তাদেরকে কে নিয়ে যায়?

প্রকাশ | ২১ জুন ২০১৯, ১২:৩৫

সিরাজুম সালেকীন

রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নানা সময় নিখোঁজ হয়ে ফিরেছেন ব্যবসায়ী, চিকিৎসক, সাংবাদিক, রাষ্ট্রদূত, শিক্ষক। তাদের অন্তর্ধান আর ফিরে আসা, সবই রহস্য হয়ে রয়েছে। ভুক্তভোগী কেউ কখনো মুখ খোলেনি, আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও তদন্ত করেনি, বা করলেও এর ফলাফল জানাতে চায় না।

এর মধ্যে সবশেষ সংযোজন আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তানজীম আহমেদ সোহেল তাজের ভাগ্নে সৈয়দ ইফতেখার আলম সৌরভ। নিখোঁজ হওয়ার ১১ দিন পর বৃহস্পতিবার ময়মনসিংহের তারাকান্দা এলাকায় রাস্তার ধারে তাকে পাওয়া যায়। আগের বহু উদাহরণের মতো সৌরভের অন্তর্ধান রহস্যও এখনো অজানা।  

নিখোঁজ হয়ে যাওয়া বহু মানুষ অবশ্য কখনো ফিরে আসেনি। তাদেরকে কারা তুলে নিয়ে গেছে, তাও জানা যায় না। অবশ্য বহু ক্ষেত্রে অভিযোগ থাকে সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে। যদিও কোনো বাহিনীই কিছু স্বীকার করে না। আইনশৃঙ্খলাবাহিনী বলছে, তারা কাউকে গ্রেপ্তার করলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আদালতে প্রেরণ করে। তাদের পরিচয়ে দুবর্ৃৃত্তরা এসব করে অথবা কেউ স্বেচ্ছায় নিখোঁজ হয়। তবে এই ‘দুর্বৃত্ত’ কারা, তাও উদঘাটন করতে পারেনি বাহিনীগুলো। আর এই অন্তর্ধান বা নিখোঁজের বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বহু কথা হয়। সরকারকে নানা বক্তব্যের জবাব দিতে হয়।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘এই যে নিখোঁজের ঘটনাগুলো ঘটছে এটা অনাকাক্সিক্ষত, যেটা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য না। প্রশাসনের দায়িত্ব হচ্ছে এগুলো কারা করছে তাদের খুঁজে বের করা এবং তাদের আইনের আওতায় আনা। ’

গত ৯ জুন সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম নগরীর পাঁচলাইশ থানাধীন আফমি প্লাজার সামনে থেকে নিখোঁজ হন সোহেল তাজের ভাগ্নে সৌরভ। অভিযোগ, চট্টগ্রামের এক বড় ব্যবসায়ীর মেয়ের সঙ্গে ছেলেটির সম্পর্ক ছিল। আর এর সঙ্গেই তার অন্তর্ধানের সম্পর্ক রয়েছে। তবে এই অভিযোগের সত্যতা কতটুকু, তা জানার কোনো সুযোগ নেই।

এর আগে ২০১৬ সালের ২১ জানুয়ারি রাজশাহী থেকে নিখোঁজ হন বেসরকারি এক্সিম ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা এ আর এম আখতারুজ্জামান কচি। ১৩ দিন পর তাকে পাওয়া যায় টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে। মাইক্রোবাস থেকে তাকে হাত ও চোখ বাঁধা অবস্থায় রাস্তার পাশে ফেলে রাখা হয়।

২০১৬ সালের ৫ আগস্ট চট্টগ্রাম মহানগরী থেকে নিখোঁজের চার দিন পর সন্ধান মেলে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র জুনায়েদ হোসেন আকিব ও তার গাড়িচালক মোস্তফার। তাকেও চোখ বাঁধা অবস্থায় মধ্যরাতে রাস্তায় ফেলে রাখা হয়।

কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ছাত্রী নিহত সোহাগী জাহান তনুকে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনায় মানববন্ধন করেছিল তারই ভাইয়ের বন্ধু মিজানুর রহমান সোহাগ। ২০১৬ সালের ২৭ মার্চ বাড়ি থেকে তাকে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৬ দিন পর তাকে চোঁখ বাধা অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। কিন্তু কোনো বাহিনীই তাকে তুলে নেওয়ার কথা স্বীকার করেনি।

২০১৭ সালের ২৫ এপ্রিল ডিবি পরিচয়ে বাসা থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ময়মনসিংহের স্থানীয় কওমি মাদ্রাসা ‘ছাওতুল হেরা’র শিক্ষক মাওলানা শহীদুল্লাকে। দেড় মাস পর তাকে রাস্তার পাশে ফেলে রেখে যাওয়া হয়।

নিখোঁজের প্রায় আড়াই মাস পর অনলাইন নিউজ পোর্টাল পূর্ব পশ্চিমের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক উৎপল দাসকে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার আধুরিয়া এলাকায় একটি পেট্রল পাম্পের কাছে ফেলে রেখে যাওয়া হয়। ২০১৭ সালের ১০ অক্টোবর থেকে নিখোঁজ ছিল অনলাইন পত্রিকার এই সাংবাদিক।

সাবেক রাষ্ট্রদ্রুত মারুফ জামান ২০১৭ সালের ৪ ডিসেম্বর হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ছোট মেয়ে সামিহা জামানকে আনতে ধানমন্ডির বাসা থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হন। সাড়ে ১৫ মাস পর এই বছরের ১৬ মার্চ তাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে যাওয়া হয়।

২০১৭ সালের ৭ নভেম্বর নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মোবাশ্বার হাসান সিজার নিখোঁজ জন। ৪৪ দিন পর কে বা কারা তাকে রাজধানীর বিমানবন্দর এলাকায় নামিয়ে দিয়ে যায়। এরপর তিনি একটি অটোরিকশা ভাসা করে বনশ্রীর বাসায় ফেরেন।

ফিরে এসে ভুক্তভোগী কেউ বা তাদের স্বজনরা কোনো কথাই বলতে চাননি গণমাধ্যমের কাছে। প্রতিটি ঘটনায় সাধারণ ডায়েরি হলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করেছে, এমন কোনো প্রমাণ মেলেনি।

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার মাসুদুর রহমান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘ভিকটিমের যদি অভিযোগের করে তাহলে মামলা হয়। মামলার পরিপেক্ষিতে আমরা অনেককে শনাক্ত করতে পারি। আবার অনেক সময় চলমান তদন্ত থাকে। এই রকম অনেক নজির পুলিশ দেখিয়েছে।’

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যমে শাখার পরিচারক (চলতি দায়িত্ব) এমরানুল হাসান বলেন, ‘বিভিন্ন চক্র আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর পরিচয় দিয়ে অনেককে তুলে নিয়ে যাওয়ার এমন নজির আছে। একটি চক্র আমরা এর আগে গ্রেপ্তার করেছি। তারা প্রশাসনের পরিচয় দিয়ে এই ধরণের অপহরণের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। তাছাড়া অনেকে নিজে থেকে আত্মগোপনে থেকে অন্যকে ফাঁসাতে চায়।’

‘র‌্যাব কাউকে গ্রেপ্তার করলে অবশ্যই সাংবাদমাধ্যমকে জানায় এবং নির্দিষ্ট সময়ে আদালতে হাজির করে। এখানে লুকানোর কিছু নেই। তবে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী কাউকে তুলে নিয়ে দিনের পর দিন নিখোঁজ রাখে বলে আমার জানা নেই।’

ঢাকাটাইমস/২১জুন/এসএস/ডব্লিউবি