্ষ ঝিনুকের একটা মুক্তা আমাদের চিনিয়ে দিয়ে গেলেন ভাই।আপনার বাবা মা হয়তো জেনেছিলেন বলেই নাম রেখেছেন 'মুক্তা'। আপনাকে না দেখলে বুঝতাম না ভালো মানুষ কেমন হয়। নষ্টের পৃথিবীতে আপনি আলাদা জাতের। আরো বহুকথা জমা পড়ে আছে।অনেকগুলো সময়। আপনি ভালো থাকবেন অনন্তকাল। আমাকে ক্ষমা করবেন।

লেখক:সিনিয়র রিপোর্টার,সময় টেলিভিশন