চে গুয়েভারা

তেতে থেকে কমান্ডার তাতু

প্রকাশ | ১৯ জুন ২০১৯, ১৪:৩৭

শাহ বুলবুল

লা কাবানা দুর্গের অধিপতি আর্নেস্তো চে গুয়েভারা ইতিহাসের এক করুণ আর্তি। জীবনের দামে তিনি সভ্য দুনিয়াকে শুনিয়ে গেছেন মানুষের প্রথম কর্তব্য মানবতার জন্য সংগ্রাম করা। এজন্য মৃত্যু কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো একজনের আদর্শের জন্য সংগ্রাম করা। গেরিলা যুদ্ধের রক্তভূমি আর্নেস্তো চে গুয়েভারার প্রকৃত নাম ডা. আর্নেস্তো গুয়েভারা দে লা সেরনা। ডাক নাম লা চে বা চে। গৃহী নাম তেতে। ডাক্তার হচ্ছে চে গুয়েভারার পেশাগত পদবি, আর্নেস্তো হলো চে গুয়েভারার পিতার নামের প্রথম অংশ এবং সেরনা তার মায়ের নামের শেষ  শব্দ বা পদবি। তবে জনযুদ্ধের মহানায়ককে দুনিয়াময় চিনে আর্নেস্তো চে গুয়েভারা বা চে নামে।

বিপ্লবী চে গুয়েভারার জন্ম ১৪ জুন ১৯২৮ সালে আর্জেন্টিনার সান্তা ফে প্রদেশের রোজারিও শহরে। ছোট্ট আর্নেস্তোকে নিয়ে তার বাবা মা সংসার পাতেন পারানা নদীর কাছাকাছি মিসিওনেস অঞ্চলের পুর্তো ক্যারাগুয়াতায়। সেই সময় নিবিড় জঙ্গলবেষ্টিত ক্যারাগুয়াতার বাসায় আর্নেস্তোর ধাত্রী হয়ে আসেন স্পেনের গালিসিয়ি থেকে অভিবাসী হয়ে আর্জেন্টিনায় আসা নীল চোখা এক মায়াবী নারী কারমেন এরিয়াস। এই নীল চোখা মায়াবী নারী কারমেন এরিয়াস ছোট্ট আর্নেস্তোকে মায়ের মতোই লালন করতেন এবং আদর করে ডাকতেন তেতে। পরবর্তী সময়ে শিশু আর্নেস্তোকে বাড়ির সবাই তেতে বলেই ডাকতেন এবং তেতে নামটি একসময় তার গৃহী নাম হিসেবে বজায় থাকে। কারও কারও মতে শিশু আর্নেস্তোর কোনো এক জন্মদিনে তার বাবা মা আদর করে তেতে নামটি রাখেন। তবে এই ধারণাই বেশি বদ্ধমূল যে, ছোট্ট আর্নেস্তোর গালিসিয়ান মা কারমেন এরিয়াস আদর করে আর্নেস্তোকে তেতে বলে ডাকতেন যা পরবর্তী সময়ে তার গৃহী নাম হিসেবে ব্যবহার হয়।

১৯৫৬ সালে মেক্সিকো থেকে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে কিউবা আক্রমণের পর নিখোঁজ আর্নেস্তো চে গুয়েভারার নিজের সর্বশেষ অবস্থা জানিয়ে সিয়েরা মায়েস্ত্রা পর্বতমালার কাছাকাছি জঙ্গল থেকে আর্জেন্টিনায় বাবা মাকে একটি চিঠি লেখেন। ১৯৫৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর অজানা লোক মারফত হাতে হাতে প্রাপ্ত চিঠিতে আর্নেস্তো নিজের নাম লিখেছিলেন তেতে। এর পরের বছর ১৯৫৭ সালে  কিউবার মুক্তি ফৌজ রেভেল আর্মির কমান্ডার হয়ে মানজানিলো থেকে বাবা মাকে লেখা চিঠির শেষে বিপ্লবী চে নিজের নাম লেখেন তেতে। এভাবেই পারিবারিক চিঠিতে আর্নেস্তো চে গুয়েভারা তার শৈশবে রাখা তেতে নামটি ব্যবহার করতেন।

কৈশোরে রাগবি খেলায় দুর্বার গতির জন্য বন্ধুরা তার নাম দিয়েছিল ফিউজার। ১৯৪৭ সালে করদোবা থেকে বুয়েন্স আয়ার্সে আসার পর আর্নেস্তো সান ইসিড্রো ক্লাবে রাগবি খেলতেন। চে’র সহ খেলোয়াড়দের অধিকাংশই ছিল তার কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সহপাঠী। এসময় আর্নেস্তো, ছোট ভাই রবার্তো গুয়েভারা এবং কয়েজন বন্ধুকে সাথে নিয়ে ‘ট্যাকল’ নামক একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। বাড়িতে বাবার পড়ার ঘরটি হয়ে গেল পত্রিকার অফিস আর লিখতেন চানচো বা চাচো নামে। চাচো’র ইংরেজি হলো পিগ অর্থাৎ শুকর ছানা। আর্নেস্তো নিয়মিত গোসল করতেন না এবং জামা কাপড় বদলাতেন সপ্তাহে একবার। এই অপরিচ্ছন্ন চলাফেরার জন্য বন্ধুরা তাকে চাচো বলে ডাকতো। পরবর্তী সময়ে আর্নেস্তো পারিবারিক চিঠিপত্রে চাচো নামটি ব্যবহার করতেন।

একটা ক্রসরোডের সন্ধানে ১৯৫৩ সালের ৭ জুলাই শেষবারের মতো পিতৃভূমি আর্জেন্টিনা ত্যাগ করেন চে। বলিভিয়া থেকে আসেন ইকুয়েডর, এরপর পানামা থেকে কোস্টারিকা। নিকারাগুয়া সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আসেন গুয়াতেমালায়। ১৯৫৩ সালের ১০ ডিসেম্বর কোস্তারিকার সান হোসে থেকে আর্জেন্টিনায় ফুফু বিয়োত্রিজকে পথের বাস্তবতা ও পুঁজিবাদীদের ভয়ঙ্কর শোষণের কথা জানিয়ে চিঠি লেখেন। ফুফুর উদ্দেশে লেখা এই চিঠির শেষাংশ ছিল ‘তোমার ভাতিজার চুমু এবং ভালোবাসা নিও। তোমার ভাতিজা এমন একজন মানুষ যার লোহার মতো শরীর। যার পেটে ক্ষুধা এবং চোখে সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন। বিদায় চাচো। ১৯৫৭ সালের ২৮ জানুয়ারি কিউবার সীমান্তবর্তী জঙ্গল থেকে পেরুর লিাময় বসবাসরত স্ত্রী  হিলদা গাদেয়া আকোস্তাকে লেখা চিঠির সর্বশেষ কথা ছিল চাচোর আদর নিও।

চে তাঁর ছোট ফুফু বিয়োত্রিজকে খুব ভালোবাসতেন। জীবনের প্রায় সব কথা বা অভিজ্ঞতা জানাতেন ফুফুকে। লাতিন আমেরিকা সফর থেকে কিউবা বিপ্লব পর্যন্ত জীবনের প্রতিটি দুর্বার সময়ে চিঠি লিখতেন ফুফুকে। খুব ভালোবাসতেন আবার ক্ষেপাতেনও। লাতিন আমেরিকা সফরের শেষ দিকে চে মেক্সিকো আসেন এবং কিউবা বিপ্লবের পথে পা বাড়ান। ১৯৫৫ সালের ৯ এপ্রিল মেক্সিকো থেকে আর্নেস্তো তার ফুফু বিয়োত্রিজকে লেখা চিঠির শেষ দুই চত্র ছিলÑ সম সময়ের আদরের। স্টালিন ২য়।

কমরেড আর্নেস্তো চে গুয়েভারা ডাক্তারি পাসের পর একের পর এক দেশ পাড়ি দিয়ে ১৯৫৩ সালে ১৪ ডিসেম্বর গুয়াতেমালা আসেন এবং ৩ জানুয়ারি ১৯৫৪ সালে পরিচিত হন নিকো লোপেজ নামের এক কিউবান বিপ্ল¬বীর সাথে। এই নিকো লোপেজ আর্নেস্তোর নাম রাখেন এল চে। যা পরবর্তী সময়ে চে নামে বিশ্বময় পরিচিতি পায়। সেসময় আর্জেন্টিনা থেকে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় আগত লোকদেরকে চে বলে সম্বোধন করা হতো। মনে করা হয়, দক্ষিণ আমেরিকার আদিবাসী ভাষা গুয়ারানি অথবা চিলির মাপুচে আদিবাসীদের ভাষা থেকে চে শব্দটি ব্যবহার হয়ে আসছে। ১৯৫৬ সালের ১৫ জুলাই মেক্সিকোর জেল থেকে আর্নেস্তো তার মা সেলিয়া দে লা সেরনার কাছে যে চিঠিখানা লেখেন তার শেষে লেখা ছিল চে। ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৬৫ পর্যন্ত আর্নেস্তো চে গুয়েভারা কিউবার শিল্পমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান থাকাকালীন সময় কিউবান নোটে তার স্বাক্ষর ছিল চে।

১৯৬৫ সালের ১ এপ্রিল, হাভানা থেকে কিউবার কৃষি বর্ষে মিনিস্টার চে চারটি বিদায়ী চিঠি লেখেন। একটি কিউবার রাষ্ট্রপতি সহযোদ্ধা ও বন্ধুবর ফিদেল কাস্ত্রোকে, অন্য তিনটি বাবা মা, সন্তানদের প্রতি এবং বড় মেয়ে হিলদিতাকে। সহযোদ্ধা ফিদেলকে চিঠি দিয়ে মন্ত্রিত্ব, মেজরের পদ, কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ এমনকি কিউবার নাগরিকত্ব পর্যন্ত ত্যাগ করেন। বিদায়ের শেষ বেলায় সেদিন গেরিলা দুর্গের প্রিয় বন্ধু ফিদেলকে লেখা চিঠির শেষ কথাগুলোÑবিজয়ের পথে এগিয়ে চলো। স্বদেশ অথবা মৃত্যু। সবটুকু বিপ্ল¬বী উষ্ণতা দিয়ে তোমাকে আলিঙ্গন করছি। চে।

