এবার ভোগাচ্ছে অ্যাপের গাড়ি

সৈয়দ ঋয়াদ, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ২৪ জুন ২০১৯, ১৬:১৫ | প্রকাশিত : ২৪ জুন ২০১৯, ১০:৫৬
ফাইল ছবি

ঠিক যেন সিএনজিচালিত অটোরিকশার ভোগান্তি। যাত্রীর ইচ্ছামতো গন্তব্যে যেতে না চাওয়া, নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি দাবি, নীতিমালার চেয়ে নানা কৌশলে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় চলছে। অ্যাপচালিত গাড়ি ভাড়া সেবা চালুর পর যে স্বস্তি এসেছিল, তা উবে গিয়ে যাত্রীদের বিরক্তি চরমে।

এসব সেবার বিরুদ্ধে যাত্রী ভোগান্তির দায়ে ব্যবস্থা নেয়ার উদাহরণও নেই। আসলে যাত্রীরা ভুগলে অভিযোগ করার মতো জায়গা নেই। অ্যাপ চালানো প্রতিষ্ঠানগুলোও গণমাধ্যমকে পাত্তা দেয় না। কোনো অভিযোগের জবাব দেওয়ার প্রয়োজনই বোধ করে না তারা।

একটি মানসম্মত গণপরিবহন ব্যবস্থা রাজধানীবাসীর বহু বছরের স্বপ্ন। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গাড়িভাড়া সেবা দেওয়া প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে আসার পর স্বস্তি যা কিছু এসেছিল, কিছুদিন যেতে না যেতেই এখন বিরক্তি, ঠকে যাওয়ার বোধ প্রবল।

ঢাকায় ব্যক্তিগত গাড়ি ভাড়ায় চরম ভোগান্তির মধ্যে ২০১৬ সালে অ্যাপভিত্তিক গাড়ি ভাড়া সেবা পাঠাও মোটর সাইকেল এবং পরে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান উবার প্রাইভেট কার ভাড়ার সুবিধা নিয়ে আসে। মুহূর্তেই তুমুল জনপ্রিয় হয় দুটি সেবাই। পরে দুটি অ্যাপেই মোটর সাইকেল ও গাড়ি ভাড়া সেবা চালু করে। একে একে চালু হয় ‘সহজ’, ‘ও ভাই’, ‘ইজি অ্যাপ’সহ আরো ১৪টি কোম্পানি।

শুরুতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএ ব্যক্তিগত গাড়ির বাণিজ্যিক ব্যবহারে রাজি ছিল না। এই ধরনের সেবা চালু হলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণাও দেয় তারা। কিন্তু জনচাপে তারা আর ব্যবস্থা নেয়নি। বরং এই সেবাগুলোকে একটি নীতিমালার অধীনে আনতে নেয়া হয় উদ্যোগ। তবে নীতিমালা অমান্য হচ্ছে হরহামেশা। বেশি অভিযোগ মোটর সাইকেলের বিরুদ্ধে। তবে গাড়ির বিরুদ্ধেও আছ ভুরি ভুরি আইন অমান্যের অভিযোগ।

বিষয়টি দেখভালের দায়িত্ব বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ- বিআরটিএর। কিন্তু বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনাকারী কোম্পানিগুলো এখনও তালিকাভুক্ত না হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছে না তারা।

বিআরটিএর একজন কর্মকর্তা ঢাকাটাইমসকে জানান, ১ জুলাই থেকে কোম্পানিগুলো নিবন্ধনের আওতায় আসবে। তখন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আইনি সুযোগ আছে।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী এ বিষয়ে বলেন, ‘এখন অ্যাপভিত্তিক সেবাগুলো নৈরাজ্য শুরু করেছে। এরা যখন এই সেবা চালু করে তখন আমরা আশায় বুক বেঁধেছিলাম। কিন্তু এখন সেই আশায় গুড়েবালি। এখনই যদি এই বিষয়ে পদক্ষেপ না নেওয়া হয় তখন এটাকে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না। গণমাধ্যমের কল্যাণে কিছু লেখালেখি হলেও সরকারের এসব বিষয় সয়ে গেছে।’

