নিম্নবিত্তের প্রাথমিক, উচ্চবিত্তের কিন্ডারগার্টেন?

ওয়াসেক বিল্লাহ
| আপডেট : ২১ জুন ২০১৯, ১৩:২৩ | প্রকাশিত : ২১ জুন ২০১৯, ১২:০৩
দেশে এমন ঝুঁকিপূর্ণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে বহু

মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম। সরকারি চাকুরে বাবা। কাজ করতেন ব্যাংকে। অর্থকষ্ট ছিল না, তবে হিসেবি মানুষ, বিলাসিতা করেননি কখনো। জন্ম ময়মনসিংহে, বেড়ে উঠা কিশোরগঞ্জ আর নেত্রকোণায়। প্রাথমিকে ভর্তি প্রথমে কিশোরগঞ্জ, পরে নেত্রকোণা আর পরে আবার কিশোরগঞ্জ।

তখনই মফস্বলে একটি দুটি করে কিন্ডারগার্টেন স্কুল গড়ে উঠেছে। তবে সেখানে ভর্তির চল তেমন ছিল না।

এটা ৮০র দশকের মাঝামাঝি সময়ের কথা। ৯০ দশক পেরিয়ে বিংশ শতকে পদার্পনের পর মফস্বলের জেলা সদর, উপজেলা শহর এমনকি গ্রাম পর্যায়েও গড়ে উঠছে কিন্ডারগার্টেন স্কুল। মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত বা ব্যবসা বাণিজ্য বা অন্য পন্থায় ভালো পয়সা কড়ি করেছে, এমন পরিবারের সন্তানদের এখন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠানো হচ্ছে কমই।

রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম বা এই ধরনের বড় শহরে আর্থিক দিক দিয়ে স্বচ্ছল পরিবারের কেউ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে, এই বিষয়টি একেবারেই ব্যতিক্রম। আসলে শহরের সরকারি স্কুলগুলোই কেমন যেন মৃয়মান হয়ে পড়েছে। মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো এখন যেমন নাক সিঁটকানো শুরু করেছে।

বিষয়টা এমন দাঁড়িয়েছে, নিম্নবিত্তের সন্তানরা পড়বে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, কিছুটা সম্পদশালীরা কিন্ডারগার্টেন আর তার চেয়ে বেশি যাদের অর্থ তারা ইংলিশ মিডিয়ামে।

ভাবছি, যদি শিক্ষা জীবনের শুরু থেকে এভাবে শিশুরা আলাদাভাবে দল বেঁধে থাকে, তাহলে উচ্চবিত্ত আর নিম্নবিত্ত-দুই শ্রেণি পরস্পরের বিষয়ে কী করে জানবে? আমরা যখন পড়াশোনা করেছি, তখন স্কুলে, কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে একেবারে নিম্ন আয়ের পরিবার থেকে উঠে আসা বন্ধু যেমন ছিল, তেমনি মধ্যবিত্ত আর উচ্চবিত্তের সন্তানরাও ছিল আমাদের বন্ধু। এতে পরস্পরের প্রতি এক ধরনের আত্মিক টান সব সময় ছিল। এখনো আমার স্কুল জীবনের বহু বন্ধু আছে যারা খুব ভালো চাকরি করে না। আবার এমন বন্ধু আছে যারা ভীষণ ভালো করেছে ক্যারিয়ার বা অর্থকড়ির দিক দিয়ে। যারা ভালো করেছে, তারা কেউ যারা ভালো করেনি, তাদেরকে ছোট করে দেখে না।

শ্রমজীবী মানুষদের প্রতি এক ধরনের মমত্ববোধ কাজ করে এ কারণে যে, আমার পরিচিত বহুজনও তাদের মতোই পরিস্থিতিতে আছে-এটা আমি জানি। যারা আমাদের চেয়ে ভালো আছে, তারাও যারা তাদের তুলনায় ভালো করেনি, তাদের প্রতি মমত্ববোধ নিয়ে চলে বলেই দেখেছি।

কিন্তু ইদানীং দেখছি, নিম্ন আয়ের শিশুরা নিজেদের মধ্যেই বন্ধুত্ব করে, উচ্চবিত্ত বা উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণির সন্তানদের আলাদা জগত তৈরি হচ্ছে। তাদের একটি শ্রেণির সদস্যরা জানে না অন্য শ্রেণির জীবনাচরণ। অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে থাকা দেশে যে সামাজিক বৈষম্য নিয়ে অনেক কথাবার্তা হচ্ছে, সেখানে শিক্ষার এই বৈষম্য ভবিষ্যতে আরো কী নেতিবাচকতা নিয়ে আসবে আমাদের জন্য, সেটা কে জানে।

সবচেয়ে হতাশার কথা, এই বিষয়টি নিয়ে সরকারি নীতি নির্ধারণী মহল বা শিক্ষাবিদদের মধ্যে কোনো ভাবনা আছে বলে দেখছি না। তারা হয় বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারছেন না, অথবা এড়িয়ে চলছেন।

ঈদে বাড়ি গিয়ে কিন্ডারগার্টেনে পড়া ভাগ্নির বইগুলো উল্টে দেখে হতাশ হলাম। পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় বানান ভুল। কে দেখে এসব বই। সরকারি পাঠ্যক্রমের বই দেখার জন্য তো আলাদা কমিটি আছে। কিন্তু লাখ লাখ শিশু কী পড়ছে, তা দেখার জন্য সরকারের কেউ নেই?

আর সরকারি পাঠ্যক্রমগুলো একটি চিন্তা থেকে তৈরি করা হয়। কিন্তু কিন্ডারগার্টেনের পাঠ্যক্রম সরকারের কেউ দেখে দেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করে কি না, তাও জানি না।

আমার ভাগ্নি বা সন্তানকে যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠাব, সে পরিস্থিতিও তো আর নেই। এটাই সবচেয়ে বড় হতাশার কথা। প্রাথমিকে সরকারি যে শিক্ষা, সেটা যদি সব শিশু না পায়, তাহলে সুনাগরিক, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ, মানবিক ভবিষ্যত প্রজন্ম কতটা পাওয়া যাবে?

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :