আর কত চাই এরশাদের!

আরিফুর রহমান দোলন
| আপডেট : ১৮ জুন ২০১৯, ১৮:৩৭ | প্রকাশিত : ১৮ জুন ২০১৯, ১৬:২৭

গুলশানে ইফতার মাহফিলে দেখা হয় পরিচিত এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে, অনেক দিন পর। কেমন আছেন? জিজ্ঞেস করতেই ভাবলেশহীন কণ্ঠে বলেন, ‘ধরা খাইছি। ভালো নাই।’ মানে? এবার ওই ব্যবসায়ী বলেন, ‘আপনি মনে হয় জানেন না, আমি জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য।’ কবে হলেন? ‘আরে হইছি কি আর সাধে!’ রীতিমতো খেদোক্তি করেন ওই ব্যবসায়ী। সংসদে মনোনয়ন দেওয়ার কথা। মহাজোটের তালিকায় নাম থাকার কথা। এইচ এম এরশাদকে ইঙ্গিত করে বললেন, ‘নিল। কিন্তু দিল কই!’

বুঝলাম, খোদ সাবেক রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আর্থিক লেনদেন হয়েছে সরাসরি। ব্যবসায়ী বন্ধু বলেন, ‘মনোনয়ন না পেয়ে হয়েছি প্রেসিডিয়াম সদস্য।’

অবাক হই। কাগজে-কলমে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামের সদস্য হয়ে কোথায় সন্তোষ প্রকাশ করবেন, সেখানে চরম অসন্তুষ্টি। কেন? কৌতূহল থেকে খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করি। জাতীয় পার্টিতে আমার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন নেতা আছেন। একে একে তাদের সঙ্গে এসব নিয়ে কথা বলি। এইচ এম এরশাদের গুডবুকে আছেন এমন একজনের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা হয়। ওই নেতা রাগঢাক না করেই জানান, সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের মনোনয়ন নিয়ে পার্টির চেয়ারম্যান অনেকের সঙ্গে সরাসরি আর্থিক লেনদেন করেছেন। এটাই সত্য।

ঈদের আগে ও পরে জাতীয় পার্টির একজন নারী সংসদ সদস্যকে দলের কারণ দর্শানো নোটিশ এবং এ নিয়ে দলের অভ্যন্তরে তোলপাড়ের বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ নজরে আসে। গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা পরিষ্কার স্বীকারই করে নিচ্ছেন কারণ দর্শাও নোটিশ পাওয়া অধ্যাপক মাসুদা রশিদ চৌধুরীর কাছে তাদের দেনা-পাওনা আছে। এটা মেটাতেই হবে। বিস্ময়কর! প্রকাশ্যে গণমাধ্যমের কাছে এইভাবে আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে মুখ খোলে কি বার্তা দিতে চাইলেন জাতীয় পার্টির মহাসচিব। মুঠোফোনে তাকে জিজ্ঞেস করলাম আসলে কি হয়েছে। আপনারা কি টাকার বিনিময়ে মনোনয়ন দিয়েছিলেন? মশিউর রহমান রাঙ্গা হেসে বলেন এগুলো কি আমি বলতে পারি? দলের চেয়ারম্যান এসব হ্যান্ডেল করেছেন। তার কথায় বোঝা গেল একটা কিছু হয়েছে।

এরশাদের সঙ্গে দীর্ঘদিনের যোগাযোগ এমন একজন সিনিয়র গণমাধ্যমকর্মীকে বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে বললাম। বললেন, সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় এরশাদের বাসভবন থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি দল উদ্ধার করেছে এটি তিনি শুনেছিলেন। তবে এরশাদের চেয়েও বেশি উদ্ধার হয়েছিল তৎকালীন মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদারের বাড়ি থেকে। শুনে থ মেরে যাই। আর কত চাই এরশাদের? প্রশ্ন ছুড়ে দিলে সিনিয়র ওই গণমাধ্যমকর্মী বলেন, এরশাদ এমনই। টাকার জন্য সব করতে পারেন।

শুনেছি এইচ এম এরশাদ গুরুতর অসুস্থ। ঠিকমতো উঠে দাঁড়াতে কষ্ট হয়। স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারেন না। পরিষ্কারভাবে কথা বলতে পারেন না। এমনকি ঠিকমতো সবাইকে চিনতেও পারেন না। সেই এরশাদ এখনো টাকার পাগল! ভাবতে পারি না। মাসুদা এম রশিদ চৌধুরী এমপির বক্তব্য কয়েকটি কাগজে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বলেছেন, দীর্ঘদিন ধরে দল করি অনেক কষ্ট করেছি। কোনোদিন কোনো কিছু পাই নাই। একাধিকবার সংরক্ষিত নারী আসনের মনোনয়ন বঞ্চিত ছিলাম। শেষ সময়ে এসে মনোনয়ন পেলাম। এখন নানাভাবে টাকার কথা বলা হচ্ছে দলের কারো কারো পক্ষ থেকে। টাকা কেন দিতে হবে এসব কি! আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলাম। আমার ছেলে ব্যারিস্টার। তাকে বলেছি বিষয়গুলো দেখার জন্য।

আরেকটি কাগজে দেখলাম, জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশিদ ভয়ঙ্কর এক কথা শুনিয়েছেন। রাজনীতি, রাজনীতিকদের জন্য বিষয়টি খুবই অসম্মানজনক বলেই আমি মনে করি। ফিরোজ রশিদের বক্তব্য, তিনি তার নিজের মেয়ের জন্য জাতীয় পার্টির কাছে সংরক্ষিত নারী আসনে মনোনয়ন চেয়েছিলেন এজন্যে নাকি নগদ ৫ কোটি টাকা দলের তহবিলে জমা দেওয়ার প্রস্তাবও করেন। সাবেক এই মন্ত্রীর যুক্তি এভাবে দলের তহবিলে ২০ কোটি টাকা হয়ে যাবে, চার জন নারী সংসদ সদস্যের মনোনয়নের মাধ্যমে। এই তহবিল ব্যবহার করা হবে দলের অফিসসহ নানা কাজে। ফিরোজ রশিদ মনে করেন হয়তো এর চেয়েও বেশি অর্থ লেনদেন হয়েছে। যে জন্য তার মেয়ে মনোনয়ন পাননি। ‘লুটেরা’ এরশাদের টিএনটিসহ আরও কয়েকটি দপ্তরের মন্ত্রী ছিলেন কাজী ফিরোজ রশিদ। টাকার মাধ্যমে নিজ কন্যার মনোনয়ন নিতে চাওয়ার মাধ্যমে তিনি স্পষ্ট করেছেন তার কাছে টাকা কোনো বিষয় নয়। এটি কতখানি নৈতিক বা অনৈতিক এই প্রশ্ন তার কাছে রাখা অবান্তর।

দুর্নীতি দমন কমিশন কয়েক বছর আগে ধানমন্ডির একটি বাড়ি দখল নিয়ে তার বিরুদ্ধে একটি মামলা করেছে, যা চলমান আছে। সেই ফিরোজ রশিদ দলের মনোনয়ন কেনা-বেচার বিষয়টিকে সাদা চোখে দেখবেন এটাই হয়তো স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের কাছে এটা তো খুবই অস্বাভাবিক, অবাস্তব এবং পুরোপুরি নীতিহীন কাজ। আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে জাতীয় সংসদে মনোনয়ন কেনা-বেচার খবর নানাভাবে শোনা গেছে। সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির একাধিক নেতা দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বকে ইঙ্গিত করে এই অভিযোগ এনেছিলেন। প্রকাশ্যে এ নিয়ে সংবাদ সম্মেলনও হয়েছে। বিশেষ করে চাঁদপুরের কচুয়া আসন থেকে সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ও বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক আ ন ম এহছানুল হক মিলনের পরিবর্তে মালয়েশিয়া প্রবাসী মোশারফ হোসেনকে দলের মনোনয়ন দেওয়ার বিষয়টি বিএনপির নীতিনির্ধারণী মহলে অনেকেই ভালোভাবে নেননি। ওই সময়ে খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রীর বিরুদ্ধে মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ উঠে।

আবার বিভিন্ন আসনে বাংলাদেশে ফৌজদারি আইনে দণ্ডপ্রাপ্ত ও লন্ডনে পলাতক তারেক রহমানের বিরুদ্ধেও টাকার বিনিময়ে মনোনয়ন দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। তবে মনোনয়ন বাণিজ্য নিয়ে ওই সময়ে জাতীয় পার্টির মধ্যেকার বিরোধ নিয়েই গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচারিত হয় বেশি। বিশেষত জাতীয় পার্টির তৎকালীন মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদারের বিরুদ্ধে দলীয় কার্যালয়ের সামনেই একাধিক সভা-সমাবেশ-বিক্ষোভ মিছিল হয়। একে একে যখন দলের অনেক নেতা প্রকাশ্যে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে শুরু করেন কীভাবে মনোনয়ন দেওয়ার নাম করে রুহুল আমিন হাওলাদার তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন তখন বিষয়টির সুরাহা করতে তাকে দলীয় মহাসচিবের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।

ওই সময়ে পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার ঢাকার শফিকুল ইসলাম সেন্টু, বৃহত্তর বরিশালের মিজানুর রহমান, বৃহত্তর ময়মনসিংহের মোস্তফা আল মাহমুদসহ কাজী মামুনুর রশিদ, আলাউদ্দিন মৃধা, আবুল কাশেম রিপনসহ অর্ধশতাধিক নেতার কাছ থেকে মনোনয়ন নিশ্চিত করার কথা বলে আর্থিক লেনদেন করেছেন। কিন্তু তারা মনোনয়ন না পেয়ে ক্ষোভে-দুঃখে বিষয়টি প্রকাশ্যে নিয়ে আসেন।

এরশাদের পালিত কন্যাখ্যাত অনন্যা হোসাইন মৌসুমী তো এককাঠি সরেস ছিলেন এ ক্ষেত্রে। ওই সময়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে তিনি জানান দেন টাকার বিনিময়ে তার নিশ্চিত মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে আরেকজনকে। মৌসুমী জাতীয় মহিলা পার্টির সাধারণ সম্পাদিকা। তিনি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও থেকে মনোনয়ন চেয়েছিলেন। এমন ঘটনাও ওই সময়ে ঘটেছে যে, রুহুল আমিন হাওলাদারকে পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদের বনানী কার্যালয়ে কয়েক ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। শোনা যায় ওই সময় তিনি ফোনে পার্টির গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতাকে বলেছেন আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি হয়েছে এইচ এম এরশাদের নির্দেশনায় এবং তার সরাসরি তত্ত্বাবধানে। এখানে তিনি কোনোভাবেই দায়ী নন।

তাহলে চাপের মুখে রুহুল আমিন হাওলাদারকে মহাসচিব পদ থেকে সরালেও আবার নিজে রাজনৈতিক উপদেষ্টার পদ দিয়েছিলেন এরশাদ নিজের দুর্বলতা ঢাকতেই। এখন নতুন করে নারী সংসদ সদস্যদের মনোনয়ন দেওয়ার বিনিময়ে আর্থিক লেনদেনের চুক্তিটি যেভাবে ক্রমশ প্রকাশ্য হচ্ছে তাতে তো এটি পরিষ্কার যে, এসব বিষয়ে এরশাদের লোভ-লালসা আগের মতোই আছে।

রুহুল আমিন হাওলাদারের পরিবর্তে মহাসচিবের দায়িত্ব পেয়ে ২০১৮ সালের ২ ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলন করে মশিউর রহমান রাঙ্গা গণমাধ্যমকে বলেন, রুহুল আমিন হাওলাদারের বিরুদ্ধে মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ তদন্ত করা হবে। জাতীয় পার্টির মনোনয়ন কেনার জন্য টাকা দিয়েছে এমন কেউ থাকলে তাদেরকে যোগাযোগ করার আহ্বানও তিনি জানিয়েছিলেন। এখন সেই মশিউর রহমান রাঙ্গাই দলের একজন নারী সংসদ সদস্যকে জাতীয় পার্টির তহবিলে টাকা দেওয়ার জন্য একাধিকবার তাগাদা দিয়েছেন। টাকা না দেওয়ায় ওই নারী সংসদ সদস্যের দলীয় পদ স্থগিত করা হয়েছে। এসব কিসের আলামত।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে অর্থের বিনিময়ে রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে এরশাদের নামটি বরাবরই সামনের দিকে থাকবে। জিয়াউর রহমান নাকি বলেছিলেন ‘মানি ইজ নো প্রবলেম। আই উইল মেক পলিটিক্স ডিফিকাল্ট।’ আর এই কথাকে এরশাদ কার্যত প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করেছেন। এরশাদের বিরুদ্ধে যেভাবে একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে তা কি দেশের একজন রাষ্ট্রনায়কের পদের সঙ্গে মানানসই ছিল? দুর্নীতির অভিযোগে সাজাপ্রাপ্ত সাবেক এই স্বৈরশাসকের বয়স ৯০ ছুঁই ছুঁই। অশীতিপর বৃদ্ধ এই রাজনীতিক যেভাবে অন্যায়-অনৈতিকভাবে টাকার পেছনে ছুটেছেন তা-কি আমাদের রাজনৈতিক ও রাজনীতিকদের জন্য অসম্মানজনক নয়? কোথায় গিয়ে থামবেন এরশাদ? আর কত চাই তার। এই প্রশ্নের উত্তর জানা জরুরি।

লেখক: সম্পাদক, দৈনিক ঢাকা টাইমস, ঢাকা টাইমস২৪ ডটকম ও সাপ্তাহিক এই সময়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

রাজপাট বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা