ভাগ্য বেচবেন আর ভ্যাট দেবেন না!

প্রকাশ | ১৭ জুন ২০১৯, ১৭:৫৯

অরুণ কুমার বিশ্বাস

একটা কথা আমি প্রায়শ বলে থাকি। বলতে পারেন অনেকটা ধাঁধার মতো। পাথরে নাকি ভাগ্য ফেরে! কিন্তু কার? যে বেচে তার। কথা মোটে মিছে নয়, শতভাগ সত্যি। ইদানীং দেখবেন রাস্তাঘাটে শুধু নয়, সুরম্য ভবনে রীতিমতো দোকান সাজিয়ে বসেছেন একশ্রেণির ভাগ্যব্যবসায়ী। এরা নাকি লোকের হাত দেখে হস্তরেখা গণনা করে তারপর ভাগ্য ফেরাবার পাথর বাতলে দেন! কী আশ্চর্য! মামুলি পাথরেই যদি লোকের বরাত খুলে যেতো, তাহলে মিছে কষ্ট করে উদয়াস্ত পরিশ্রম করা কেন! দশ আঙুলে কুড়িখানা রঙ-বেরঙের পাথর বসানো আংটি পরে নাগাবাবা হয়ে বসে থাকলেই হয়।

 এদের নামের আগে এবং পরে যোগ্যতাসূচক চটকদার সব টাইটেল সাঁটা থাকে। এদের কাজ-কারবার মূলত দোধারি তলোয়ারের মতো দুদিকেই কাটে। আপনার মন খারাপ, মাথা গরম, সংসারে অসুখ কিংবা ব্যবসায়ে মোটে আয়-উন্নতি নেই! কষ্ট করে চলে আসুন পাথরবাবার দরবারে। হাতখানা বাড়িয়ে দিন। তিনি প্রথমে আপনার হস্তরেখা বিচার করবেন। তার জন্য গুনে গুনে দুটি হাজার টাকা ফেলুন। তারপর দেখবেন গণৎকারের কপালে বিঘতখানেক চওড়া ভাঁজের আনাগোনা। অর্থাৎ আপনার কপালে সত্যি সত্যি শনি ভর করেছে। এই নিয়ে তিনি ইনিয়ে বিনিয়ে নানা কথা বলবেন। শনির সঙ্গে কেতুও যোগ হয়েছে, বুঝলেন। রাহুও কিন্তু পিছিয়ে নেই। শনি, কেতু আর রাহুর সাঁড়াশি আক্রমণে আপনার কপালের ফুটিফাটা অবস্থা। কারো বাপের সাধ্যি নেই এই বিষম বিপদ থেকে আপনাকে বাঁচায়!

এর থেকে কি কোনোই পরিত্রাণ নেই, পাথরবাবা? আপনি দুহাত কচলে কেঁদে কেটে শেষে বলবেন। ততক্ষণে আপনার বুকের ভিতর ধড়ফড়ানি শুরু হয়েছে, কপালে স্বেদবিন্দু, মনে গুরুতর ভয়।

পাথরবাবা অভয় দিলেন। তবে সাথে সাথে নয়, বরং আপনার শরীর থেকে আপসে কিলোখানেক ঘাম ঝরাবার পর। ‘উপায় একটা আছে বটে। তার সেটা বেশ খরচসাপেক্ষ’। ক্রনিক পেটখারাপের রোগীর মতো টিপে টিপে বললেন পাথরবাবা। এটাই তার কৌশল। হাত সাফাইয়ের মতো এভাবেই তিনি লোকের গাঁট কাটেন। অন্যের পকেটের টাকা চোখের সামনে তার সম্মতিতেই হাতিয়ে নেন তিনি। সবার থেকে পারেন না, যারা মানুষ হিসেবে দুর্বল, বেকুব এবং অনেক টাকার লোভ যাদের, তাদের পকেট সাফা করেন এসব পাথরবাবা।

আমি মানছি যে, এই বিষয়ে আমার ধারণা তত গভীর নয়। তবে এটুুক বুঝতে কারো অসুবিধা হবার কথা নয় যে, শর্টকাটে কামাই আর ধান্ধার মাঝে কোনো ফারাক নেই। পেশা হিসেবে হাত দেখাদেখি, পাথরব্যবসা আমি মোটে পছন্দ করি না। সোজা কথায় একে আমার কাছে বুজরুকি বলেই মনে হয়। কিন্তু সরকার বাহাদুর এবার একখানা আচানক কাজ করে বসলেন। ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এই জ্যোতিষচর্চার ওপর মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট ধার্য করেছেন। ভ্যাটের বাংলা তরজমা মূসক। জ্যোতিষচর্চার ওপর বেমক্কা ভ্যাট ধার্যের মাধ্যমে এই বুজরুকি বিদ্যাকে একরকম আইনি সমর্থন দেয়া হলো। সচেতন মানুষ হিসেবে আমি এটা মানতে আগ্রহী নই। কারণ মানুষের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাদের নিঃস্ব করাটা আর যাই হোক, ব্যবসা বলে পরিগণিত হতে পারে না।

আবার একটু তলিয়ে ভাবলে সরকার বাহাদুর ভুল কিছু করেননি। মূল্য সংযোজন কর আইন অনুযায়ী পণের বিনিময়ে যখন কোনো পণ্য বা সেবা প্রদান করা হয়, তখন তাকে বাণিজ্য হিসেবে ধরে নিয়ে মূসক আরোপ করা যায়।  পাথরবাবাদের কাজ-কারবার সঠিক  কি না তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা হতে পারে, তবে মূল্য সংযোজন কর আইনে তা বাণিজ্য বৈকি। কারণ সেখানে দুই পক্ষের মধ্যে ‘পণের বিনিময়’ হয়ে থাকে। সেই অর্থে জ্যোতিষচর্চার ওপর মূসক আরোপ যথাযথ মর্মে প্রতীয়মান।

মাত্রই রাষ্ট্রীয় বাজেট ঘোষিত হলো। এবারের রাজস্ব আদায় খাতে লক্ষ্যমাত্রা ধার্য হয়েছে ৩ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। মূলত জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এই পরিমাণ অর্থ আদায় করবে। অনেকেই মনে করছেন, এটা নেহাতই বাড়াবাড়ি রকমের বড় অংক। আদৌ আদায়যোগ্য নয়। এই বিশাল পরিমাণ রাজস্ব আয়কর, ভ্যাট ও আমদানি শুল্ক থেকে উসুল করা সম্ভব হবে না। কিন্তু আমি আশাবাদী মানুষ, তাই আমার হিসেবটা ভিন্ন। আমি মনে করি, দেশের মানুষ সদয় হলে এটা মোটেও কোনো বিশাল অঙ্ক নয়। কারণ আপনাদের নিশ্চয়ই জানা আছে, এদেশে আয়কর তারাই দেয়, যাদের কামাই রোজগার অঢেল নয়। আর যারা অঢেল সম্পত্তির মালিক তারা আইনের ফাঁকফোকর গলে নানান অজুহাতে আয়কর প্রায় দেন না বললেই চলে। তারা কর ফাঁকিবাজ, তারা নিন্দনীয় কাজ করছেন। এই পাঁচ থেকে দশ শতাংশ ধনী মানুষ আরেকটু দায়িত্বশীল ও সততার পরিচয় দিলে সোয়া তিন লাখ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় কোনো ব্যাপারই হত না।

আবেগতাড়িত বাঙালি মানুষ হিসেবে মন্দ নয় মানছি, তবে আমাদের হিসেবে গোলমাল আছে। আমরা প্রায় সবাই দেশকে ভালোবাসি, দেশমাতৃকার কথা উঠলে বকাবাজি করে চোপা ফুলিয়ে ফেলি, কিন্তু পোলাপানের পড়াশোনা, বাড়ি-গাড়ি সব হয় বিদেশে। এক বিশিষ্ট লেখক, এতদিন জানতাম তিনি নিঃসন্তান। এখন শুনি তার একটি মাত্র মেয়ে নাকি মার্কিন মুলুকে পড়াশোনা করছে। অর্থাৎ মেলা টাকা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। এই হলো গিয়ে আমাদের দেশপ্রেমের নমুনা।

সে যাক, আবারও প্রসঙ্গে প্রত্যাবর্তন করি। জ্যোতিষচর্চা কী জিনিস, কীভাবে তাতে লোকের কপাল ফেরে- এই নিয়ে গবেষণার বিশেষ অবকাশ রয়েছে। আর শুধু তাদেরই বা দুষি কেন, দেশে কি বুজরুকির অন্ত আছে! ব্যবসায়ীরা এখন রাজনীতিতে নামছেন, সেখানেও কিছু সকৃতি আছে বলে মনে করি না। ওটাও ব্যবসা, পলিটিক্যাল কারবার। ভাবছি, হুটহাট রাজনীতি করার ওপরও ভ্যাট আরোপের বিষয়টি বিবেচনা করা যায় কি না। জ্যোতিষীরা ভ্যাট দিলে রাজনীতিকরা নয় কেন? বস্তুত, দুটোই স্পেকিউলেশন। প্রচুর প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি থাকে। সেই অর্থে দুটোই সমমানের ও সমজ্ঞানের বাণিজ্য।

আজ আপাতত এখানেই বিরতি। পরবর্তীতে ঘটকালির ওপর ভ্যাট আরোপের বিষয়েও কিছু আলোকপাতের ইচ্ছে আছে।

রম্যকার: কথাসাহিত্যিক  ও অতিরিক্ত কমিশনার, বাংলাদেশ কাস্টমস।