এছাড়াও তিনি নাম হিসেবে ডা. আনেস্তো চে গুয়েভারা, মেজর আর্নেস্তো চে গুয়েভারা লিখতেন। কিউবা বিপ্লবের পরপর লেখা বিভিন্ন চিঠিতে নিজের পরিচয় হিসেবে লিখতেন ডা. আর্নেস্তো চে গুয়েভারা, কমান্ডার ইন চিফÑলা কাবানার সামরিক বিভাগ। ১৯৫৯ সালের ৭ জুন কিউবার হাভানা থেকে আর্জেন্টিনার লাস হেরাসে বন্ধু রিকার্দো গোমেজকে একটি সংক্ষিপ্ত চিঠি লেখেন চে। চিঠিতে অল্প কথায় বন্ধু রিকার্দোকে কিউবা আক্রমনের পর সিয়েরামায়েস্ত্রায় গেরিলা যুদ্ধের অবস্থা জানান। আর্জেন্টিনার লাস হেরাসে বন্ধুকে লেখা চিঠির শেষে তার পরিচয় ছিলÑডা. আর্নেস্তো চে গুয়েভারা, কমান্ডার ইন চিফ, লা কাবানার সামরিক বিভাগ। পরবর্তী সময়ে চে গুয়েভারা কিউবায় বিদ্রোহী সেনাবাহিনীর মেজর পদবি লাভ করেন এবং বিভিন্ন চিঠিতে নিজের পরিচয় মেজর আর্নেস্তো চে গুয়েভারা উল্লেখ করেন।  ১৯৬১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি হাঙ্গেরিতে ড. ফার্নান্দো বারালকে, ১৯৬৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ব্রাজিলের বেলেম পারায় সিনর রার্তো লাস কাসাসকে এবং ১৯৬৪ সালের ২১ আগস্ট স্পেন থেকে মেক্সিকোতে নির্বাসিত কবি লিয়ন ফেলিপকে লেখা চিঠির শেষে চে’র কথাগুলো ছিল একই অর্থাৎ স্বদেশ অথবা মৃত্যু। ভেনসেরেমোস। মেজর আর্নেস্তো চে গুয়েভারা।

১৯৬৫ সালের ২৪ এপ্রিল ১২ জন কমরেডসহ চে গুয়েভারা কিউবা ছেড়ে পা রাখেন কঙ্গোর মাটিতে। ঘাঁটি  করেন কঙ্গোর দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত ফিজি গ্রামের কাছাকাছি তাংগানিকা লেকের গহীন জঙ্গলে। কঙ্গোর হাড্ডিসার কালো মানুষদের চোখে মুখে বিপ্ল¬বের আগুন ছড়িয়ে ছিলেন চে। কঙ্গোতে চে লুমুমবা গেরিলা ব্যাটেলিয়ানের দায়িত্ব নিয়ে এমন একটা গেরিলা দলের স্বপ্ন দেখতেন যারা জীবন মৃত্যুর মাঝাখানে দাঁড়িয়েও যুদ্ধ করবে। কঙ্গোর জঙ্গল থেকে শহরের রাস্তাগুলোতে বিপ্লবের আগুন ছড়িয়ে দিতে চলছিল রক্ত জল করা গেরিলা প্রশিক্ষণ। তাংগানিকার অসহায় মানুষ তাদের প্রিয় বিপ্লবীকে ডাকতেন মুগান্দা বা ত্রাণকর্তা নামে আর গেরিলা যোদ্ধাদের কাছে তার পরিচয় ছিল কমান্ডার তাতু।

মেশিনগানে আগুন ঝরানো গেরিলা কমান্ডার আর্নেস্তো চে গুয়েভারা আরেকটা স্বাধীন দেশের স্বপ্নে বলিভিয়ার নাকাহুয়াজু নদীর কাছাকাছি কালামিনার দুর্গম খামারে আসেন ১৯৬৬ সালের ৭ নভেম্বর। ওইদিন থেকে ১৯৬৭ সালের ৭ অক্টোবর শত্রু বাহিনী দ্বারা বন্দীর কয়েক ঘণ্টা আগ পর্যন্ত গেরিলা জীবনের প্রতিটি দিন লিখে গেছেন। বিশ্বময় যার পরিচিত নাম বলিভিয়ার ডায়েরি। গেরিলা জীবনের মৃত্যুময় দিনগুলো লিখতে গিয়ে আর্নেস্তো চে গুয়েভারা র‌্যামন, ফার্নান্দো এবং মঙ্গো নাম ছদ্মাকারে ব্যবহার করেছেন।  

লেখক: কলামিস্ট