সেই সিপিডি এই সিপিডি

প্রকাশ | ১৬ জুন ২০১৯, ১০:১৭ | আপডেট: ১৭ জুন ২০১৯, ১২:০৫

আরিফুর রহমান দোলন

সুইজারল্যান্ডে জাতিসংঘসহ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা ও অনান্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে গিয়েছিলেন ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। ২০০৮ সালে তৎকালীন সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে এই নিয়োগ পেয়ে মূলত তিনি তাঁর আসল পরিচয় চিনিয়েছিলেন। সেই দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বা তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন সিপিডি গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে দেওয়া বাজেটের ইতিবাচক দিক হুবহু তুলে ধরবে-এটা আশা করা বোধহয় ঠিক হবে না। কিন্তু একটি নিরপেক্ষ গ্রহণযোগ্য গবেষণা সংস্থা আমরা কাকে বলবো? বিশেষত সংস্থাটি যদি দেশের অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা করে তাহলে তার এমন বৈশিষ্ট্য হওয়াই কাম্য যে, সবসময় সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো বলবে। প্রকৃত তথ্য উপস্থাপনে সত্যিই যার কোনো উদ্দেশ্য থাকবে না।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) কি তার নিরপেক্ষ চরিত্র ধরে রাখতে পারছে? এই প্রশ্ন বিভিন্ন সময় ধরেই ছিল। নতুন করে আবার সামনে এসেছে গত ১৩ জুন জাতীয় সংসদে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের বাজেট পেশের পর। প্রস্তাবিত বাজেটের পর সিপিডির প্রতিক্রিয়া কার্যত পুরোপুরিই নেতিবাচক। খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিপিডির নাম না করে তাদের এই নেতিবাচক মনোভাব, প্রতিক্রিয়াকে ‘ভালো না লাগা পার্টি’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন।

সংবাদকর্মী হিসেবে কৌতূহল হয় আমার মনে। আচ্ছা সিপিডি কি আসলেই ‘ভালো না লাগা পার্টি?’ ভিন্ন ভিন্ন সরকার উত্থাপিত বাজেটের পর্যালোচনায় সিপিডি কেমন? বিশেষত যদি একই বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন সরকার একই ধরনের প্রস্তাবনা দেয় তখন সিপিডির প্রতিক্রিয়া কি একই ধরনের থাকে? না-কি বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া দেওয়ার উদাহরণও আছে সিপিডির? মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকা এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে ধাক্কাই খেতে হয়। গণমাধ্যমসহ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মহলে সিপিডি বিশ্বাসযোগ্য একটি গবেষণা সংস্থা হিসেবে নিজেকে উপস্থাপনের সব রকম চেষ্টাই করছে। কিন্তু একই ঘটনায় ভিন্ন দুই সরকারের সময় বিপরীতমুখী পর্যালোচনার উদাহরণ রয়েছে সিপিডিরই। অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা করা বাংলাদেশের বেসরকারি এই সংস্থার দ্বিমুখী অবস্থান বিস্ময়কর মনে হতে পারে অনেকের কাছে।

২০০৮-২০০৯ অর্থবছরের বাজেটে তৎকালীন সরকার অপ্রদর্শিত আয়কে বৈধ করার সুযোগ দেয়। ওই সময় বাজেট পর্যালোচনায় সিপিডি অপ্রদর্শিত আয়কে বৈধ করার সুযোগ সমর্থন করে। সিপিডি তখন মত দেয়, সরকারের এই সিদ্ধান্ত সঠিক। কেননা এক্ষেত্রে বৈধ আয়কেই প্রদর্শিত করার সুযোগ দেয়া হচ্ছে। সিপিডির তৎকালীন নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান সংবাদ সম্মেলন করে তৎকালীন সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পেশ করা বাজেটে কালো টাকা সাদা করার এই প্রস্তাবকে সমর্থন জানান। তৎকালীন সরকারের অর্থ উপদেষ্টা মির্জা এ বি আজিজুল ইসলাম এই বাজেট পেশ করেছিলেন। বিস্ময়কর! অবিশ্বাস্য! সেই সিডিপি ২০১৯-২০ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের পেশ করা একই ধরনের প্রস্তাবের বিরোধিতা করছে কঠোরভাবে।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল বাজেটে প্রস্তাব করেছেন, হাইকেট পার্ক, অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ করে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অতিরিক্ত কর দিয়ে অপ্রদর্শিত আয় প্রদর্শন করা যাবে। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইসহ বিভিন্ন মহল একে সাধুবাদ জানাচ্ছে। খোদ দেশের প্রধানমন্ত্রীও সংবাদ সম্মেলনে এর পক্ষে বলেছেন। কালো টাকা সাদা করার পক্ষে প্রধানমন্ত্রীর যুক্তি হলো, টাকা বিদেশে পাচার হতে না দেয়া এবং দেশেই যেন বিনিয়োগ হয়। তবে অপ্রদর্শিত আয় প্রদর্শনের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে সমালোচনাও আছে বিভিন্ন মহলে। যার মধ্যে খুব বেশি সিপিডি।

এক পর্যালোচনায় দেখা যায়, রাজনৈতিক সরকারের দেওয়া বাজেটের পর সিপিডি যেভাবে এর বিরোধিতায় সোচ্চার অরাজনৈতিক সরকারের সময় আবার তাদের কণ্ঠে উল্টো সুর। সর্বশেষ বাজেটের প্রতিক্রিয়ায় সংস্থাটি এক কথায় বলেছে, সুবিধাভোগীদের পক্ষেই এবারের বাজেট। এই বাজেট উচ্চ আয়ের মানুষকে অনেক বেশি সুবিধা দেবে। মধ্য ও নিম্ন আয়ের মানুষ সুফল পাবে না। গত শুক্রবার বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে সিপিডি যে পর্যালোচনা উপস্থাপন করে তাতে পরতে পরতে শুধুই সমালোচনা। সংবাদ সম্মেলনে সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘অর্থনীতিতে যে চাপ তৈরি হয়েছে তা নিয়ে বাজেটে পদক্ষেপের কথা নেই। যারা অর্থনৈতিক অপশাসনের সুবিধাভোগী বাজেট এবারও তাদের পক্ষে গেছে।’

এভাবে গত দশ বছর কিংবা তার আগে রাজনৈতিক সরকারগুলোর সময়ে পেশ করা বাজেট নিয়ে সিপিডির পর্যালোচনায় নেতিবাচক মন্তব্যই শুধু পাওয়া যায়। শুধুমাত্র প্রশংসা আছে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে উপস্থাপিত বাজেট নিয়ে। সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে তৎকালীন অর্থ উপদেষ্টা মির্জা এ বি আজিজুল ইসলামের প্রথম বাজেট উপস্থাপনের পর সিপিডি এর পর্যালোচনায় যে সংবাদ সম্মেলন করে সেখানে মূলত প্রশংসাই ছিল বেশি। যা ওই সময় বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত, প্রচারিতও হয়েছে।

সরকারের গৃহীত বিভিন্ন নীতি, উদ্যোগ যদি সার্বিকভাবে জনকল্যাণের বিপরীত হয় তাহলে তা নিয়ে সমালোচনা নিশ্চয়ই সাধুবাদযোগ্য। আবার সরকারের কর্মকাণ্ড ও উদ্যোগ যদি জনজীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনে তাহলে প্রশংসার মাধ্যমে তাকে উৎসাহ দেওয়াও কর্তব্য মনে করি। কিন্তু এই কর্তব্যের বিষয়ে সিপিডি কতখানি সজাগ তা পর্যালোচনার সময় এসেছে। বাংলাদেশ নিয়ে দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংকের বিভিন্ন নেতিবাচক পদক্ষেপের কথা আমরা জানি। বিশেষত পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন না করে বিশ্বব্যাংক তার জাত চিনিয়েছে। কিন্তু সেই বিশ্বব্যাংকও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রশংসা করেছে বিভিন্ন সময়ে। কিন্তু এর ছিটেফোঁটাও কি কখনো করেছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)?

বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম বাংলাদেশ সফরে এসে শেখ হাসিনার সরকারের প্রশংসাই শুধু করেননি, বলেছেন ‘কীভাবে দারিদ্র্য কমাতে হয় বাংলাদেশ আমাদের শিখিয়েছে।’ বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন বাংলাদেশ এটা স্বীকৃতি দিয়েছে যে, জনগণের পেছনে বিনিয়োগ তথাকথিত অবকাঠামো, সেতু, সড়ক ও জ্বালানি খাতে বিনিয়োগের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। এ বিনিয়োগ মানুষকে শিক্ষিত ও দক্ষ কর্মী হিসেবে গড়ে তোলে, যা বিশ্ব অর্থনীতিতে বাংলাদেশকে কার্যকরভাবে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদে প্রতিযোগিতায় সক্ষম করে তুলবে। ওই সময় বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট আরও বলেছিলেন, বাংলাদেশ যেভাবে দারিদ্র্যের হার কমিয়েছে তা আমাদের এই আশা জোগায় যে, ভবিষ্যতে দারিদ্র্যের হার কমার ধারা অব্যাহত থাকবে। অন্য দেশগুলোও বাংলাদেশের কাছ থেকে এই কৌশল অনুসরণ করবে। কীভাবে দারিদ্র্য কমাতে হয় বাংলাদেশ তা আমাদের শিখিয়েছে। আর তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো উদ্ভাবনী। নতুন নতুন উদ্ভাবনী ধারণার কারণে অত্যন্ত দ্রুত গরিবের সংখ্যা কমছে। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার কমাকে অসাধারণ ও চমৎকার মনে করে খোদ বিশ্বব্যাংকই।

বড্ড জানতে ইচ্ছে করে, গোটা বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, উন্নয়ন নিয়ে সার্টিফিকেট দানকারী বিশ্বব্যাংকের এই মূল্যায়নের পরেও কি কখনো অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা করা বাংলাদেশের গবেষণা সংস্থাটির চোখে দেশের এই অর্জন চোখে পড়েছে? তারা কি কখনো বলেছে, সরকারের গৃহীত বিভিন্ন নীতির সমালোচনা যেমন আমরা করি আজ বিশ্ব স্বীকৃতির পর আমরাও বলছি, এই নীতিগুলো প্রশংসাযোগ্য-সেজন্য বাংলাদেশ এগোচ্ছে। সিপিডি এসব ক্ষেত্রে নীরব, নিশ্চুপই থেকে বরং। কিন্তু কেন? এটা কিসের লক্ষণ? বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য ও ওই সময়ের পরিকল্পনা কমিশনের অন্যতম সদস্য ড. রেহমান সোবহান সিপিডির পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান। অর্থনীতিবিদ হিসেবে দেশে বিদেশে সুপরিচিত রেহমান সোবহানের গ্রহণযোগ্যতার কথাও শুনেছি বিভিন্ন সময়ে। তিনি কতটা সক্রিয়? তার গোচরে কি এসব আছে? সিপিডির কাজ কি শুধুই রাজনৈতিক সরকারের গৃহীত বিভিন্ন আর্থিক নীতি, সরকারের নেতিবাচক দিক তুলে ধরা? ইতিবাচক কিছু থাকলে তুলে ধরতে বাধা কোথায়? খোদ দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন ‘তারা ভালো না লাগা পার্টি’ তখন আমি মনে করি তাদের উচিত নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করা।

যদিও রাজনৈতিক অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ আবার বলেন, সিপিডি অবস্থা তো পরিষ্কারই। কীভাবে? ২০০৭ সালে দেশে সেনা সমর্থিত সরকার আসার আগে দেশের বিভিন্ন জেলা সফর করে সৎ ও যোগ্য প্রার্থীর সন্ধানে সুধি সমাবেশ করে জনমত গঠন করার কাজও করেছে তারা। অর্থনীতি নিয়ে গবেষনা করা সংস্থাটির রাজনৈতিক অভিসন্ধি আছে কি-না তা নিয়ে তখন থেকেই জোরেশোরে প্রশ্ন ওঠে। সিপিডি আসলে কী চায়? জবাবদিহিতা? এটাতো দেশের সবাই চান। কিন্তু সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে তো সিপিডিকেও। তারা কতখানি স্বচ্ছ? তাদের উদ্দেশ্য কতখানি সৎ? যত দিন যাচ্ছে এই প্রশ্নই প্রবল হচ্ছে। তারা সত্যিই ‘ভালো না লাগা পার্টি’ কি-না?

লেখক: সম্পাদক, দৈনিক ঢাকা টাইমস, ঢাকাটাইমস২৪ ডটকম ও সাপ্তাহিক এই সময়