১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে চাপে অর্থনীতি: সিপিডি

প্রকাশ | ১১ জুন ২০১৯, ১৭:৫৪ | আপডেট: ১১ জুন ২০১৯, ১৮:৫১

অর্থনৈতিক প্রতিবেদক

আওয়ামী লীগ সরকারের টানা ১০ বছরের শাসনামলে বর্তমানে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সবচেয়ে বেশি চাপে বলে দাবি করেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ-সিপিডি।

মঙ্গলবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে এই মতামত তুলে ধরেন সিপিডির সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তার এই মূল্যায়নের পেছনে তিনটি প্রসঙ্গ তুলে ধরেছেন তিনি। এর একটি হলো অপর্যাপ্ত বিনিয়োগ, বৈদেশিক লেনদেনে ঘাটতি এবং ব্যাংক খাতে দুর্বলতা।

আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটকে সামনে রেখে অর্থনীতির পর্যালোচনা তুলে ধরতেই গণমাধ্যমকর্মীদের আমন্ত্রণ জানায় সংস্থাটি।

দেবপ্রিয়র মতে, গত ১০ বছরে অর্থনৈতিক অগ্রগতি ‘সীমান্ত রেখায়’ এসে পৌঁছেছে। প্রবৃদ্ধির হার ও মাথাপিছু আয়ে ভালো থাকলেও ব্যক্তি বিনিয়োগ, শিল্পায়ন, রপ্তানির ক্ষেত্রে, মাতৃ মৃত্যুর হার বা সামাজিক উন্নয়নে আশানুরূপ উন্নতি হচ্ছে না। প্রবৃদ্ধির সঙ্গে উন্নয়নের অন্যান্য সূচকগুলো বেমানান।

সিপিডি ফেলো বলেন, ‘বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা অর্থনীতির একটি শক্তি ছিল। সেই শক্তিতে চিড় ধরেছে, দুর্বলতা দেখা দিয়েছে। কর আহরণে অপারগতা এখন বাংলাদেশের উন্নয়নের একটা অমোচনীয় প্রতিবন্ধকতায় পরিণত হয়েছে।’

এই পরিস্থিতির উত্তরণ না হলে উন্নয়নের অভিলাস পূরণে বিনিয়োগের সুযোগ কম হবে। অন্য উৎস থেকে বিনিয়োগ করার চেষ্টা হলে সামষ্টিক অর্থনীতির দুর্বল পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে বলেও মনে করেন সিপিডি ফেলো।

কর, উন্নয়ন অর্থায়ন, বাস্তবায়ন এবং ঘাটতির উপর চাপগুলো দৃশ্যমান হচ্ছে বলেও মনে করে সিপিডি। দেবপ্রিয় বলছেন, সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝোঁকাই এর প্রমাণ। এর ফলে সরকারের দায় দেনা বাড়ছে। অপরদিকে মেয়াদি সুদে বিদেশি অনুদান ও ঋণ ব্যবহার করা যাচ্ছে না। আবার উচ্চসুদে বিদেশি ঋণ অনেক ক্ষেত্রে আসছে অসচ্ছভাবে।

দেবপ্রিয় দ্বিতীয় যে দিকটির কথা উল্লেখ করেন, সেটি হলো বৈদেশিক লেনদেনের ক্ষেত্রে চাপ। এটি এর আগে দৃশ্যমান হয়নি। প্রবাসী আয় আর রপ্তানিতে ভালো হলেও আমদানি বাড়ায় লেনদেনের ঘাটতি বাড়ছে। বর্তমানে রিজার্ভ পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান, যা কয়েকদিন আগেও ছিল আট মাসের।

সরকার ডলার বিক্রি করে টাকাকে স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করছে উল্লেখ করে সিপিডি একে অযৌক্তিক বলেছে। দেবপ্রিয়ের পরামর্শ টাকার অবমূল্যায়নের। তার দাবি, টাকার মান এখন তিন শতাংশ বেশি।  প্রতিযোগী দেশ ভারত, চীনের মূদ্রার মান এবার কমবে বলেও মনে করেন তিনি।

