‘মুখ’ পোড়াচ্ছেন যারা

প্রকাশ | ২৩ জুন ২০১৯, ১৪:৩৯ | আপডেট: ২৩ জুন ২০১৯, ২১:৩৪

আরিফুর রহমান দোলন

ইরানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এ কে এম মুজিবুর রহমান ভুইয়া ও লেবাননে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আবদুল মোতালেব সরকারকে ঢাকায় ফিরে আসার নির্দেশ দিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কেন? গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে একজনের বিরুদ্ধে নারী কেলেঙ্কারিরসহ নৈতিক স্খলন ও আরেকজনের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে। পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, ইরানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্তের জন্য জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ইমতিয়াজ আহমেদকে গত মার্চ মাসে তেহরানে পাঠানো হয়। অন্যদিকে লেবাননে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তের জন্য গত বছরের সেপ্টেম্বরে বৈরুতে পাঠানো হয় চীনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ফজলুল করিমকে। দুটি কমিটি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যে প্রতিবেদন দিয়েছে তাতে দুই অভিযুক্তকেই দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে।

প্রশ্নটি এখানেই। বহির্বিশ্বে (পদায়নকৃত দেশে) যিনি কি না বাংলাদেশের মুখ, তার বিরুদ্ধে নারী কেলেঙ্কারি, নৈতিক স্খলন, আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগ এবং তা প্রমাণিত। তাহলে আমাদের মুখ আর থাকলো কোথায়?

ঘুরেফিরে এভাবে বারবার দেশের মুখ ভিন্ন দেশে পোড়াচ্ছেন তারাই, যাদের হাতে আমাদের মুখোজ্জ্বল করার দায়িত্ব। বলা হয়, এসব বিছিন্ন ঘটনা। কিন্তু এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটাচ্ছেন কারা? উচ্চ শিক্ষিত, স্মার্ট এবং কূটনীতিতে সিদ্ধহস্ত। যার পেছনে রাষ্ট্র কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করছে। যিনি বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে গাড়ি করে ঘুরছেন। কূটনৈতিক সুরক্ষা ভোগ করছেন। প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ নানা সুবিধা নিচ্ছেন। সবচেয়ে বড় কথা, একজন রাষ্ট্রদূত বা হাইকমিশনার বিদেশের মাটিতে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করেন। বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরা, সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক, বাণিজ্যিকসহ সব ধরনের সম্পর্ক জোরদার করাই হলো রাষ্ট্রদূতের কাজ। কিন্তু সেই রাষ্ট্রদূতের ভাবমূর্তিই যদি পুরোপুরি প্রশ্নবিদ্ধ থাকে? নারী কেলেঙ্কারি, নৈতিক স্খলন, আর্থিক কেলেঙ্কারির কারণে তিনি যদি নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকেন? নিজের গদি রক্ষাই যখন তার সার্বক্ষণিক টেনশন হয়? সে রকম রাষ্ট্রদূত দিয়ে আমরা কী করবো?

প্রশ্নটি এজন্যই উঠছে যে, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশে কর্মরত রাষ্ট্রদূতেরা আমাদের সম্মানহানির কারণ হওয়ার পরেও ‘ছাড়’ পেয়েছেন। যার আচরণে ভিন দেশে বাংলাদেশকে নিয়ে বিব্রত হতে হয় তাকে স্রেফ দেশে ফেরার নির্দেশ কিংবা ওএসডি করে রাখা কি তার শাস্তি? নাকি পুরস্কার? নারী কেলেঙ্কারি, নৈতিক স্খলন, আর্থিক কেলেঙ্কারি কি অপরাধ নয়? সেই অপরাধে যিনি অভিযুক্ত এবং তদন্তে যে অভিযোগ প্রমাণিত সেই অপরাধী কেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পাবে না? অতীতে যদি এ ধরনের অপরাধীরা ফৌজদারি শাস্তির আওতায় আসতেন তাহলে কিন্তু বারবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতো না। কারণ একটি বার্তা সবাই পেতেন বিদেশের মাটিতে বসে বাড়িতে গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে সর্বোচ্চ সুবিধাভোগীর একজন হয়ে দেশের মাথা হেট করতে নারী কেলেঙ্কারি করা যাবে না। একজন রাষ্ট্রদূত হয়ে নৈতিক স্খলন হয় এমন কর্মকাণ্ডে থাকা যাবে না। রাষ্ট্রের লাখ লাখ টাকা বেতনভাতা যে রাষ্ট্রদূতের পেছনে খরচ হয় তা আর্থিক কেলেঙ্কারি আমরা স্বাভাবিকভাবে মেনে নেব? মানবো না। মানতে পারি না। মানা উচিত হবে না।

ভেবে দেখুন তো, বিদেশে আমাদের যেসব রাষ্ট্রদূত আছেন তাদের পেছনে রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে বছরে খরচ কেমন? স্ব স্ব দেশের আর্থিক সামাজিক মর্যাদা অনুযায়ী সেসব দেশে কর্মরত আমাদের কূটনীতিকরা বেতন-ভাতা পান। ক্ষেত্রেভেদে সেটি ৫, ১০, ৩০, ৪০, ৫০  লাখ টাকা। এসব কূটনীতিকের অনেকেই অনেক ভালো কাজ করেন। তাদের কর্মকাণ্ডের কারণে দেশের মর্যাদা, ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হচ্ছে। অনেকেই বাংলাদেশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেশের সম্পর্কোন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, রাখছেন এবং ভবিষ্যতেও রাখবেন-এই নমুনা দেখাচ্ছেন। তাদেরকে অভিনন্দন। দেশের জন্য বিদেশের মাটিতে কাজ করে যাওয়া ওইসব কূটনীতিককে সাধুবাদ জানাই। ভবিষ্যতে আরও ভালো কাজ করার অনুরোধ করি।

কিন্তু যারা বিপরীত কিছু করেছেন? তাদের ক্ষেত্রে কী হবে? শুধু নিন্দাই কি তাদের জন্য যথেষ্ট? সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি ভুলে গিয়ে নতুন বিষয় নিয়ে আমরা তৎপর হবো আর দেশের ভাবমূর্তি বিনষ্টকারী রাষ্ট্রদূতেরা পর্দার আড়ালে চলে যাবেন? তাদের কোনো শাস্তি না হওয়া ভবিষ্যতে অন্যদের জন্য অনুপ্রেরণা কি না এই প্রশ্নের কারণেই মূলত এই দুশ্চিন্তা! আচ্ছা আমরা কি নিম চন্দ্র ভৌমিকের নাম ভুলে গেছি? নেপালের রাষ্ট্রদূত থাকাকালীন একের পর এক বিতর্কিত কর্মকাণ্ড করে দেশের সম্মানকে প্রশ্নবিদ্ধ করা সাবেক এই রাষ্ট্রদূত কি পার পেয়ে যাননি? অন্য দেশের পতাকা নিয়ে গাড়িতে ভ্রমণ, নারী কেলেঙ্কারি, ভিসা দিতে হয়রানি, শিক্ষার্থীদের ভিসা দিতে ঘুষ, এমনকী নেপালে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নাক গলানোর মতো অভিযোগ ছিল নিম চন্দ্র ভৌমিকের বিরুদ্ধে।

চীনে তৎকালীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমেদ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন যুগ্মসচিব (বর্তমানে প্রাণিসম্পদ সচিব) রইসুল ইসলাম মণ্ডল ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক সুব্রত রায় মৈত্রীর নেতৃত্বে তদন্ত দল নিম চন্দ্র ভৌমিকের বিরুদ্ধে ওঠা এসব অনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রমাণ পায়। বিস্ময়কর হলো, দেশে ফিরিয়ে আনা ছাড়া আর কিছুই করা হয়নি দেশের ভাবমূর্তি ভূলুণ্ঠনকারী নিম চন্দ্র ভৌমিকের। ২০১১ সালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন অনুবিভাগের করা চার পৃষ্ঠার তদন্ত রিপোর্টে যেমন চিত্র তুলে ধরা হয়েছে তাতে ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত হওয়ার সব রকম অপরাধের উপাদানও ছিল।

বলিউডের এক সময়কার সাড়া জাগানো নায়িকা মনীষা কৈরালার বাড়ির সামনে আধ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও প্রবেশ করতে না পেরে হাপিত্যেশ করছেন একজন কূটনীতিক। তিনি নেপালে নিযুক্ত বাংলদেশের রাষ্ট্রদূত নিম চন্দ্র ভৌমিক। ভাবা যায়! স্থানীয় বেশ ক’জন নারীকে দূতাবাসে নিয়মিত আদর-আপ্যায়ন করানো, তাদেরকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় দেওয়াসহ নানা অকূটনীতিসুলভ আচরণের প্রমাণ ছিল ওই রাষ্ট্রদূতের বিরুদ্ধে।

বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, দূতাবাসের হিসাবরক্ষক হারুনুর রশিদের মোটরসাইকেলের পেছনে বসতেন রাষ্ট্রদূত নিম চন্দ্র ভৌমিক। যেতেন নাচের ক্লাবে, রাতের নানা অনুষ্ঠানে, রাতের বারে। অনেক সময় পুরো মাতাল হয়ে বাসায় ফিরেছেন। তিনি ভারতীয় দূতাবাসের একজন নারী কাউন্সিলরকে উত্ত্যক্ত করেছেন। মাওবাদী ছাড়া কী করতে হবে-বিভিন্ন জনসভায় গিয়ে স্থানীয় লোকজনকে এই পরামর্শ দিয়ে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নাক গলিয়েছেন। হাজারো কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত কর্মকা- করার পরিপ্রেক্ষিতে নিম চন্দ্র ভৌমিকের পরিবর্তে অন্য কাউকে রাষ্ট্রদূত নিয়োগের অনুরোধ জানিয়েছিল নেপালের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

সেই বিতর্কিত রাষ্ট্রদূত নিম চন্দ্র ভৌমিকের বিরুদ্ধে কি কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়? নেয়নি। কেন তাতে ছাড় দেওয়া হলো? নেপালে থাকা অবস্থায় তিনি যেসব সুবিধাদি ভোগ করেছিলেন তা-কি রাষ্ট্রীয় কোষাগারের টাকা নয়? তার অপব্যবহারী কেন পার পাবেন?

একইভাবে এক সময়ে গ্রিসে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালনকারী গোলাম মোহাম্মদের নামও করতে পারি। যৌন কেলেঙ্কারি প্রমাণিত হওয়ায় ২০১৪ সালে যাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। গ্রিসে আন্তর্জাতিক অভিবাসন (আইওএম) সংস্থার গ্রিস কার্যালয়ে কর্মরত এক নারীকে যৌন নিপীড়ন করেন রাষ্ট্রদূত গোলাম মোহাম্মদ। সচিব পদমর্যাদার এক কর্মকর্তার নেতৃত্বে তিন সদস্যের তদন্ত দল যৌন নিপীড়নের প্রমাণের পাশাপাশি আর্থিক অনিয়মের প্রমাণও পায় ওই রাষ্ট্রদূতের বিরুদ্ধে। জর্দানের রাষ্ট্রদূত থাকাকালেও যিনি কি-না একই ঘটনা ঘটিয়েছিলেন।

আশ্চর্যজনক হচ্ছে দেশে তলব করেই দায় সারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বিগত আওয়ামী লীগ সকারের আমলে জাপানে নিযুক্ত বাংলাদেশের এক রাষ্ট্রদূতকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয় এই যৌন নিপীড়ন করার অভিযোগেই। ওই রাষ্ট্রদূত দূতাবাসে কর্মরত স্থানীয় জাপানি নারীকে যৌন হেনস্তা করেছিলেন। যা নিয়ে অনেক হৈ-চৈ হয়েছিল স্থানীয় পর্যায়ে। এই তো কিছুদিন আগে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে আমাদের দূতাবাসে কর্মরত গ্রেড-৩ মর্যাদার কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেনকে ফেরত পাঠায়-বাংলাদেশ তাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হয়। অভিযোগ? দেলোয়ার হোসেন বউ পেটাতেন। এ নিয়ে স্থানীয় পত্রপত্রিকায় অনেক লেখালেখি হয়। যা বাংলাদেশের মর্যাদাহানি করে।

কিন্তু দেশে ফিরে এই দেলোয়ার হোসেনরা পার পেয়ে যান অবলীলায়। কেন? কার স্বার্থে? বিদেশ বিভূঁইয়ে রাষ্ট্রের জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় যাদের মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপন হয় তারা কেন এভাবে বারবার দেশের মর্যাদাহানির কারণ হন। আর কেউ যখন একবার অমর্যাদাপূর্ণ ফৌজদারি অপরাধের আমলযোগ্য কর্মকা- করেন তখন কেন তার বিরুদ্ধে দৃষ্টামূলক শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া হয় না? সেই শাস্তি থেকে অন্যরা সতর্ক, সাবধান এবং নিজের কর্মের প্রতি শতভাগ যতœবান হতে পারেন।

এমন অভিযোগ তো হামেশাই শোনা যায়। দূতাবাসে আমাদের প্রবাসী ভাইয়েরা যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পরিশ্রম করে দেশে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন তারা নানা হয়রানির শিকার হন। আমাদের রেমিট্যান্স যোদ্ধারা হয়রানি হবেন আর কার্যত তাদের টাকায় যাদের বেতন-ভাতা হয় সেরকম কেউ কেউ যখন তাদের হয়রানির কারণ হবেন তখন তা-কি মেনে নেওয়া যায়?

বহুল প্রচারিত দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় ১৩ জুন ‘ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ ভবন রাষ্ট্রদূতের কিচেন’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, তিন মিলিয়ন ডলার বরাদ্দের পর পাঁচ বছরেও সংস্কার করা হয়নি ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের বসবাসের জন্য কেনা নিজস্ব ভবনটির। বাড়িটিকে ব্যবহার করা হচ্ছে রান্নাঘর হিসেবে। নিজস্ব ভবন থাকার পরও রাষ্ট্রদূতের বাসা ভাড়া বাবদ প্রতি মাসে বাংলাদেশ সরকারকে গুণতে হচ্ছে আট হাজার ডলার। গত পাঁচ বছরে এ বাবদ সরকারের ব্যয় হয়েছে চার লাখ ৮০ হাজার ডলার, যা বাংলাদেশের মুদ্রায় প্রায় চার কোটি টাকা।

এসব কীসের আলামত? এই প্রশ্ন কাকে করবো? আমাদের রাষ্ট্রদূতেরা আমাদের মর্যাদার প্রতীক হয়ে উঠুন। আরও সুযোগ-সুবিধাও প্রয়োজনে রাষ্ট্র তাদের দিক। কিন্তু আমাদের মুখ পোড়াচ্ছেন যারা তারা যেন পার না পায়।

লেখক: সম্পাদক, দৈনিক ঢাকা টাইমস, ঢাকা টাইমস২৪ ডটকম সাপ্তাহিক এই সময়