আফ্রিকান ক্রিকেটে বর্ণবৈষম্য এবং বিশ্বকাপ ভরাডুবি

প্রকাশ | ২৪ জুন ২০১৯, ২১:৫০ | আপডেট: ২৫ জুন ২০১৯, ১৩:২২

ক্রীড়া ডেস্ক, ঢাকাটাইমস

এবারের ক্রিকেট বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার ১৫ সদস্যের দলে আছে তিনজন কৃষ্ণকায় খেলোয়াড়। তিনজনই বোলার। একদিনের ক্রিকেটে অভিষেকের পর থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা দলে এখন পর্যন্ত অগণিত দ্রুত গতির কৃষ্ণকায় বোলার খেললেও সর্বসাকুল্যে মাত্র চারজন কৃষ্ণকায় ব্যাটসম্যান প্রোটিয়াস ক্যাপ পড়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন! এটা কি নিতান্তই কালোদের পুরোদস্তুর ব্যাটসম্যান হবার অনিচ্ছা নাকি এর পেছনে অন্য কোনো কারণ রয়েছে?

বর্ণবৈষম্যের দিক থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা বরাবরই অন্যান্য দেশ থেকে এগিয়ে। বিশেষ করে ক্রীড়াক্ষেত্রে। মাখায়া এনটিনি, কাগিসো রাবাদার মতো বিশ্বসেরা পেস বোলার বিশ্ব ক্রিকেটকে উপহার দিয়েছে এই দক্ষিণ আফ্রিকাই। অথচ নামজাদা কোনো কৃষ্ণকায় ব্যাটসম্যানের খোজ আজও মেলেনি আফ্রিকা মহাদেশের এই দেশটি থেকে!

কৃষ্ণকায় খেলোয়াড়দের মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার ঘরোয়া ক্রিকেটে সর্বশেষ যিনি সাড়া জাগিয়েছেন তিনি হলেন টেম্বা বাভুমা। এমন আরেকজনের খোজ পাওয়া গেছে বেশ কিছুদিন হল। নাম সিনেথেম্বা কুশীল। দারুণ ধারাবাহিক ব্যাটিং করে চলেছেন ঘরোয়া ক্রিকেটে। মার্চে সুযোগ পেয়েছেন জাতীয় দলের টি-২০ স্কোয়াডে।

এই সিনেথেম্বা কুশীল মনে করেন কালো খেলোয়াড়দেরকে বয়সভিত্তিক দলে প্রথম প্রথম অনুশীলন করানোর সময়ই ব্যাটিংয়ে অনাগ্রহী করে তোলা হয়। একটা ধারণা তৈরি করে দেওয়া হয় যে কৃষ্ণকায় ক্রিকেটারদের বোলারই হতে হবে।

"বয়সভিত্তিক ক্যাম্পগুলোতে প্রথমেই শেখানো হয় কিভাবে বল করতে হবে। খুব কম ক্রিকেটারেরই সৌভাগ্য হয় ব্যাট হাতে দীর্ঘ সময় অনুশীলন করবার। আর অধিকাংশ কালো খেলোয়াড়রা আসেও অনুন্নত শহরগুলো থেকে। স্কাউটরাও গুরুত্ব কম দিয়ে থাকে। তাই অসাধারণ কিছু না করলে নজরে আসে না নির্বাচকদের।

বছর চারেক আগে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন ‘সিএসএ’ বিষয়টি নিয়ে একটি গভীর অনুসন্ধান পরিচালনা করে।

‘সিএসএ’র ক্রিকেট সার্ভিস ম্যানেজার এডওয়ার্ড খোজা’র ভাষ্যমতে কৃষ্ণকায় বাচ্চারা গড়ে প্রতিবছর মাত্র ছয়টি করে ম্যাচ খেলার সুযোগ পায়। এরপর তারা আঞ্চলিক এবং জাতীয় দলের বয়সভিত্তিক দলগুলোতে সুযোগ পেতে প্রতিযোগিতা শুরু করে এমন সব কিশোরদের সাথে যারা ততদিনে গড়ে ৫০টির উপরে ম্যাচ খেলে ফেলেছে।

প্রতিভা আর গতির জোরে মাখায়া এনটিনি, রাবাদার মতো বোলারেরা শুরুর দিকের এই অসমতা কাটিয়ে সবার নজরে চলে আসলেও ব্যাটিংয়ের টেকনিক্যাল কিছু দিকের কারণে কোনো ব্যাটসম্যান আর এভাবে উঠে আসতে পারে না।

