এক অংকের সুদ বাস্তবায়নে আর কত অপেক্ষা?

প্রকাশ | ১৯ জুন ২০১৯, ১৪:০৩

সোনিয়া খান লিমা

‘সমৃদ্ধ আগামীর’ প্রত্যাশা সামনে রেখে নতুন অর্থবছরের (২০১৯-২০২০) জন্য পাঁচ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেট পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এটি দেশের ৪৮তম এবং বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদের প্রথম বাজেট। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বাজেট এটি। আশাব্যঞ্জক হলো এই যে সরকার ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমিয়ে এক অংকে (সিঙ্গেল ডিজিট) আনতে বদ্ধপরিকর বলে জানিয়েছে। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে তা উদীয়মান শিল্পের ক্রমবিকাশ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের অগ্রগতি, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ গঠনে ব্যাপক ভূমিকা পালন করবে বলেই বিশ্বাস। কিন্তু হতাশাজনক হলেও সত্য যে, ব্যাংকের উদ্যোক্তারা ঋণের সুদ এক অংকে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সরকারের কাছ থেকে নানা সুবিধা আদায় করে নেওয়ার পর এক বছর অতিক্রান্ত হলেও এখনো সুদ এক অংকে নামেনি। তাই সুদ এক অংকে নামিয়ে আনার বিষয়টি আদৌ বাস্তবায়ন হবে কি-না, সে বিষয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।

প্রায়ই দেখা যায় যে, ব্যাংকগুলো বড় ব্যবসায়ীদের ঋণ দিলেও ক্ষুদ্র অথবা মাঝারি ব্যবসায়ীরা তা থেকে বঞ্চিত হয়। অন্যদিকে ডাবল ডিজিটের বড় সুদের বোঝা বহন করা দুরূহ বিধায় তারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিতেও অনিচ্ছা প্রকাশ করে। এতে দিনকে দিন অনুন্নত অবস্থায় পড়ে থাকে সম্ভাবনাময় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পখাতগুলো। শিল্পের ক্ষেত্রে যদি সহজ শর্তে সিঙ্গেল ডিজিটে ঋণ পাওয়া যায়, তা অবশ্যই তরুণ উদ্যোক্তাদের উদ্যোগী হতে সহায়তা করবে, তরান্বিত হবে ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি ও বিনিয়োগ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে এক বছর আগে অর্থাৎ ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসের চিত্র ছিল ভয়াবহ। ওই প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ওই সময় শিল্পের জন্য ছোট ও বড় সব ধরনের ব্যবসায়িক ব্যাংক ঋণে দুই অঙ্কের সুদ গুণতে হয়েছে। ওই সময় শিল্প প্রতিষ্ঠানে দেওয়া ঋণের বিপরীতে ১৫ শতাংশেরও বেশি হারে সুদ আরোপ করছে কোনো কোনো ব্যাংক। এর আগে দেশকে বিনিয়োগবান্ধব, শিল্পবান্ধব, নতুন উদ্যোক্তা তৈরি, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ও রপ্তানি বাণিজ্য গতিশীল করতে সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনতে সরকার নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নেয়। সরকারের এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে গত বছরের ২০ জুন ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার ঘোষণা দেয় বেসরকারি ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি)। এই সিদ্ধান্ত গত বছরের ১ জুলাই থেকে কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। সাম্প্রতিক সময়ে ঋণের সুদহার ব্যাংক ভেদে ১২ থেকে ১৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। যদিও সরকার ব্যাংকগুলোকে ৯ শতাংশ সুদে ঋণ বিতরণ এবং ৬ শতাংশে সুদে আমানত সংগ্রহের নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু সরকারি ব্যাংকগুলো ছাড়া বেসরকারি ব্যাংকগুলো এ নির্দেশমতো কাজ করেনি।

বিশ্লেষকদের মতে, সব সুবিধা ব্যাংকের পরিচালকরাই পাচ্ছেন। নিজেরা ভাগাভাগি করে বড় অঙ্কের ঋণ নেওয়ার পাশাপাশি এখন সিঙ্গেল ডিজিটেও ঋণ সুবিধা নিতে তারা সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। যেসব ব্যাংক সিঙ্গেল ডিজিটে শিল্পঋণ দেওয়ার দাবি করছে, তারা হয়তো তাদের পরিচালকদের এ সুবিধা দিচ্ছে। ব্যাংক পরিচালকদের ঋণ ভাগাভাগির মতো সিঙ্গেল ডিজিটের সুবিধাও এখন ভাগাভাগি হয়ে যাচ্ছে। আর এরা রাজনৈতিকভাবে এতটাই প্রভাবশালী যে, বাংলাদেশ ব্যাংকও এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না।

এমতাবস্থায় সিঙ্গেল ডিজিট বাস্তবায়ন করাটাও সরকারের জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়াবে বলে মনে করি। যদিও সরকারি ব্যাংকগুলা নিদের্শনা অনুসরণ করছে। কিন্তু বেসরকারি ব্যাংকগুলো এই নির্দেশনা মানছে না। কেননা তারা যে হারে আমানত পাবে, তার সঙ্গে পরিচালন খরচ আর মুনাফা যোগ করেই ঋণের সুদের হার ঠিক করে নেয়। বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপকদের ভাষ্যমতে তারা কেন লোকসান করে ঋণ দিতে যাবে? এমনকি সরকারি আমানতও কম সুদে নিতে পারছে না। তাহলে তারা কীভাবে সিঙ্গেল ডিজিটে ঋণ দেবে? যদি এটা তাদের নিশ্চিত করা যায় যে, তারা কম আমানত পাবে, সরকারি আমানতগুলো যদি তাদের কাছে কম সুদে রাখা হয়, যদি অন্যান্য প্রতিষ্ঠান এভাবে কম সুদে আমানত গ্রহণ করে তবেই তারা ঋণের সুদের হার কমাতে পারবে। মজার বিষয় হলো একেকটা ব্যাংক একেকভাবে চলছে। পাশাপাশি নন ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো চলছে আরেকভাবে। কিন্তু তারাও আমানত নিচ্ছে, ঋণ দিচ্ছে। ফলে বাজারে একটি অসমতার পরিবেশ তৈরি হয়েছে। ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমাতে হলে আমানতের সুদ কমাতে হবে। ফলে ঋণের সুদের হার কমালে যেমন ব্যবসায়ীরা লাভবান হবেন, কিন্তু আমানতের সুদের হার কমালে আবার সঞ্চয়কারীরা ব্যাংক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন। কিন্তু সমস্যা হলো, ব্যাংকের আমানতের হার কমে গেলে তখন ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীরা নিরুৎসাহিত হয়ে বিকল্প বিনিয়োগের পথ খুঁজেন। ঝুঁকির কারণে তারা শেয়ারবাজারে বেশি যান না, তখন তারা সঞ্চয়পত্র, জমি ক্রয় ইত্যাদিতে বিনিয়োগ করেন। ফলে ব্যাংকগুলো বড় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ না পেলে তখন তাদের জন্যও আমানত সংগ্রহ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে।

আমি মনে করি, সরকার যদি সত্যিই চায় যে, ব্যাংকের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনবে, তাহলে হয় সরকারি নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে হবে অথবা সব ব্যাংক এবং নন ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা করে আমানত আর ঋণের সুদের হার ঠিক করতে হবে। আবার ব্যাংকের পরিচালন ব্যয় যদি কমানো যায়, তাদের ব্যবস্থাপনা দক্ষতা যদি আরো বাড়ানো যায়, তাহলে তারা ঋণের সুদের হারও কমাতে পারবে সাময়িকভাবে।

এবার ঋণখেলাপির প্রসঙ্গে বলা যাক, সরকারের ভাষ্যমতে সর্বত্র ব্যাংকিং সেক্টরে সিঙ্গেল ডিজিট চালু হলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। যদিও এটা নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে অর্থনীতি অঙ্গনে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ১০ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা। এর ফলে প্রথমবারের মতো অবলোপনের হিসাব বাদে খেলাপি ঋণ লাখ কোটি টাকা ছাড়াল। গত মার্চ শেষে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল নয় লাখ ৩৩ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে এক লাখ ১০ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা। ২০১৮ সাল শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। এখন কথা হচ্ছে, গৃহীত পদক্ষেপের মাধ্যমে সরকার সফল হবে খেলাপি ঋণের হার কমিয়ে আনতে? কেননা বড় খেলাপিরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে। এর পেছনে আছে প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ অথবা রাজনৈতিক চাপ। বর্তমানে ব্যাংক ব্যবস্থা সম্পূর্ণই রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় পরিচালিত হচ্ছে। জবাবহীনতা, স্বজনপ্রীতি, অদক্ষতা, ব্যবস্থাপনা দিনকে দিন ব্যাংক ব্যবস্থাটিকে করে দিয়েছে স্থবির। ব্যাংক ব্যবস্থায় খেলাপি ঋণের অপসংস্কৃতি একদিনে গড়ে ওঠেনি। ঋণ গ্রহীতাদের অনেকে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী অথবা প্রভাবশালী কারো সহায়তায় ঋণ পেয়েছে। যে কারণে তারা ঋণ ফেরত না দেবার সুযোগ নিচ্ছে। এতে করে সিঙ্গেল ডিজেট সুদ খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে সক্ষম হবে না। কেননা বড় খেলাপিদের ক্ষেত্রে ০% সুদ ধার্য করা হলেও তারা তা পরিশোধ করবে না। যতক্ষণ পর্যন্ত ব্যাংক খাতে সুষ্ঠু জবাবদিহিমূলক প্রশাসন, স্বচ্ছ ও কার্যকরী মুদ্রানীতি নিশ্চিত হবে। যদিও এটা আমার নিজস্ব মতামত। আর আশাব্যঞ্জক যে সরকার যেহেতু প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠিন পদক্ষেপ নেওয়া হবে এবং বিদ্যমান ব্যাংক-কোম্পানি আইন সংশোধন করে যুগোপযোগী করা হবে। আমরা চাই সরকার এসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে সাধারণ জনগণের আস্থা অর্জনে সচেষ্ট হবে।

লেখক: বিবিএ, চতুর্থ বর্ষ, অ্যাকাউন্টটিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস, ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।