যাত্রীর ইচ্ছামতো গন্তব্যে যেতে না চাওয়া

যে কারণে সিএনজিচালিত অটোরিকশার প্রতি বিরক্তি, অ্যাপের গাড়িতেও সেই একই সমস্যা প্রবল হয়েছে।

শাহবাগ থেকে পুরান ঢাকার চাঁনখারপুল যাবেন আল ফারুক। রাইড শেয়ারিং অ্যাপ পাঠাওয়ে রিকোয়েস্ট পাঠালেন। পর পর চারজন চালক গন্তব্য জানতে চাইলেন। বলার পর চার জনই জানালেন, এই পথে যাবেন না। অথচ রাইড শেয়ারিং নীতিমালার ৩ (খ) ধারা অনুযায়ী অ্যাপ চালকদের এই ‘না’ বলার কোনো সুযোগ নেই।

আরেক দিনের গল্প। একই যাত্রী হাতিরঝিল থেকে আসবেন ইস্কাটনে। অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং সেবা দেওয়া সহজ এর মোটর সাইকেলকে রিকোয়েস্ট পাঠালেন। চালক সেটি অ্যাকসেপ্টও করলেন। কিন্তু আর কল করেন না, ফোন দিলে উল্টো কেটে দেন। পরে রিকশায় করে গন্তব্যে আসেন ফারুক। এসেই চক্ষু চরকগাছ তাঁর। অ্যাপে ম্যাসেজ এসেছে, গন্তব্যে গেছেন চালক, ভাড়া পরিশোধের নোটিশ। অবাক হয়ে আল ফারুক অ্যাপের ম্যাসেজে লিখলেন, তিনি বাইকে চড়েননি। কিন্তু এর কোনো জবাব কখনো আসেনি।

ফারিয়া হেসেন, পড়েন নর্থ সাউথ ইউভার্সিটিতে। মগবাজার মোড়ে দাঁড়িয়ে আধা ঘণ্টারও বেশি। উবারের অ্যাপে চালানো তিনটি গাড়ির চালক রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করলেন, কিন্তু সবাই বললেন, তারা ওদিকে যাবেন না।

সমস্যা এখানেই নয়, চালকরা তাদের রেটিং কমে যাবে বলে নিজেরা কল কাটবেন না। যাত্রীকেই বললেন রিকোয়েস্ট কেটে দিতে। এতে সমস্যা হলো, পরবর্তী ভাড়ার সঙ্গে জরিমানা বাবদ যোগ হবে একটি অংক। কিন্তু ফারিয়ার যেতেই হবে। তাই বাধ্য হয়ে একের পর এক গাড়ি ডেকে যাচ্ছিলেন তিনি।

অতিরিক্ত ভাড়া

ফেসবুক গ্রুপ ডু সামথিং একসেপশনাল- ডিএসই এর এডমিন জেবিন ইসলাম উবারের গাড়িতে করে ঢাকা সেনানিবাস থেকে উত্তরা যেতে ১৪৫ টাকা ভাড়া দেখালেও অ্যাপে ভাড়া এসেছে ৫৯৫ টাকা। এমন ভোগান্তিতে আরও বেশ কয়েকবার পড়েছেন এই গ্রাহক।

বোরহান উদ্দিন। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল থেকে জনসন রোডের ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ এলাকায় উবারের ট্রিপ নিয়েছেন। ভাড়া দেখালো ২৭৬ টাকা। কিন্তু পৌঁছে চক্ষু চরকগাছ। ভাড়া আসল ৪৪০ টাকা। রাস্তায় যানজট থাকলে ওয়েটিং চার্জ হিসেবে মাঝেমধ্যে ভাড়া বেশি আসে। কিন্তু সেদিন যানজটও ছিল না। বোরহানের সঙ্গে অবাক গাড়ির চালকও। কিন্তু অ্যাপে যে ভাড়া এসেছে, তার কম নেওয়ার সুযোগ নেই|

