ভিডিও কলে ছোট্ট মোহাম্মদ এবং...

আরিফুর রহমান দোলন
| আপডেট : ১৫ জুন ২০১৯, ০৯:৪৫ | প্রকাশিত : ১৪ জুন ২০১৯, ২২:৩৩

ঈদের ছুটির পর এখনো স্কুল খোলেনি আলিশা রহমানের। আমার যমজ কন্যার একজন আলিশা, আট বছর ছয় মাস বয়স। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় নানুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে রাতে থেকে গিয়েছে আলিশা। শুক্রবার সকালে আলিশা নানুর মুঠোফোন থেকে মায়ের মুঠোফোনে ভিডিও কল করেছে যমজ বোন আলায়নাকে। এরপর আমার সঙ্গে কথা। আমি তো অবাক। তুমিই কল করেছো? আমার প্রশ্নে আলিশা স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দেয়, হ্যাঁ। গ্রামে তো সবাই ভিডিও কল করে। মানে? ঈদের সময় দেখলাম মোহাম্মদ ভিডিও কলে বাবার সঙ্গে কথা বলছে। মোহাম্মদ আমার মামাতো বোনের ছেলে। বয়স এখনো চার ছোঁয়নি। ঈদের দিন তার বাবা ছিল ঢাকায়। বাবা-ছেলে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করেছে মুঠোফোনে ভিডিও কলের মাধ্যমে। আমার স্ত্রীর অভিজ্ঞতা, ‘গ্রামে প্রায় সব ঘরেই দেখলাম যারা প্রবাসী বাড়িতে ভিডিও কল দেয়।’ জানাল, এটা সে প্রায় প্রতিদিনই দেখেছে গ্রামে যে কয় দিন ছিল।

তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলাদেশ যে এগিয়ে যাচ্ছে এটা তো তারই প্রমাণ। আমরা অনেকে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে কার্যত ভয় পেতাম। কিন্তু এখন কত প্রযুক্তিবান্ধব হয়ে গেছি। সময়ের অপচয় হবে চিন্তায় একসময় ফেসবুক ব্যবহার করতাম না। কিন্তু যেদিন থেকে অনলাইন নিউজ পোর্টাল করলাম সেদিন থেকে ফেসবুক আমার ছায়াসঙ্গী। ফেসবুকে অফিসের বিভিন্ন বিভাগের সঙ্গে গ্রুপে যুক্ত আছি। অফিসের বাইরে যেখানেই থাকি না কেন, যখন যাদের দরকার খুব সহজে পেয়ে যাই। হোয়াটসঅ্যাপে, ভাইবারে, টুইটারে হাজারো বার্তা আদান-প্রদান করে অফিসের অনেক কাজ বাইরে বসেই করে ফেলতে পারি, পারছি।

বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে এবং এর পেছনে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরাট অবদান আছে। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ এই স্লোগান আওয়ামী লীগ ও সরকার শুধু জনপ্রিয়ই করেনি, বাস্তবেও মানুষকে অনেক বেশি তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর হতে নানাভাবে উৎসাহ দিয়েছে। সব শ্রেণির মানুষ এখন তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে। স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষাসেবা নিচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে অপরাধ, অপরাধী শনাক্ত করতে আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখন সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠেছে। আর গ্রাম থেকে শহর- সব শ্রেণির মানুষের যোগাযোগের জনপ্রিয় মাধ্যম হলো সোশ্যাল মিডিয়া।

ফেসবুক, ইউটিউব, গুগল, ইমো, ই-মেইল ছাড়া আমাদের তরুণ-তরুণীরা তাদের প্রাত্যহিক জীবন কল্পনাই করতে পারেন না। সাময়িক সময়ের জন্য ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে পূর্ণবয়স্ক অনেককেই হা-পিত্যেশ করতে শোনা যায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে আত্মীয়স্বজন মা-বাবা, ভাই-বোন, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে নিয়মিত কথা বলা, যোগাযোগ রক্ষা করা এখন আমাদের প্রতিদিনের রুটিন।

বন্ধু-পরিচতজন হারিয়ে ফেলেছেন? দীর্ঘদিন যোগাযোগ নেই। খুঁজে পাচ্ছেন না। এ ক্ষেত্রেও সহায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। মুহূর্তের মধ্যে যেকোনো জরুরি তথ্য খুঁজে দিতে গুগলের চেয়ে বড় অভিধান আর কী আছে? তথ্য এখন হাতের মুঠোয়। একটি স্মার্টফোন থাকলে গুগল, ফেসবুক, ইমো, হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার এখন কত সহজ!

দীর্ঘদিন এনালগ (সনাতনী) ফোন ব্যবহারের পর হয়তো ভাবছেন এবার স্মার্টফোন ব্যবহার করবেন। সাধ-সাধ্য আর প্রয়োজনের এই জায়গায় খানিকটা বেরসিকের মতোই মনে হচ্ছে আমাদের অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে। স্মার্টফোনের আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করেছেন। এর ফলে বিদেশি স্মার্টফোনের দাম বাড়বে। যদিও আমাদের দেশি কোম্পানি ওয়ালটন স্মার্টফোন তৈরি করে। দেশি শিল্পের বিকাশ ঘটবে, এই যুক্তি এ ক্ষেত্রে দেওয়া হবে কি না জানি না। কিন্তু এটা খুবই সত্য যে স্মার্টফোন আমদানিতে আগের বছরের তুলনায় একধাপে ১৫ শতাংশ শুল্ক বৃদ্ধির প্রস্তাব স্মার্টফোন ব্যবহারে অভ্যস্ত ও নতুন করে ব্যবহারে আগ্রহীদের জন্য বড়সড় ধাক্কা।

তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে জনগণকে আরও উৎসাহ দেওয়ার স্বার্থে উচিত হবে স্মার্টফোন আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক আগের মতোই ১০ শতাংশ রাখা। আমার যুক্তি, দেশের মানুষ আরো এক-দুই বছর স্মার্টফোন ব্যবহারে অভ্যস্ত হোক, উৎসাহী হোক এবং সরকারের নীতি এ ক্ষেত্রে সহায়ক হিসেবে কাজ করুক।

স্মার্টফোনের মাধ্যমে যারা ইন্টারনেট ব্যবহার করবেন, অর্থমন্ত্রী তাদের মনও খারাপ করে দিয়েছেন। সংসদে প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, মুঠোফোনের সিম ব্যবহার করে প্রদত্ত ইন্টারনেট সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। এতে কথা বলায় যেমন খরচ বাড়বে তেমনি ইন্টারনেট ব্যবহারেও বেশি খরচ হবে। সংশ্লিষ্ট খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন এ জন্য কমপক্ষে ২০ শতাংশ খরচ বাড়বে। আবার সিম কার্ডের ওপর কর ১০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০০ টাকা করা হয়েছে। এটাও মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীদেরই দিতে হবে। এই মুহূর্তে এ প্রস্তাবগুলো প্রত্যাহার করাই যুক্তিযুক্ত বলে মনে করি। কেন? আমার যুক্তি হলো, গোটা দেশেই তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে মানুষের মধ্যে এক ধরনের উৎসাহ আছে। এই উৎসাহে এখনই ভাটা পড়তে দেওয়া ঠিক হবে না। কারণ বিপুলসংখ্যক মানুষ এখনো এই সেবার বাইরে।

সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি নিশ্চয়ই প্রয়োজন। কিন্তু এই মুহূর্তে রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধির খাত হিসেবে তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে বেছে নেওয়ার যুক্তিও নেই। কারণ এটি বিকশিত হওয়ার অনেক সুযোগ আছে। উচিত হবে, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে যত ধরনের সেবা নেওয়া যায়, দেশের মানুষ যেন সেদিকে ঝোঁকে সেই পরিষেবার আরও উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা। বিশেষ করে যত দিন যাচ্ছে ততই ই-কমার্স জনপ্রিয় হচ্ছে। নতুন প্রজন্ম অভ্যস্ত হয়ে উঠছে অনলাইন কেনাকাটায়। ‘অনলাইন শপ’-এর বাজারটি অনেক বড় হবে, যদি সরকারের নীতি সহায়ক হয়। আর এ জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে মানুষকে উৎসাহ দেওয়ার নীতিই চাই। সব ধরনের ইন্টারনেট ব্যবহারে বেশি করারোপের কোনো যুক্তি এ মুহূর্তে নেই। যুক্তি নেই বিদেশি স্মার্টফোন আমদানিতে ১৫ শতাংশ বেশি শুল্ক আরোপেরও।

‘সোশ্যাল মিডিয়া ও ভার্চুয়াল বিজনেস’ সেক্টরে সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব কতখানি যৌক্তিক- তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। যখন এই খাতে উদ্যোক্তা বাড়ছে, তরুণ-তরুণীরা আগ্রহী হয়ে উঠছে, তখন ভ্যাটের খড়গ তাদেরকে নিরুৎসাহিত করবে এটিই স্বাভাবিক। ভার্চুয়াল বিজনেস খাতকে আরও প্রসারিত করার লক্ষ্যে এই ভ্যাট প্রস্তাব প্রত্যাহারই হবে যুক্তিযুক্ত।

তথ্যপ্রযুক্তি খাতে সুসংবাদ চাই। বাংলাদেশকে পুরোপুরি ডিজিটাল করতে হলে তো তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে আরো উৎসাহ দিতে হবে। সাধারণ মানুষকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে আকারে-ইঙ্গিতে নিরুৎসাহিত করার নীতি চাই না। নিশ্চয়ই সুবিবেচনা হবে। আশায় রইলাম।

লেখক: সম্পাদক, দৈনিক ঢাকা টাইমস, ঢাকা টাইমস২৪ ডটকম ও সাপ্তাহিক এই সময়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

রাজপাট বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা