‘তবুও লিখে যাব’

প্রকাশ | ১৩ জুন ২০১৯, ১৬:৩৪ | আপডেট: ১৪ জুন ২০১৯, ০৯:৩৪

আরিফুর রহমান দোলন

ইদানীং মুঠোফোনের ক্ষুদে বার্তায়, ফেসবুকের ইনবক্সে নতুন নতুন টেক্সট পাচ্ছি। বিশেষত, অনেক দিন পর গত কয়েক দিনে টানা লেখালেখির কারণে। সম্প্রতি অবসরে যাওয়া সরকারের একজন সচিব মুঠোফোনে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েছেন। ‘ওয়েলডান ব্রাদার, কিপ ইট আপ’। ‘পুলিশে কীসের প্রতীক ডিআইজি মিজান?’ এই লেখাটির বিষয়ে ওই সাবেক সচিবের মন্তব্য, ‘ভেতরে ভেতরে এমন অসংখ্য ঘটনাই ঘটছে। কত নজরে আনবেন?’ প্রায় একই ধরনের প্রশ্ন করেছেন সুহৃদ এক সাংবাদিক, ফেসবুক মেসেঞ্জারে।

সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রবাসী এক ছোট ভাই ‘মমতাময়ী শেখ হাসিনা’, ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আপনাকে বলছি’ লেখনীর জন্য আবেগময় এক বার্তা পাঠিয়েছেন ফেসবুক মেসেঞ্জারে, যা খুবই উৎসাহব্যঞ্জক। সুহৃদ একজন জেলা প্রশাসক। মুঠোফোনে বললেন, ‘লেখালেখিই আপনার আসল জায়গা। চালিয়ে যান।’ তবে সিনিয়র সহকারী এক সচিবের কণ্ঠে হতাশার সুর। হোয়াটসঅ্যাপ বার্তায় তিনি বললেন ‘চারিদিকে কত ইস্যু, কয়টা নিয়ে লিখবেন? কে আমলে নেবে?’

না লিখতে পারার যন্ত্রণা আমার ভেতরে অনেক দিনের। গত কয়েক বছর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সময় দেওয়া, অন্যান্য পেশাগত কাজে সময় দেওয়ার কারণে না লেখাটা প্রায় অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। এ নিয়ে অস্বস্তি ছিল আমার নিজেরই। ঘনিষ্ঠজন, পরিচিতেরা নিয়মিতই প্রশ্ন করেন লিখি না কেন? আসলেই তো। চারদিকে এতো ইস্যু, লেখালেখির এতো বিষয়। আর কে বলল যে লিখলে কাজ হয় না?

ঈদের দুই দিন আগে খুলনা ছিলাম কয়েক ঘণ্টার জন্য। সামাজিক গণমাধ্যমে মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়লো ভোক্তা অধিদপ্তরের উপপরিচালক মঞ্জুর মোহাম্মদ শাহরিয়ারকে বদলি করা হয়েছে খুলনায়। যিনি কি-না আগের দিনই দেশব্যাপী প্রশংসিত হয়েছেন রাজধানীর উত্তরায় আড়ং-এর অনৈতিক কর্মকাণ্ডে কড়া পদক্ষেপ নেওয়ায়। ও-মা! কয়েক ঘণ্টা যেতে না যেতেই পিছু হটল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। বদলি আদেশ স্থগিত করার কথা জানান দিল।

খোঁজ নিয়ে জানা গেল, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেছেন। বিদেশে তখন প্রধানমন্ত্রী। প্রশাসনের একেবারে কনিষ্ঠ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তার বদলির খবর রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নির্বাহীর কাছে গেল কীভাবে? এটি তো লেখালেখিরই ফল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হয়েছে তা নানা মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছেছে। সঠিক পদক্ষেপ নিতে এক সেকেন্ডও দেরি করেননি তিনি।

সিনিয়র সহকারী সচিব বন্ধুবরকে এই ঘটনা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলি, লেখালেখিতে যে কাজ হয় তার প্রমাণ তো পেলেন। ছোট্ট জবাব প্রশাসনের বন্ধুটির। একা নয়, সবাই লিখুন।

সবাই লিখুক কিংবা একজন। সেটি কি বিষয়। আমাদের অত্যন্ত সংবেদনশীল প্রধানমন্ত্রী তো লেখালেখি আমলে নেন। ভোক্তা অধিদপ্তরের উপপরিচালকের বদলি স্থগিতই শুধু কি করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী! জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে যেভাবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার কাজের প্রশংসা করেছেন তা প্রশাসনের সবার জন্য অত্যন্ত উৎসাহব্যঞ্জক। এর নেপথ্যে কিছুটা হলেও তো সেই লেখালেখির হাত আছে। এটা কি অস্বীকার করা যাবে?

তবে এ কথাও নির্দ্বিধায় স্বীকার করতে চাই যে, সমালোচনামূলক লেখায় আমরা যেমন সিদ্ধহস্ত, প্রশংসা করে লেখার ক্ষেত্রে খুব হিসেবি। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন সময়ে যে ইতিবাচক কাজগুলো করেছেন, যার ফলাফলগুলো খুবই দৃশ্যমান হয়েছে, তার প্রচারে কি লেখালেখির সঙ্গে যুক্তরা শতভাগ উদার ছিল? এ প্রশ্নও বিভিন্ন সময় শুনতে হয়। প্রশ্নটি যথার্থ। এর সদুত্তর দিতে পারিনি কখনো। তবে নিজে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, গঠনমূলক সমালোচনা যেমন করব, তেমনি সরকারের বিভিন্ন সংস্থার ইতিবাচক পদক্ষেপের প্রশংসাও নিয়মিত করব।

ঘুষদাতা-গ্রহিতা দুজনকেই ধরা হবে। জাতীয় সংসদে গত বুধবার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বিষয়টি পরিষ্কার করে দিয়ে আরও একবার নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। এর প্রশংসা করতে চাই। বিতর্কিত ডিআইজি মিজানুর রহমানের তথাকথিত ঘুষ দেওয়ার বিষয়টি সংসদে পাশ কাটিয়েও যেতে পারতেন প্রধানমন্ত্রী। সেটা তিনি করেননি। এ ক্ষেত্রে আরও একবার প্রশংসা করব দুদক চেয়ারম্যানকে। এখন পর্যন্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ সদর দপ্তর যেমন বিতর্কিত ডিআইজি মিজানের বিষয়ে কার্যত ধীরে চলো নীতি নিয়ে এগোচ্ছে, নানা অজুহাত দিয়ে তো একই কাজ করতে পারত দুদকও। ‘বিষয়টি তদন্তাধীন, খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা’ এমন কাজ না করে অভিযোগ ওঠার সাথে সাথে সংশ্লিষ্ট পরিচালককে সাময়িক বরখাস্ত করে তার সদিচ্ছার প্রমাণ দিয়েছেন দুদক চেয়ারম্যান।

একটা খটকা মনে থেকেই যাচ্ছে যে, সংশ্লিষ্ট দুদক কর্মকর্তা যদি তথাকথিত ঘুষ নিয়ে থাকবেন ডিআইজি মিজানের কাছ থেকে, তাহলে তিনি যে অনুসন্ধান প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন তা এত তথ্যসমৃদ্ধ ও কার্যত নিখুঁত হয় কীভাবে? দু-একটি গণমাধ্যমে অনুসন্ধান প্রতিবেদনের যে সারাংশ বেরিয়েছে তা যদি সঠিক হয়ে থাকে তাহলে অনুসন্ধান কর্মকর্তা খন্দকার এনামুল বাছির ডিআইজি মিজানকে নিয়ে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার যে অভিযোগ এনেছেন, নিরপেক্ষ আরেকটি সংস্থা দিয়ে এর তদন্তও হওয়া উচিত।

দুদক এবং পুলিশে এনামুল বাছির ও মিজানুর রহমানকে নিয়ে কী পারসেপশন (ধারণা) সেটিও প্রকৃতভাবে পৃথক সংস্থার তদন্তের মাধ্যমে প্রকাশ্যে আসা দরকার।

সাম্প্রতিককালে লেখালেখির এমন অসংখ্য বিষয়ই উল্লেখ করা যায়। দুর্ধর্ষ জঙ্গি গ্রেপ্তারেও সিদ্ধহস্ত পুলিশ বাহিনী। সেই পুলিশ ফেনীর সোনাগাজীর চরম বিতর্কিত ওসি মোয়াজ্জেমকে খুঁজে পাচ্ছে না। এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? আমরা যারা গণমাধ্যমের কর্মী তাদের কাছে এটা কি অনুসন্ধানের কোনো বিষয় নয়? আসলেই তো প্রতিদিন এমন কত অসংগতি আর অব্যবস্থা আমাদের চারপাশে তৈরি হচ্ছে। কমছে না, উল্টো বাড়ছে। পত্রিকার খবরে দেখলাম, রয়টার্স খবর করেছে ’৬৪ বাংলাদেশি সাগরে ভাসছেন ১২ দিন ধরে’। মানব পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে উন্নত জীবনের আশায় যারা এভাবে মৃত্যুর কাছাকাছি পৌঁছে যান তাদের জন্য আমরা কি মানবিক হব না? অনেক অনেক অসংগতি এভাবে তুলে ধরতে ইচ্ছে করে।