ব্যাংক খাত নিয়ে সরকারের বর্তমান আমলের উদ্যোগগুলো আরো ক্ষতিকর হয়েছে বলেও মনে করেন দেবপ্রিয়। বলেন, ‘আমরা শুনেছি একটি টাকাও নাকি খেলাপি ঋণ বাড়বে না। অথচ বেড়েছে ১৭ হাজার কোটি টাকা।’

কিছু ভালো গ্রহীতাও বেকায়দায় পড়ে গেছেন জানিয়ে সিপিডি ফেলো বলেন, যদি প্রকৃত খেলাপিদের শাস্তি দেওয়া না যায়, তাহলে এর সমাধান হবে না। ব্যাংকিং খাতের উপর আস্থার সংকট সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দেবে।

ঋণের সুদের হার বেঁধে না দিয়ে বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শও দিয়েছেন দেবপ্রিয়। বলেন, ‘হুকুম দিয়ে সুদের হার নিচের দিকে কমিয়ে দেওয়া এবং ব্যাংকিং খাতের সামগ্রিক সমাধান না করে এটা ফলদায়ক হবে না।’

ফসলের দাম নিয়ে বিপাকে পড়া কৃষকের পাশে দাঁড়াতে কার্ডধারী চাষিকে পাঁচ হাজার টাকা করে প্রণোদনা দেওয়ার পরামর্শও দেন দেবপ্রিয়। বলেন, ‘ কৃষকদের প্রতি অন্যায় আচরণ করা হয়েছে। শিল্প ও কৃষির মধ্যে যে বাণিজ্য স্বত্ব থাকে, তা কৃষকের বিপরীতে গেছে। এটা যদি অব্যাহত থাকে আগামীতে বাংলাদেশে কৃষকদের টিকে থাকা খুবই কঠিন হবে।’

‘কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া উচিত হবে না’

প্রতিবার বাজেটে অপ্রদর্শিত আয়কে বৈধ করার সুযোগ দেওয়া হলেও এবার তাতে রাশ টানার পরামর্শ সিপিডির। দেবপ্রিয় বলেন, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হলে তা আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার ব্যত্যয় ঘটবে।

বন্ডমার্কেটের কার্যক্রম বাড়ানোর পরামর্শ

সংবাদ সম্মেলনে পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতার জন্য বন্ডমার্কেটের কার্যক্রম বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন সিপিডির ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক খন্দকার গোলাম  মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, ‘পুঁজিবাজারে যেগুলো রয়েছে সেগুলো সরকারি বন্ড। সেগুলো খুব বেশি সক্রিয় নয়। বেসরকারি ও সরকারি বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে এই মার্কেটকে সক্রিয় করার খুবই প্রয়োজন।’

বাজেট নিয়ে সুপারিশ

সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রবন্ধে সিপিডির সিনিয়র রিসার্স  ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান আগামী অর্থবছরের বাজেটের জন্য ১০টি সুপারিশ তুলে ধরেন। এর মধ্যে রয়েছে- রাজস্ব আহরণের সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা; সরকারি ব্যয় সুশৃঙ্খলভাবে করা, কর ছাড়ের হিসাব সুস্পষ্ট করা, সঞ্চয়পত্রের সুদের হার সমন্বয় এবং সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ কমিয়ে আনা; ব্যাংক কমিশন গঠন ও সুদের হার বাজার ব্যবস্থাপনার ওপর ছেড়ে দেওয়া; পুঁজিবাজারের সুশাসন প্রতিষ্ঠায় জোর দেওয়া, সরকারি প্রতিষ্ঠান নিরীক্ষা করে সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া; সামাজিক খাতে বরাদ্দ বাড়ানো এবং টাকার অবমূল্যায়ন করা।