তবুও থামছে না পাহাড়ে বসবাস

প্রকাশ | ১৬ জুন ২০১৯, ২২:০৪

চট্টগ্রাম ব্যুরো, ঢাকাটাইমস

প্রতি বছরই বর্ষায় চট্টগ্রাম মহানগরীর কোনো না কোনো পাহাড়ে ধসের ঘটনা ঘটে। এতে প্রাণহানিও হয়। গত এক যুগে পাহাড় ধসের ঘটনায় প্রাণ গেছে ২৫০ জনের। তবুও পাহাড়ে বসতি ঠেকানো যাচ্ছে না। বন্দরনগরীজুড়ে রয়েছে ২৮টি পাহাড়। এর মধ্যে রয়েছে সরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন ১৭টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়। আর এসব পাহাড়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে অন্তত ৮৩৫টি পরিবার। তাদের পাহাড় থেকে বসতি সরাতে গত ১৫ মে পর্যন্ত সময় দিয়েছিল জেলা প্রশাসন। তবে এ সময়সীমা এক মাস আগে পেরিয়ে গেলেও পাহাড় ছাড়েনি কোনো পরিবার।

অতি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় থেকে বসতি সরাতে না পারার পেছনে দখলদাররা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ারই কারণ দেখছে সংশ্লিষ্টরা। তাই সেখানে বসতি গড়া পরিবারগুলোকে উচ্ছেদ করতে গেলেই প্রতিরোধের মুখে পড়তে হচ্ছে প্রশাসনকে। দ্রুত এসব বসতি সরানো না গেলে এই বর্ষায় ভারি বর্ষণের কারণে আবারো পাহাড় ধসে প্রাণহানির মতো ঘটনা ঘটতে পারে বলে সতর্ক করা হয়েছে।

জেলা প্রশাসন সূত্র মতে, চট্টগ্রামের ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করতে জেলা প্রশাসন একটি হালনাগাদ তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেয়। এ তালিকা তৈরিতে নগরীর সদর, কাট্টলী, চান্দগাঁও, বাকলিয়া, আগ্রাবাদ ও পতেঙ্গা সার্কেলের সহকারী কমিশনাররা (ভূমি) ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের নাম ও মালিকানা, অবৈধ বসবাসকারীর নাম, পরিবারের সদস্য সংখ্যা উল্লেখ করে একটি হালনাগাদ প্রতিবেদন জেলা প্রশাসনের কাছে জমা দেন।

প্রতিবেদনে চট্টগ্রামে ২৮টি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের কথা উল্লেখ করা হলেও ১৭টি পাহাড়কে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বাস করছে মোট ৮৩৫টি পরিবার। অতি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত এসব পাহাড়ের মধ্যে ১০টি আবার ব্যক্তিমালিকানাধীন। আর সেসব পাহাড়ে ৩০৪টি পরিবারের বসবাস। বাকি সাতটি পাহাড় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, রেলওয়ে, চট্টগ্রাম ওয়াসা, গণপূর্ত ও জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের মালিকানায় রয়েছে। এসব পাহাড়ে বসবাস ৫৩১টি পরিবারের।

২০০৭ সালের ১১ জুন পাহাড় ধসে ১২৭ জন মারা যায়। এরপর চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো তদারকি ও প্রাণহানি রোধে সে সময়কার অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার এমএন সিদ্দিককে প্রধান করে দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। একই সময়ে ১৮ সদস্যের একটি পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটিও গঠন করা হয়।

এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি ধসের ২৮টি কারণ চিহ্নিত করে সমস্যা সমাধানে ৩৬ দফা সুপারিশ করে। এর মধ্যে পাহাড়ে বসবাসকারীদের পুনর্বাসন, পাহাড় কাটায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, নীতিমালা প্রণয়ন, নিরাপত্তাপ্রাচীর নির্মাণ, বালি উত্তোলন নিষিদ্ধকরণ, ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় থেকে অবৈধ বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণ, পাহাড়ের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা নির্মাণের অনুমতি না দেয়া ও পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে হাউজিং প্রকল্প না করা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

তবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়হীনতার কারণে ১২ বছর পেরোলেও পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির একটি সুপারিশও বাস্তবায়ন হয়নি। আর প্রতি বছর পাহাড় ধসে প্রাণহানিও হয়। গত ১২ বছরে পাহাড় ধসে ঝরে গেছে প্রায় ২৫০টি প্রাণ।

গত ১৬ এপ্রিল চট্টগ্রামে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির ১৯তম সভায় বিভাগীয় কমিশনার মো. আবদুল মান্নান নগরীর ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় অবৈধ দখলমুক্ত করার নির্দেশ দেন। ওই সময় জেলা প্রশাসন ১৭টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে ৮৩৫টি পরিবার বসবাস করছে জানিয়ে বসতি সরাতে ১৫ মে পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়।

সবশেষ গত ৫ মে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে নগরীর লালখান বাজারের পোড়া কলোনিতে জেলা প্রশাসন অভিযান চালিয়ে পাহাড় বসবাসকারীদের গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এর প্রতিবাদে বিভিন্ন পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাসরত কয়েকশ নারী-পুরুষ লালখান বাজার মোড়ে প্রায় ২ ঘণ্টা সড়ক অবরোধ করে রাখে। পরে বাধ্য হয়ে অভিযানের ইতি টানতে হয়।

এ ধরনের প্রতিরোধের কারণে এক মাস আগেই বসতি সরানোর সময়সীমা পেরিয়ে গেলেও নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। এমনকি এসব পাহাড়ে বসবাসরতদের আবার গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ লাইন জোগাড় করে দেয়া হয়েছে।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াছ হোসেন জানান, তালিকা অনুযায়ী ১৭টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় থেকে ৮৩৫টি পরিবারকে ১৫ মের মধ্যে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। দুই মাস ধরে পাহাড়ে অবস্থানকারী পরিবারগুলোর তাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘যেহেতু বর্ষা মৌসুম চলে এসেছে, তাই দ্রুততম সময়ের মধ্যে সরাসরি উচ্ছেদে যাব। কারণ কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে সেটার জবাবদিহিতা আমাদেরই করতে হবে। সেজন্য কোনো ধরনের রিস্ক নিতে চাই না। পাহাড় দখলদাররা যতই প্রভাবশালী হোক না কেন, কাউকে কোনো ছাড় দেব না।’

ঢাকাটাইমস/১৬জুন/ডিএম