দাম বাড়ানোয় ধূমপান কমবে, যুবসমাজ বাঁচবে

প্রকাশ | ২২ জুন ২০১৯, ২০:৫৫

সোনিয়া খান লিমা

বিশ্বব্যাপী ধূমপানবিরোধী রাষ্ট্রীয় নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান, তামাকজাত পণ্যের ব্যবহার কমানো এবং রাজস্ব আয় বৃদ্ধি এ তিনটি বিষয়ের সমন্বয়ে তামাক ও তামাকজাত পণ্যের দাম বাড়ানো হয়েছে। যা বর্তমান সরকারের মাননীয় অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবিত বাজেটে এক অনন্য কার্যকারী প্রস্তাব বলে মনে করি।

আগামী অর্থবছর (২০১৯-২০২০) প্রস্তাবিত বাজেটে নিম্নতম স্তরের ১০ শলাকার সিগারেটের দাম প্রস্তাব করা হয়েছে ৩৭ টাকা। সেখানে সম্পূরক শুল্ক ধরা হয়েছে ৫৫ শতাংশ। মধ্যম স্তরের ১০ শলাকার সিগারেটের মূল্য হবে ৬৩ টাকা এবং সম্পূরক শুল্ক হবে ৬৫ শতাংশ। উচ্চ স্তরের ১০ শলাকার সিগারেটের মূল্য হবে ৯৩ টাকা ও ১২৩ টাকা। এখানে সম্পূরক শুল্ক হবে ৬৫ শতাংশ।অন্যদিকে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বিড়ি–সিগারেটের মতো ভয়াবহ আরেকটি পণ্য হলো জর্দা ও গুলের দাম ও বৃদ্ধি করা হয়েছে।

প্রশ্ন হলো, আসলেই কি তামাকজাত পণ্য ও সিগারেটের দাম বৃদ্ধি করে ধূমপান কমানো যাবে?

২০১২ সালে প্রকাশিত দ্য ইকোনমিকস অব টোব্যাকো অ্যান্ড টোব্যাকো ট্যাক্সেশন ইন বাংলাদেশ শীর্ষক এক গবেষণায় দেখা গেছে, পৃথিবীতে বাংলাদেশেই সিগারেটের দাম সবচেয়ে কম। বিড়ির দাম আরও কম। বলা হয়েছে গত কয়েক বছর ধরে সিগারেটের প্রকৃত মূল্য অর্থাৎ অন্যান্য পণ্যের মূল্যের তুলনায় ক্রমাগত কমছে। অন্যদিকে মানুষের প্রকৃত আয় বাড়ছে এবং এভাবে তামাক পণ্য ক্রমশ আরও বেশি পরিমাণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে চলে আসছে। তাছাড়া তামাক পণ্যের জটিল কর কাঠামোর কারণে কর ফাঁকি দিতে সহায়তা করছে তামাক কোম্পানিগুলোকে। সরকার হারাচ্ছে কোটি টাকার রাজস্ব।

ওই গবেষণায় বলা হয়েছে তামাকের ব্যবহার কমানোর সর্বোৎকৃষ্ট উপায় হচ্ছে তামাকজাত পণ্যের ওপর এমনভাবে কর বাড়ানো যাতে এসব দ্রব্যের মূল্য নিশ্চিতভাবে বাড়ে। সিগারেটের অতিরিক্ত মূল্য তরুণদের ধূমপান করা থেকে বিরত রাখবে এবং বর্তমান ধূমপায়ীদের সিগারেট সেবন ছেড়ে দিতে ভূমিকা রাখবে। বলা হয়েছে বাংলাদেশে বিদ্যমান মূল্যস্তর ভিত্তিক কর কাঠামোর পরিবর্তে সব ধরনের সিগারেটের প্রতি ১০ শলাকার প্যাকেটের ওপর ৩৪ টাকা হারে একক (স্পেসিফিক ট্যাক্স) আরোপ করা হলে সিগারেটের ওপর একসাইজ ট্যাক্সের (সম্পূরক শুল্কর) পরিমাণ হবে গড়পড়তা খুচরা মূল্যের ৭০ শতাংশ। আর বিড়ির ক্ষেত্রে প্রতি ২৫ শলাকার প্যাকেটের খুচরা মূল্যের ওপর ৪ দশমিক ৯৫ টাকা হারে কর আরোপ করা হলেও একসাইজ ট্যাক্সের পরিমাণ হবে গড়পড়তা খুচরা মূল্যের ৭০ শতাংশ। এর ফলে প্রায় ৭০ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপায়ী সিগারেট সেবন ছেড়ে দেবেন। ৭১ লাখ তরুণ ধূমপান শুরু করা থেকে বিরত হবে। প্রায় ৬০ লাখ অকাল মৃত্যুর রোধ করা যাবে এবং সরকার ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব আয় করবে। এ ছাড়া বিড়ির ক্ষেত্রে প্রায় ৩৪ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক বিড়ি ধূমপায়ী বিড়ি সেবন ছেড়ে দেবেন। প্রায় ৩৫ লাখ তরুণ নতুন করে বিড়ি সেবন শুরু করবে না। প্রায় ২৪ লাখ অকাল মৃত্যু রোধ করা যাবে এবং বিড়ি থেকে সরকার বাড়তি ৭২০ কোটি টাকা রাজস্ব আয় করতে পারবে। সিগারেট এবং বিড়ি থেকে যে বাড়তি ২ হাজার ২২০ কোটি টাকা রাজস্ব আয় হবে তা দিয়ে ১২ হাজার ৩৩৩টি বিদ্যালয় এমপিওভুক্ত করা সম্ভব।

আমরা যদি ব্রিটেনের আর্থিক বাজেটের দিকে তাকাই, সেখানে সিগারেটের ওপর অতিরিক্ত ট্যাক্স আরোপ এর মাধ্যমে ধুমপায়ীদের হার কমাতে পেরেছে কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)- এর ২০১১ সালে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, পৃথিবীর অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশে সিগারেট সস্তা। এতে বলা হয়েছে শ্রীলঙ্কায় এক প্যাকেট সিগারেটের দাম যখন ৭ দশমিক ২০ মার্কিন ডলার, তখন বাংলাদেশে এক প্যাকেট সিগারেটের দাম ১ দশমিক শূন্য ৬ মার্কিন ডলার। অন্যান্য দেশগুলোর মধ্যে ভারতে ৩ দশমিক ৯৫ মার্কিন ডলার, থাইল্যান্ডে ৩ দশমিক ৩৮ ডলার, নেপালে ২ দশমিক ৬৫ ডলার, ইন্দোনেশিয়ায় ২ দশমিক ১৪ ডলার, মালদ্বীপে ১ দশমিক ৮২ ডলার এবং মিয়ানমারে ১ দশমিক ৩৭ ডলার। পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এসব দেশের চেয়ে বাংলাদেশে সিগারেটের দাম অনেক কম।

দেশে ধূমপায়ীর সংখ্যা কমানোর লক্ষ্যে প্রতিবছরই বাজেটে সিগারেটে দাম বাড়ানো হয় ইহা অবশ্যই যৌক্তিক বলে মনে করি। কেননা এই মূল্য বৃদ্ধির সুফলও পেয়েছে বাংলাদেশ। গ্লোবাল এডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে'র রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে গত ৮ বছরে ২১.৭ শতাংশ ধূমপায়ী হ্রাস পেয়েছে। পাশাপাশি দাম বৃদ্ধির সুযোগে দেশের বিভিন্ন স্থানে উৎপাদিত হচ্ছে নিম্নমানের অবৈধ সিগারেট যা ক্যান্সারের চেয়ে হৃদরোগের বা স্ট্রোকের ক্ষেত্রে ধূমপান অনেক বেশি ঝুঁকি তৈরি করে।

আমি মনে করি সরকার যদি ৩ টি দিক বিশ্লেষণ করে সরকার পদক্ষেপ নেয় তাহলে এর হার কমবে।

প্রথমত, জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনায় তামাকের ব্যবহার কার্যকরভাবে কমানোর জন্য তামাকের প্রকৃত মূল্য বাড়ানো। দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক বিবেচনায় তামাকের কর ও মূল্যবৃদ্ধি লাভজনক করা ও তৃতীয়ত ফ্রেকওয়ার্ক কনভেনশন অব টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) সদস্য দেশ হিসেবে আইনগত বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করা ও আন্তর্জাতিক চুক্তিতে তামাকের মূল্য বাড়ানোর জন্য যথাযথ রাজস্ব নীতি গ্রহণ করা উচিত।

অন্যদিকে কার্যকর করের ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে তামাক কোম্পানিগুলোর অপতৎপরতা রয়েছে । এ কারণে তামাক পণ্যের কার্যকর কর ধার্য করা যাচ্ছে না। কেননা তারা বাজেটের আগে পরিকল্পিতভাবে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে তৎপরতা চালায়। এ প্রক্রিয়া গত অর্থবছর এবং চলতি অর্থবছরে তারা সফলও হতে পেরেছে বলে জানা গেছে। তামাকবিরোধী আন্দোলনকারীদের মতে এই গোষ্ঠীর অপকতৎপরতা রোধ করার ব্যবস্থা নিতে হবে দ্রুতই তা নাহলে তামাকের হাত থেকে এইদেশের যুবসমাজকে বাঁচানো যাবে না।

তামাক পণ্যের দাম বাড়লে যে এর ব্যবহার কমে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও এটি প্রমাণিত। ১৯৮১ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ২৯ বছরের উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বাংলাদেশ এর সিগারেট এর মূল্য যতই বেড়েছে। এর ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।

বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় দেখা গেছে, তামাকজাত দ্রব্যের ১০ শতাংশ (প্রকৃত) মূল্যবৃদ্ধি করা হলে এর ব্যবহার উন্নত দেশে ৪ শতাংশ এবং বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে ৮ শতাংশ কমে আসবে। তাই আমি মনে করে এই পদক্ষেপ যদি জোড়ালোভাবে নেওয়া যায়, তাহলে আপেক্ষিক হারে এর ব্যবহার কমবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, বিবিএ (একাউন্টিং এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস)

ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।