২০১৬ সালে ‘ক্রিকেট সাউথ আফ্রিকা’ কৃষ্ণকায় ব্যাটসম্যানের এই সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে দেশব্যাপী ‘প্লেয়ার পারফর্মেন্স প্ল্যান’ নামে একটি উদ্যোগ গ্রহণ করে। যার মাধ্যমে প্রতিভাবান কৃষ্ণকায় খেলোয়াড়দের সুযোগ মেলে বছরে অন্ততপক্ষে ২০টি করে ম্যাচ খেলবার।

এডওয়ার্ড খোজা আলজাজিরাকে জানান, ‘‘এরপর থেকে আমরা লক্ষ করি প্রায় প্রত্যেক কৃষ্ণকায় খেলোয়াড়ই ২৫টির উপরে ম্যাচ খেলবার সুযোগ পাচ্ছে’’। শুধু তাই নয়, জাতীয় দলে এই বর্ণবৈষম্য দূর করতে ক্রিকেট সাউথ আফ্রিকা কোটা সিস্টেম চালু করারও সিদ্ধান্ত নেয়। যেখানে ফ্রাঞ্চাইজি ও প্রাদেশিক লীগগুলোর দলগুলোতে কমপক্ষে তিনজন কৃষ্ণকায় খেলোয়াড় খেলানো বাধ্যতামূলক ঘোষণা করা হয়। একইসাথে নিয়ম করা হয় প্রত্যেকটি দলের ব্যাটিং অর্ডারের টপ সিক্সে অন্তত দুইজন কালো ব্যাটার যেন থাকে।

কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই দেখা যায় সেখানে বেশ কিছু গুপ্ত সমস্যা থেকে গেছে। দেখা যায়, প্রাদেশিক, বয়সভিত্তিক, ফ্রাঞ্চাইজি দলগুলির কোচেরা কালো ব্যাটসম্যানদের টপ অর্ডারের তিন, চার এবং পাঁচ নম্বর পজিশনে খেলাচ্ছে না। মডার্ণ ক্রিকেটে এই তিনটি পজিশনকে ধরা হয় বড় রান স্কোর করার জন্য সর্বোত্তম তিনটি পজিশন। বেশিরভাগ সময়ে এই তিনটি পজিশনে খেলা ব্যাটসম্যানরাই জাতীয় দলের নির্বাচকদের নজরে আসে, পড়ে যেয়ে তারাই তিন থেকে সাত নম্বরে ব্যাট করে থাকে। পরিসংখ্যানও এর সত্যতা তুলে ধরে। ২০১৬, ’১৭ সালে ৮৬ শতাংশ কালো ব্যাটসম্যানদের হয় ওপেনে নয়তো ছয় নম্বরে ব্যাট করতে পাঠানো হয় যেখানে এদের অধিকাংশই তিন, চার নম্বরে ব্যাট করতে অভ্যস্ত। এরকমই একজন কাগিসো রাপুলানা। রাপুলানা জানান প্রাদেশিক ক্রিকেটে তার অভিষেক হয় ২০১২ সালে। প্রথম দুই সিজনে কোচেরা কেউই তার উপর ভরসা করতেন না বলে জানান রাপুলানা। ‘‘আমাকে সবসময় ওপেন করতে পাঠানো হত যদিও আমি টেকনিক্যালি ওপেনারদের মতো ছিলাম না’’ বলেন কাগিসো রাপুলানা।

এরপর ‘ক্রিকেট সাউথ আফ্রিকা’ আরও কঠিনতর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়। নিয়ম চালু করা হয় যদি কিনা কোনো ক্রিকেটার ছোট থেকেই তিন নম্বরে ব্যাট করে  প্রাদেশিক, ফ্রাঞ্চাইজি দলগুলোতে উঠে আসে তবে সেখানে তাকে অবশ্যই যেন ঐ তিন নম্বরেই খেলানো হয়।

কাগিসো রাপুলানা এখন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রাদেশিক দল লায়ন্সের হয়ে ব্যাট করেন চার নম্বর পজিশনে। ২০১৮-১৯ সিজনে এই পজিশনে ব্যাট করে হাকিয়েছেন একের পর এক সেঞ্চুরি।

কিন্তু এখানেই শেষ নয়। কৃষ্ণকায় কোনো খেলোয়াড় দলে সুযোগ পেলে প্রথমেই যে জিনিসটা ঘটে সেটা হল তাদেরকে চিহ্নিত করা হয় ‘কোটার প্লেয়ার’ হিসেবে। এমনটাই জানান দক্ষিণ আফ্রিকার অন্যতম ফ্রাঞ্চাইজি দল ‘নাইটস’ এর গ্রান্ট মোকোএনা।

‘‘সাদাদের এমন মনোভাব কৃষ্ণকায় খেলোয়াড়দের আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরিয়ে দেয় যা তাদেরকে দলে সেট হতে কঠিন সমস্যার মুখোমুখি করে তোলে। নিজেকে প্রমাণের জন্য তাই সর্বদাই উঠেপড়ে লেগে থাকেন কালো খেলোয়াড়েরা। দুই তিনটা খারাপ পারফর্মেন্স এবং এরপরই শুরু হয়ে যায় ঘোরতর সমালোচনা। কোটা সমালোচনায় নিজেকে প্রমাণের তাগিদে একজন কালো খেলোয়াড় সর্বোচ্চ পরিশ্রম শুরু করে কিন্তু একটা সময় দেখা যায় মানসিকভাবে তারা আরও ভেঙে পড়েছে’’।

গেল সিজনেই আরেকটি বিশেষ ঘটনা ঘটে কোবরা ফ্রাঞ্চাইজি দলটির অভ্যন্তরে। শ্বেতাঙ্গ একজনকে বসিয়ে রেখে একজন কৃষ্ণকায় ব্যাটসম্যানকে সুযোগ করে দেওয়া হয় সিজন শুরুর প্রথম চার ম্যাচে। কিন্তু কোনো কারণে সেভাবে পারফর্ম করতে পারছিল না কালো ব্যাটসম্যানটি। এরপরও তাকে পঞ্চম ম্যাচের একাদশে রাখা হয়। যার ফলে রাগের বশবর্তী হয়ে শ্বেতাঙ্গ ঐ ব্যাটসম্যান কালো ব্যাটসম্যানটিকে একপ্রকার শাসিয়ে দেয় এই বলে যে এই ম্যাচেও রান করতে না পারলে এবং পরের ম্যাচে আবার একাদশে খেললে সে অন্যদেরকে নিয়ে দলে ঝামেলার সৃষ্টি করবে।

‘‘গত কয়েক বছরে আফ্রিকান ক্রিকেট বেশ কয়েকজন ক্রিকেটারকে নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ডের হয়ে খেলতে দেখেছে যাদের কিনা খেলার কথা ছিল প্রোটিয়াদের হয়ে। আমি তাই মনে করি আফ্রিকায় ক্রিকেটারদের জাতীয় দলে সুযোগ দেওয়া উচিত তাদের দক্ষতা, স্কিল বিবেচনা করে। তাদের গায়ের রঙ দেখে নয়।’’ আফ্রিকান ঘরোয়া লীগগুলোতে সর্বশেষ সিজনে দুর্দান্ত ব্যাটিং করা কাগিসো রাপুলানার বিষয়টি নিয়ে ভাষ্য অনেকটা এরকমই।

‘ক্রিকেট সাউথ আফ্রিকা’র ক্রিকেট সার্ভিস ম্যানেজার এডওয়ার্ড খোজা’র মতে, ‘‘এখন ২০১৯ সালে এসে দেখা যাচ্ছে প্রচুর কালো খেলোয়াড় বয়সভিত্তিক দলগুলোতে রয়েছে এবং যার অধিকাংশই ব্যাটসম্যান। তারা দুর্দান্ত পারফর্ম করছে যা বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে বেঞ্চমার্ক হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে গত দুই বছর।’’

চলতি বিশ্বকাপে নিজেদের নামের প্রতি সুবিচার করতে পারছে না দক্ষিণ আফ্রিকা। ইতিমধ্যেই পাকিস্তানের কাছে হেরে বাদ পড়েছে বিশ্বকাপ থেকে। অথচ চোকার অপবাদ থাকা সত্ত্বেও দারুণ খেলে বিশ্বকাপের শেষচারে জায়গা করে নেওয়া অনেকটা অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছিল এই প্রোটিয়ারাই। বর্ণবাদ দেশটিতে নতুন নয়। ২০১০ বিশ্বকাপ ফুটবলের মূলপর্বে অংশ নেওয়া দক্ষিণ আফ্রিকার ফুটবল দলের দিকে তাকালে দেখা যাবে অধিকাংশ খেলোয়াড়ই সেখানে কৃষ্ণকায়। দশকের পর দশক ধরে দেশটির ক্রিকেটে এই বর্ণবৈষম্য তাদের খেলার মান, ‘চোকার’ অপবাদকে যে আরও পড়তির দিকে নিয়ে গিয়েছে তা কার্যত স্পষ্ট এবারের ক্রিকেট বিশ্বকাপে।

মিনহাজ ইসলাম - আলজাজিরা অবলম্বনে