পত্রিকার শিরোনাম ‘বাঘায় ঘুষ না পেয়ে দিনমজুরকে পেটালেন এএসআই’’। ‘ফুটপাত দখলে, পথচারী রাস্তায়’। ‘ধর্ষণে বাধা দেওয়ায় হত্যা করা হয় তরুণীকে’। ‘খেলাপি ঋণের অর্ধেকই পাঁচ ব্যাংকে’। ‘গাজীপুর পোশাক শ্রমিককে গণধর্ষণ’। ‘ঈদযাত্রায় দুর্ঘটনায় নিহত ২৪৭ জন, আহত ৬৬৪’। ‘পূর্বধলায় এমপি বেলালের বিরুদ্ধে মামলার নির্দেশ ইসির’। ‘হাসপাতালে পলেস্তারা খসে রক্তাক্ত ৫ শিশু’। প্রতিদিন পত্রিকার পাতা ওল্টালে এমন অনেক অসংগতি আর অনিয়মের খবর পাওয়া যায়।

বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা বিশ্বের অনেক দেশের কাছেই এখন অনুকরণীয়। বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে। খোদ বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ঢাকা সফরে এসে বাংলাদেশের ক্রমাগত এগিয়ে যাওয়ার এই ধারাবাহিকতার প্রশংসা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসা হয়েছে। এসব হলে আমরা খুশি হই। গর্বে বুক ভরে ওঠে। বাংলাদেশের প্রশংসার চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে? 

কিন্তু আমাদের অগ্রগতির বিপরীতে কোনো খবর যখন ব্শ্বি মিডিয়াতে হয়? শান্তি সূচকে অবনতি হয়েছে বাংলাদেশের। বাংলাদেশের গণমাধ্যমে এই খবর যখন বেরিয়েছে, তেমনি বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমেও এ খবর এসেছে। শান্তি সূচকে ১৬৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০১তম। গত বছর বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৯৩তম। যে বিচারেই এই সূচক নির্ধারণ করা হয়ে থাকুক না কেন, আমরা ইতিবাচক খবর হতে চাই বিশ্বে। আর এ জন্য আমাদের সবাইকে একসাথে, একযোগে কাজ করতে হবে। একমাত্র দেশপ্রেমই আমাদের একাট্টা করতে পারে। আমরা নিশ্চয়ই দেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তির প্রশ্নে একাট্টা হতে পারব। সেখানে গণমাধ্যমেরও বিরাট ভূমিকা আছে।

সংবাদপত্র মালিকদের অন্যতম সংগঠন নোয়াব একটি বিবৃতি দিয়েছে। বিভিন্ন পত্রিকায় একই শিরোনামে ছাপা হয়েছে নোয়াবের বিবৃতি। নবম সংবাদপত্র ওয়েজ বোর্ডের সুপারিশ কতটা বাস্তব? বিবৃতির মূল প্রতিপাদ্য বিষয়ই হলো নবম সংবাদপত্র ওয়েজবোর্ডের সুপারিশে যা বলা হয়েছে তা আসলে বাস্তবসম্মত নয়। নোয়াব বিবৃতি দিয়ে বলছে, গুটিকয়েক পত্রিকা ছাড়া অন্যরা অষ্টম মজুরি বোর্ড বাস্তবায়ন করতে পারেনি। এটাই হয়তো সত্য। কিন্তু নোয়াবের সদস্য ও সদস্য নয় এমন অনেক সংবাদপত্র ডিএফপিতে দেওয়া অঙ্গীকারনামায় বলছেন তারা অষ্টম ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়ন করছেন। বিষয়টি আমলে নিয়ে ডিএফপিও ওই সব সংবাদপত্রকে সরকার নির্ধারিত বিজ্ঞাপনের সর্বোচ্চ হার দিচ্ছে। অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও দিচ্ছে। আর এখন আবার অনেকেই অষ্টম ওয়েজ বোর্ড দিচ্ছে না। প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়ে এটা বলা হচ্ছে। এর মাধ্যমে আমরা স্ববিরোধিতা করছি কি না? এটি যেমন প্রশ্ন, তেমনি প্রশ্ন, নিজেদের সুবিধার প্রশ্নে সংবাদপত্রের মালিকদের সংগঠন যেমন একাট্টা, তেমনি গণমাধ্যমকর্মীরা কি একাট্টা হতে পেরেছেন? আমাদের ডিইউজে, বিএফইউজের কাজ কী? গত কয়েক ঘণ্টায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখলাম গণমাধ্যমকর্মীদের কেউ কেউ এই প্রশ্ন তুলেছেন। এসব লেখায় কি কোনো কাজ হবে? টনক নড়বে?

লেখক: সম্পাদক, দৈনিক ঢাকা টাইমস, ঢাকাটাইমস২৪ ডটকম ও সাপ্তাহিক এই সময়