বোরহান অভিযোগ করলেন অ্যাপে থাকা অপশনে। কিন্তু কোনো জবাব মেলেনি। ফোন করে কল করবেন-সে সুযোগও নেই।

ভোগান্তির এখানেই শেষ নয়। বৃষ্টি হলে বা অফিস সময়ে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ভাড়া আসে। একে কোম্পানিগুলো নাম দিয়েছে হট জোন। অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট এলাকা থেকে ভাড়া নিলে ঘোষিত ভাড়ার চেয়ে দেড়গুণ বা তার চেয়ে বেশি ভাড়া দিতে হবে।

এই ভোগান্তিতে পড়েছেন মারুফুর রহমান। শেওড়াপাড়া থেকে ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর যেতে অ্যাপে রিকোয়েস্ট দেন। বেলা ১২ টা ৫৫ মিনিটে উবারের গাড়ি ডাকেন, ভাড়া দেখায় তিনশ টাকা। রাইডার রাস্তা না চেনার কারণে আসতে না পাড়ায় তিনি আবার ও গাড়ি ডাকেন। পাঁচ মিনিট পর একই দূরত্বে বুবার ডাকলে সেখানে ভাড়া দেখায় ছয়শ টাকা। অর্থাৎ আগের ভাড়ার দ্বিগুণ। পরে নিজের ছোট ভাইয়ের ফোন থেকে চেষ্টা করা হলেও ভাড়া ছয়শ টাকাই দেখায়। মাত্র পাঁচ মিনিটেই ভাড়া দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ায় মারুফুর রহমান বিষ্মিত হন।

কামরুল হোসেন নামে এক ব্যাংকার জানান, সকালে অফিস টাইম ও বিকালে অফিস ছুটির সময় রাইড নিলে উবার পাঠাওয়ে প্রায়শই এসএমএস আসে, ‘ফেয়ার স্লাইটলি হায়ার ডিউট হাই ডিমান্ড’।’

কামরুল বীতশ্রদ্ধ হয়ে বলেন, ‘কোম্পানিগুলো অফিস পাড়াকে নিজেরা হট জোন চিহ্নিত করে রেখেছে। সেখান থেকেও কোনো গন্তব্যে যেতে চাইলে বেশি ভাড়া গুণতে হচ্ছে।’

বিস্ময়কর ঘটনা আরো আছে। ইস্কাটন গার্ডেন এলাকা থেকে খিলক্ষেত যেতে দুটি মোবাইল ফোন থেকে উবারে রিকোয়েস্ট পাঠানো হলো। একটিতে মোটর বাইকে ভাড়া দেখালো ১৫০ টাকা। অন্য একটিতে ১৭৩ টাকা। একটিতে উবার এক্স গাড়িতে ভাড়া দেখাল ৩০১ টাকা, আরেকটিতে ৩৯৯ টাকা।

মিটার ছাড়া চুক্তিতে যাত্রী তোলার চেষ্টা

আরেক বিড়ম্বনা ইদানীং শুরু হয়েছে মোটর সাইকেলে। মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকবে মোটর সাইকেল। প্রায়ই কর্কশ গলায় শুনতে হয়, ‘ওই কই যাইবেন?’।

গন্তব্য বললে বলেন, ‘... টাকা লাগবে’।

কেন অ্যাপে তো যাবেন না?

‘না, গেলে ... লাগবে।’

ফরিদ উদ্দিন কাজ করেন একটি বেসরকারি ব্যাংকে। যাবেন মধ্য বাড্ডা। রাত প্রায় ১১টায় বাংলামোটর মোড়ে দাঁড়িয়ে। অ্যাপে গাড়ি মিলছে না। পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন রাইডারের সবাই শর্ত দিলেন যেতে হবে চুক্তিতে। কিন্তু নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে ফরিদ রিকশায় চড়েন।

পাঠাওয়ে চলাচলের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে তামান্না রহমান বলেন, ‘বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পাঠাওয়ে প্রাইভেটকার সার্ভিস পাওয়া দূরহ। পাওয়া গেলেও সেটার দূরত্ব সেবা নেওয়ার মতো থাকে না। অনেক ক্ষেত্রে চালকও যেতে অস্বীকৃতি জানান। আর মোটরসাইকেল রাইডাররাতো হরহামেশাই অ্যাপ বন্ধ করে যাত্রীদেরকে চুক্তিতে যাওয়ার জন্য প্ররোচিত করেন। বিশেষ করে হট জোন চিহ্নিত স্থানগুলোতে সারিবদ্ধভাবে দাড়িয়ে থাকেন রাইডাররা।’

যাত্রীর মাথায় ‘খেলনা’ হেলমেট

অ্যাপের মোটর সাইকেলের চালকরা যাত্রীদেরকে যেসব হেলমেট দেন, তার একটি বড় অংশের মানই যাচ্ছে তাই ধরনের।

কোনো কোনো হেলমেট পাতলা উপকরণে তৈরি, যা হাত দিয়েও মুচড়ে ফেলা যায়। আবার অতি ব্যবহারের ফলে অনেক হেলমেটের ফিতাই ছিঁড়ে গেছে। সব মিলিয়ে নিরাপত্তা ঝুঁকিতে আছে রাইড শেয়ারিং মোটরসাইকেলের হাজার হাজার যাত্রী।

আর এসব হেলমেটকে ‘খেলনা’ আখ্যায়িত করে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ। ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মীর রেজাউল আলম একটি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘তারা হেলমেট হিসেবে যেটা দেয় সেটা তো হেলমেট না, এটা তো একটা খেলনা। এ নিয়ে আমরাও চিন্তা-ভাবনা শুরু করেছি। এটাতো কোনোভাবেই একজন যাত্রীর সুরক্ষা দিতে পারবে না।’

অভিযোগ করার সুব্যবস্থাও নেই

গত বছর মন্ত্রিসভায় ১১টি শর্তে অ্যাপ ভিত্তিক রাইডিং সেবার অনুমোদন দেয় সরকার। সে বছরই ৮ মার্চ থেকে কার্যকর হয় অ্যাপভিত্তিক পরিবহন নীতিমালা। এর মধ্যে ১০ নম্বর শর্তে স্পষ্ট উল্লেখ কার আছে, মালিক ও চালকের বিরুদ্ধে অনলাইনে অভিযোগ করা যাবে। তবে এই সংক্রান্ত কোনো ফলপ্রসূ কাস্টমার কেয়ার ও অভিযোগ কেন্দ্র ব্যবস্থা রাখা হয়নি।

অভিযোগের বিষয়ে প্রতিকার চাইতে যাত্রীকে ভারতে অবস্থিত উবারের অফিসে যোগাযোগ করতে হবে। যা বেশির ভাগ যাত্রীই করেন না। বাংলাদেশে অনেক আগে ব্যবসা শুরু করলেও এখনও নিজস্ব কোনও অফিস স্থাপন করেনি উবার।

যাত্রীদের অভিযোগগুলো নিয়ে উবারের বাংলাদেশি জনসংযোগ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সেখান থেকে জানানো হয়, বাংলাদেশে উবারের কোনও প্রতিনিধি নেই। কারো জিজ্ঞাসা থাকলে তাদেরকে মেইল করতে হবে। তারা ভারতে উবারের অফিসে পাঠিয়ে দেবেন। জবাব আসতে দুই দিন লাগতে পারে।

অন্যান্য অ্যাপের পরিস্থিতিও একই রকম। পাঠাওয়ে কাস্টমার কেয়ারে বহু কষ্টে যোগাযোগের সুযোগ হলেও প্রতিকারের সম্ভাবনা থাকে না বললেই চলে।

ঢাকাটাইমস/২৪জুন/এসআর/ডব্লিউবি

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :