বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা দর্শন ও জাতীয় বাজেটে শিক্ষা বরাদ্দ: সম্ভাবনা, প্রত্যাশা ও চ্যালেঞ্জ

ড. মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান লিটু
| আপডেট : ২৬ জুন ২০১৯, ১০:৫৯ | প্রকাশিত : ২৫ জুন ২০১৯, ২০:০৪

২০১৯-২০ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট নানাবিধ কারণে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এই বাজেট উপস্থাপনায় মাননীয় অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট বক্তৃতার প্রথমেই উল্লেখ করেছেন, স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তি এবং মহান নেতা শতাব্দীর শ্রেষ্ট বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ১০০ তম জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের প্রস্তুতি হিসেবে একটি সুখী সমৃদ্ধ আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণে এই বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে। তাই আলোচ্য নিবন্ধে জাতির জনকের শিক্ষা চিন্তার আলোকে বর্তমান বাজেটের শিক্ষা বরাদ্দের বিভিন্ন দিক, সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ আলোচিত হয়েছে।

শতাব্দীর মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আধুনিক বাংলাদেশ তথা তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা বির্ণিমানে শিক্ষার একটি দর্শন প্রবর্তন করেছিলেন, যা বর্তমান সময়েও অমূল্য বলে বিবেচিত হতে পারে। কিন্তু জাতির দূর্ভাগ্য, ১৯৭৫ সালের হৃদয় বিধারক ঘটনার পরে আজ অবধি শিক্ষা সংস্কারে এই অমূল্য দিকদর্শন পুরোপুরি স্টাডি হয়নি বা প্রতিষ্ঠার বৃহৎ আকারের কোন গবেষণা দেখা যায়নি। ভারতের জাতির জনক মাহাত্মা গান্ধীর শিক্ষা দর্শন প্রতিষ্ঠার জন্য অনেক ইনস্টিটিউট গড়ে তুলে ব্যাপক গবেষণা হয়েছে এবং হচ্ছে। এক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে রয়েছি।

বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা দর্শনের মূলে যদি আমরা দেখি, তাহলে দেখবো “একটি বৈষম্যহীন শোষণহীন উন্নত রাষ্ট্রব্যবস্থা” প্রবর্তনের জন্য আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক ও প্রগতিশীল উৎপাদনমূখী দেশপ্রেমিক জনসমষ্টি সৃষ্টিতে শিক্ষাকে অভিযোজিতকরণের দিক নির্দেশনা। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে প্রথমেমনোযোগি হয়েছিলেন এই যুদ্ধবিধ্বস্থ দেশের শিক্ষাকে পূনর্গঠনের। তিনি ঘোষণা করেছিলেন, “শিক্ষাই হবে মুক্তির হাতিয়ার”। এই মুক্তি হবে সংকীর্ণতা থেকে মুক্তি, এই মুক্তি হবে মানবতার মুক্তি, এই মুক্তি হবে দরিদ্র শোষিত জনগণের মুক্তি, এই মুক্তি হবে দেশের অর্থনৈতিক মুক্তি। আর শিক্ষার মাধ্যমেই গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন তাঁর আজন্মলালিত স্বপ্নের সোনার বাংলা। তাইতো তিনি শিক্ষাক্ষেত্রে যেমন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন, তদ্রুপ লিবারেল আর্টস (তথা সাহিত্য, ভাষা, সংস্কৃতি ইত্যাদি) বিষয়কেও গুরুত্ব প্রদান করেছিলেন। বর্তমান শিক্ষা বাজেটে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রতি অধিক গুরুত্ব অনেকক্ষেত্রেই সমাজের ক্রমধারায় সংহতি ও শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করণের মাধ্যমে শিক্ষার মূল কাজ সামাজিক রূপান্তরের জন্য অত্যাবশ্যকীয় লিবারেল আর্টসের বিষয়সমূহকে নিরুৎসাহিত করতে পারে। তাই এক্ষত্রে সর্তকতার সাথে নতুন বিশ^বিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠান স্থাপনে এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির শিক্ষাক্রমে লিবারেল আর্টসের বিষয়সমূহের সংমিশ্রণ ঘটাতে হবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সব সময় চেয়েছেন এই দেশের মানুষ যেন খেয়েপরে সুখে শান্তিতে বেঁচে থাকতে পারে, আত্নমর্যাদা নিয়ে যেন বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। এই খেয়ে পরে বেঁচে থাকা আর আত্নমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। সদ্য স্বাধীন দেশে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলোও তিনি এদেশের প্রথম বাজেটে প্রতিরক্ষা খাত থেকেও বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন শিক্ষাখাতে। কারণ তিনি কেবল রাজনীতিবিদ, রাষ্ট্রনায়কই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন শিক্ষা দার্শনিকও।

তিনি জানতেন শিক্ষার বিস্তার ও গুণগত মানের উন্নয়ন ব্যতীত আমাদের পক্ষে সামষ্টিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। তিনি ঘুণে ধরা সমাজকে বদলে দিতে চেয়েছেন। সেজন্য তিনি দিয়েছিলেন দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক। এই ডাকের মাধ্যেমে তিনি বাংলার সকল জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে দেশকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। তাই প্রবর্তন করেছিলেনসমাজতন্ত্র অভিমুখী গণমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার। বেতন মওকুফ, বিনামূল্য পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ, প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ, গণশিক্ষায় অর্থ আলাদাভাবে অর্থ বরাদ্দ, নারী শিক্ষার প্রসার, কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড ও জাতীয় গ্রন্থাগার গঠন,শিক্ষা কমিশন গঠন, বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ জারীসহ বিভিন্ন কার্যকরী পদক্ষেপের মধ্যে দিয়েতিনি গণমুখী শিক্ষার দিকে জাতিকে ধাবিত করেছিলেন।কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার উন্নয়ন, বিজ্ঞান, কৃষি, চিকিৎসা, বাণিজ্য, আইন, ললিতকলা, প্রভৃতি জীবনঘনিষ্ঠ শিক্ষার জন্য পৃথক বিস্তৃত পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর শিক্ষাদর্শনের মাঝেই আছে আত্ননির্ভরশীল, অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী, মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন একটি জাতি হিসেবে গড়ে ওঠার মূলমন্ত্র।

বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাদর্শন অনুসরণ করেই তাঁর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন দৃঢ়ভাবে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় কেবল সংখ্যাগত প্রবৃদ্ধিই ঘটেনি, গুণগত মানেরও উন্নয়ন ঘটছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটেও সেই প্রতিফলনই দেখা যায়। তবে এখনও যে কিছু সমস্যা রয়ে গেছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই।

বাজেট পেশ হলেই কিছু না ভেবেই বিরোধীদলগুলোর এবং সেই সঙ্গে আমাদের তথাকথিত সুশীল সমাজের বাজেট প্রত্যাখান করা এক ধরনের রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। যত ভালো বাজেটই হোক না কেন, তারা একচোখা দৃষ্টিতে একনিষ্ঠভাবে সমালোচনা কর্মটি সুসম্পন্ন করে থাকে। এবারের বাজেটের ক্ষেত্রেও সেই একই চিত্র। শিক্ষার ক্ষেত্রে যেসব ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে সেগুলোর আলোচনায় না গিয়ে তারা সমালোচনার ডালি খুলে বসেছে। তারা সমালোচনা করতে থাকুক, এই ফাঁকে আমরা শিক্ষাখাতের ওপরএবারের বাজেট প্রস্তাবনাগুলো বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা চিন্তার প্রেক্ষাপটে শিক্ষা বিষয়ের গবেষক হিসেবে পর্যালোচনা করে বাজেটে শিক্ষার অবস্থা কেমন তা দেখার চেষ্টা করতে পারি।

এই বাজেটের আকার যেমন বড়, তেমনি শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বাধিক। এবারের বাজেটে ২৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে দায়িত্ব দিয়ে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণকে কার্যক্রমকে যুক্ত করে ২০১৯-২০ অর্থবছরের শিক্ষা বাজেটে মোট ৮৭ হাজার ৬২০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে যা মোট বাজেট বরাদ্দের ১৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এটা জিডিপির ৩ দশমিক ০৪ শতাংশ। এটি এখন পর্যন্ত বাজেটে শিক্ষায় সর্বোচ্চ বরাদ্দ। অন্যান্যবারের মতো শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতকে এক করে দেখানো হয়েছে। প্রযুক্তি খাতকে বাদ দিলে শিক্ষা খাতের বরাদ্দ দাঁড়াচ্ছে ১১ দশমিক ৬৮ শতাংশ যা আগের বছরের বাজেটের চেয়ে শতাংশের হিসাবে ০ দশমিক ০৯ শতাংশবেড়েছে। গত আটটি অর্থবছরের মধ্যে এক বছর বাদে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ জাতীয় বাজেটের ১০-১২ শতাংশের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। অথচ ইউনেস্কোর চাওয়া জাতীয় বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দ। তাছাড়া আমরা যদি এসডিজির সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন চাই তাহলেও শিক্ষায় বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে। এসডিজির চার নম্বর লক্ষ্যে শিক্ষার উন্নয়নের কথা বলা হলেও এটিই মূলত অন্যান্য লক্ষ্যগুলো পূরণের মূল কেন্দ্রবিন্দু। তাই সংশোধিতবাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা জরুরি। আশার কথা পর্যায়ক্রমে শিক্ষার বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হবে বলে ইতোমধ্যে শিক্ষামন্ত্রী আমাদের আশ¡স্ত করেছেন।

শিক্ষার সার্বিক উন্নযনে শিক্ষকদের পেশাগত সন্তুষ্টি অত্যন্ত জরুরি। অনেক দিন বন্ধ থাকার পরে, এই বাজেটে আবারো এমপিও ভুক্তির জন্য বাজেট বরাদ্দ নিসন্দেহে একটি ভালো উদ্যোগ। কিন্তু বরাদ্দকৃত অর্থে ৯৭% বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত মাধ্যমিক শিক্ষার সকল শিক্ষককে এমপিওবুক্তির আওতায় আনা যাবে না, সেক্ষেত্রে এই এমপিওভুক্তির কারণে বিদ্যালয় ব্যবস্থায় শিক্ষকদের মাঝে এমপিও বনাম নন-এমপিও একটি বিভেদ তৈরি হতে পারে, যা সার্বিক ভাবে তাঁর শেখন-শেখানো কার্যক্রমকে প্রভাবিত করতে পারে।

এক্ষত্রে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও নীতি অনুসরণ করা যেতে পারে। যুদ্ধবিধ্বস্থ দেশে দেশে শত প্রতিকূলতা ও আর্থিক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও শিক্ষার উন্নয়নে তিনি প্রাথমিক শিক্ষার উপওে সর্বপ্রথম গুরুত্ব দিলেন। তিঁনি গ্রহণ করলেন প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করার অবিস্মরণীয় সিদ্ধান্ত। ‘প্রাইমারী এডুকেশন টেকওভার এ্যাক্ট’এর মাধ্যমে সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মচারীদের চাকরি সরকারি করলেন, যাতে শিক্ষকদের মাঝে পড়ানোর আগ্রহ থাকে এবং কোন বিভেদ না থাকে। একইসাথে জাতি গঠনে তাঁরা ভ’মিকা রাখতে পারেন। বঙ্গবন্ধু সময় পেয়েছিলেন খুবই অল্প। তাই হয়েতো তিনি মাধ্যমিক শিক্ষাকে একইভাবে জাতীয়করণ কওে যেতে পারেননি, কিন্তু জাতি তাকিয়ে রয়েছে তাঁরই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দিকে। যেহেতু বর্তমান সময়ে ঘোষিত জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে সকলের জন্য গুণগত ও একীভূত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে, সেহেতেু এদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে ঐতিহাসিকভাবে অবহেলিত এই মাধ্যমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণের ন্যায় একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় এসছে। এক্ষত্রে অর্থ কোন বাধা হয়ে দাড়াবে না। কেননা শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যয়কে বঙ্গবন্ধু দেখেছিলেন বিনিয়োগ হিসেবে, যার সুফল আজ আমরা ভোগ করছি।

বর্তমান বাজেটে দেশের উন্নয়নে আধুনিক বিশে^র সাথে তাল মিলিয়ে শিল্প বিপ্লব-৪.০ কে টার্গেট করা হয়েছে, কেননা বিশ্বের উন্নত দেশগুলো শিল্পায়নের চর্তুথ স্তরে উন্নীত হয়েছে এবং সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তারা শিক্ষা পদ্ধতিকেও চতুর্থ স্তরে উন্নীত করেছে। বিশে^র দরবারে জ্ঞান বিজ্ঞানে মাথা উঁচু করে দাড়ানোর প্রয়াস বর্তমান বাজেটে উচ্চ শিক্ষাকে শিল্প বিপ্লব-৪.০ এর জন্য তৈরি করার প্রয়াস ঘোষিত হয়েছে, যা সময়ের বিবেচনায় অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও সাহসী পদক্ষেপ। কেননা এই শিল্প বিপ্লব-৪.০ এর সমান্তরাল শিক্ষা ব্যবস্থা হচ্ছে এডুকেশন ৪.০, যা শিক্ষাক্ষেত্রে শ্রেণি পঠন-পাঠন থেকে শুরু করে শিক্ষার প্রতিটিক্ষেত্রে বিশেষ বিশেষ ব্যবস্থাগ্রহণকে নিশ্চিত করে। প্রকৃতপক্ষে, এডুকেশনের বিভিন্ন জেনেরেশন রয়েছে। শিক্ষা বিজ্ঞানে এই জেনারেশন সমূহ এডুকেশন ১.০, এডুকেশন২.০, এডুকেশন ৩.০ এবং এডুকেশন ৪.০ নামে পরিচিত। আধুনিক চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুবিধাগ্রহণে অবশ্যই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে এডুকেশন ৪.০ এ উত্তরিত হতে হবে, নতুবা ইনোভেটিভ, প্রডাকটিভ এবং যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় চৌকষ প্রজন্ম তৈরি অধরাই রয়ে যাবে। তাত্ত্বিকভাবে আমাদেরকে শিক্ষাব্যবস্থাকে এডুকেশন ৪.০ তে উত্তরণের জন্য শিক্ষার্থীদের প্রাতিষ্ঠানিক শিখনে পাঁচটি আই (5 I’s) নিশ্চিত করতে হবে [যথা: Imbibing, Iterating, Interpreting, Interest,, এবং Innovating]।

এজন্য ভিন্নভাবে চিন্তণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমাদের টেক্সটবইসমূহ এক্ষেত্রে বাধা তৈরি করছে। অনেকক্ষেত্রে এডুকেশণ ১.০ এর মুখস্তবিদ্যা নির্ভর শিক্ষাকেউৎসাহিত করছে। অপরদিকে রাতারাতি এডুকেশন ১.০ হতে এডুকেশন ৪.০ তে উত্তরণ ঘটানো সম্ভব নয়। আমাদের বিদ্যালয় ব্যবস্থা এখনো অনেকক্ষেত্রে পুরোপুরি এডুকেশন ২.০ বাস্তবায়িত হয়নি, এমতাবস্থায় উচ্চ শিক্ষায় এডুকেশন ৪.০ প্রবর্তনের লক্ষ্য নির্ধারণ অসম্ভব না হলেও অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন অর্থায়নে বাস্তবায়িত একটি প্রকল্প “স্কুল অন দ্যা ক্লাউড” এ এডুকেশন ৪.০ বাস্তবায়নের জন্য টেকনোলজির সাথে সাথে ‘Leadership for Change’ কে অত্যাবশ্যকীয় হিসেবে দেখা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ন্যায় পরিবর্তনের নেতৃত্ব প্রয়োজন।

এক্ষেত্রে বাংলাদেশের শিক্ষা নেতৃত্বেও জন্য বঙ্গবন্ধুর কর্ম ও শিক্ষা দর্শন অধ্যয়ন সহায়ক হতে পারে। একই সাথে শিক্ষা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ তৈরিতে বাজেটের বরাদ্দ সুনির্দিষ্ট করা প্রয়োজন হবে। মনে রাখতে হবে, “শিক্ষা”- একটি মৌলিক অধ্যয়নের বিষয় (যেমন পদার্থবিজ্ঞান, অর্থনীতি ইত্যাদি মৌলিক অধ্যয়নের বিষয়) হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। যে কোন স্তরে শিক্ষকতা করলে তথা যেকোন বিষয়ে শ্রেণিতে পাঠদান করলেই শিক্ষা বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠা যায় না। এর জন্য ‘শিক্ষা’ নামক বিষয়টিতে বেসিক গ্রাজুয়েশন, মাস্টার্স, এমনকি পিএইচডি ডিগ্রী প্রয়োজন হয়। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ জরুরি। চিকিৎসাক্ষেত্রে যেমন একজন দন্তরোগ বিশেষজ্ঞকে দিয়ে ওপেন হার্ট সার্জারি করালে রোগীর মৃত্যুর সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ, তদ্রুপ শিক্ষাক্ষেত্রে নতুনত্ব প্রবর্তনে এবং প্রয়োজনীয় সংস্কারে যথাযথ বিশেষজ্ঞ ব্যতীত তথাকথিত শিক্ষা বিষয়ে ডিগ্রীবিহীন শল্য চিকিৎসকদের দিয়ে পরিকল্পনা প্রণয়ন সরকারের শিক্ষা সংস্কারের সদিচ্ছাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।

বিদ্যালয় শিক্ষার শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক নিয়ে এনসিটিবি নিরলসভাবে কাজ করে গেলেও শিক্ষা বিজ্ঞানে বিশেষজ্ঞদের অভাবের কারণে এর সুফল খুবই কম পাওয়া যাচ্ছে, উপরন্তু শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যবই নিয়ে অযথা বিতর্কেও সৃষ্টি হচ্ছে। এভাবে দেখা যায়, শিক্ষা ব্যবস্থা আধুনিকায়নে যে সব প্রতিষ্ঠান কাজ করছে, তার অধিকাংশেরই শিক্ষা বিজ্ঞানে বিশেষজ্ঞ জনবল নেই। ফলে প্রচুর বিনিয়োগের পরেও প্রায়শই কাঙ্খিত ফললাভ সম্ভব হচ্ছে না। উন্নত বিশে^ একজন ‘কম্পিউটার বিষয়’-এ বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিকে অবশ্যই ‘কম্পিউটার প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা ও নীতিনির্ধারণে ব্যবহার করা হয়, কিন্তু আমাদের দেশের মতো কখনোই শিক্ষা বিজ্ঞানের মৌলিক বিষয়াদির (যেমন মূল্যায়ন তথা পরীক্ষা ব্যবস্থা, শিক্ষা পরিকল্পণা ইত্যাদি) ক্ষেত্রে নয়। কেননা এত ভ্রান্ত ধারণা তৈরি হতে পারে। যেমন হয়েছে, বিশ^ব্যাংকের প্রেসক্রিপশনে পরীক্ষা পদ্ধতি সংস্কারের নামে ‘কাঠামোবদ্ধ প্রশ্ন’ প্রবর্তনের উদ্যোগে সৃষ্ট পিতামাতার আন্দোলন প্রশমনে কোন বিস্তৃত কনটেক্সটচুয়ালাইজড গবেষণা ব্যতীত “সৃজনশীল” নামে চালিয়ে দেয়ায়। যদিও এবারের শিক্ষা বাজেট কাগজে কলমে একটি নতুন সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচন করেছে, কিন্তু যোগ্য ব্যক্তিদের যোগ্যস্থানে না বসালে ব্যর্থতায় পর্যবেশিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর একটি অদ্ভুত ঈশ^র প্রদত্ত ক্ষমতা ছিল। তিনি উপলব্দি করতে পারতেন, জনগণের প্রয়োজনকে, তিনি উপলব্দি করতে পারতেন কাকে দিয়ে কাজ হবে, এবং কীভাবে একটি লক্ষ্য পূরণ করতে হবে। তাইতো আমরা দেখি যুদ্ধ বিধ্বস্থ দেশে শিক্ষা ব্যবস্থাকে পুর্নগঠনে যোগ্য নেতৃত্ব নির্বাচনে সকল গতানুগতিক ধারার বাইওে গিয়েছেন। শিক্ষা সচিব হিসেবে আমলাতন্ত্রের বাইরে থেকে অধ্যাপক কবীর স্যারকে দায়িত্ব দিয়েছেন। আবার আধুনিক শিক্ষা বির্ণিমানে বৈজ্ঞানিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনে বিখ্যাত বিজ্ঞানী ড. কুদরাত-ই-খুদার নেতৃত্বে একদল শিক্ষা বিশেষজ্ঞকে নিয়োজিত করছিলেন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই বিস্তৃত আকারের বাজেট বাস্তবায়নে বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথ অনুসরণের কোন বিকল্প নেই। যোগ্য নেতৃত্ব শিক্ষা প্রশাসনে নিয়ে আসতে ব্যর্থ হলে প্রত্যাশিত শিক্ষার উন্নয়ন ঘটবে না, উল্টো জাতি আরো পিছিয়ে পড়তে পারে। বঙ্গবন্ধু কন্যার সমস্ত প্রচেষ্টা বাস্তবায়নে যোগ্য শিক্ষা নেতৃত্বের কোন বিকল্প নেই।

শুধু বাজেটে বড় আকারের বরাদ্দ রাখলেই শিক্ষার উন্নয়ন ঘটবে না। বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা চিন্তা অনুযায়ী শিক্ষায় দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা জরুরি, একই সাথে সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করে শিক্ষায় অপচয় ও দুনীর্তি বন্ধে ব্যবস্থাগ্রহণ জরুরি। ১৯৭২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর জাতীয় শিক্ষা কমিশনের উদ্বোধনী ভাষণে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শিক্ষা কমিশনের সদস্যগণকে বাংলাদেশের জনগণের বাঞ্জিত সমাজতান্ত্রিক সমাজ সৃষ্টির জন্য পুনর্গঠিত নতুন শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে স্বাধীনভাবে তাঁদেও সুচিন্তিত পরামর্শ দানের আহবান জানান। তিনি আরো বলেন, আমাদেও সীমিত সম্পদের কথা স্মরণ রেখে কমিশন শিক্ষার এমন এক দীর্ঘমেয়াদী রূপরেখা প্রণয়ন করবেন যা শিক্ষাক্ষেত্রে সার্থক ও সুদূরপ্রসারী সংস্কার সাধনে সাহায্য করবে। কেননা বঙ্গবন্ধু উপলব্দি করেছিরেন, যে কোন দেশের মানবসম্পদকে মানবপূঁজিতে পরিণত করে উন্নয়নের মূলধারায় অংশগ্রহণে সক্ষম নাগরিকে পরিণত করার জন্য প্রয়োজন সুদূরপ্রসারী জনশক্তি পরিকল্পনা। আর এ পরিকল্পনার আওতায় দক্ষ ও বিশেষজ্ঞ নাগরিক সৃষ্টির একমাত্র মাধ্যম বা কৌশল হলো ‘শিক্ষা’।

শিক্ষাকে বর্তমানে একটি লাভজনক বিনিয়োগক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে বিশ্বজুড়ে। কারণ শিক্ষাক্ষেত্রে বিনিয়োগের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ (গুণগত) বিনিময়মূল্য পাওয়া সম্ভব। তাই অপরিকল্পিতভাবে শিক্ষার বিকাশ না ঘটিয়ে যথাযথ পরিকল্পণার জন্য বর্তমান বাজেটের আলোকে একটি স্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠন করা যেতে পারে। কেননা বঙ্গবন্ধু চাইতেন জাতীয় উন্নয়নে দেশের সকল নাগরিকের সমঅংশীদারিত্বের সুযোগ সৃষ্টি হোক আর এটা হবে একটি রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। তাই সবস্তরের শিশুদের আত্ম উন্নয়নে সমাজের মূল স্রোতধারার সাথে স¤পৃক্ত করার জন্য অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বৈষম্যহীন সোনার বাংলা গঠনে শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। এসবদিক বিবেচনা করে বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ এর সংবিধানে একটি বৈষম্যহীন গণমুখী একইধারার শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের বিষয়টি অর্ন্তভ’ক্ত করেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের পরে থমকে যায় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সামাজিক ন্যায় বিচার প্রপঞ্চের ভিত্তিতে শিক্ষাব্যবস্থাকে পুনর্গঠনের উদ্যোগ। আবার সময় এসছে। বঙ্গবন্ধুর কন্যা এখন রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন। তাই বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত একইধারার বৈষম্যহীন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্যোগকে এগিয়ে নেওয়ার এখনই প্রকৃত সময়।

আর বৈষম্যহীন শিখ্ষঅ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে বর্তমান বাজেটে যেমন বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে, তেমনি পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক গোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষঅ বৃত্তির হারও বৃাদ্ধিও প্রস্তাব করা হয়েছে। এভাবে ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাজেট বরাদ্দে শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারপরেও যেন শিক্ষা নিয়ে একটি কৌশলগত সমন্বিত আইনের অভাবে একটি শূণ্যতা বিরাজ করছে। যদিও মহামান্য হাইকোর্ট ২০১৭ সালে ‘Bangladesh Education Code’ নামে একটি কৌশলগত শিক্ষা আইন প্রণয়নের নির্দেশনা দিয়েছিলো। তাই এই বড় আকারের শিক্ষা বাজেট বাস্তবায়নের মাধ্যমে সুফল নিশ্চিত করতে যুগের দাবি অনুযায়ি একটি সামগ্রিক শিক্ষা আইন প্রণয়ন জরুরি হয়ে পড়েছে।

এবারের বাজেটে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বাবদ ২৪ হাজার ৪১ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষায় আমরা ইতোমধ্যে আমরা ঈষর্ণীয় সাফল্য অর্জন করেছি। অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নের ক্ষেত্রেএই বরাদ্দ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তবে এবছর মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষাখাতকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এবারের বাজেটে ২০১৯-২০ অর্থবছরে শুধুমাত্র মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা খাতে উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা ২০১৮-১৯ অর্থবছরের উন্নয়ন বরাদ্দের তুলনায় ৫৪ শতাংশ বেশি।গত বছরের জুলাইয়ে এমপিওভুক্তির জন্য বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জনবলকাঠামো ও এমপিও নীতিমালা-২০১৮ জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

এরপর গত আগস্টে এমপিওভুক্তির জন্য আবেদন নেয়া হয়। মোট ৯ হাজার ৬১৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আবেদন করে।যাচাইয়ে এমপিও নীতিমালার সব শর্ত পূরণকারী যোগ্য ২ হাজার ৭৬২টিপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করার ঘোষণা এসেছে এই বাজেটে। দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকা এমপিওভুক্তির ক্ষেত্রে এই ঘোষণা খুবই আশাব্যঞ্জক। তবে যদি বাদবাকি সবগুলোকেই এমপিওভুক্তি করা যেত তবে কেউ পাবে কেউ পাবে না এমন বৈষম্যটা যেমন দূর হতো, তেমনি বিদ্যালয়গুলো সরকারের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে চলে আসত। ম্যানেজিং কমিটির দৌরাত্নও হ্রাস পেত যা শিক্ষার উন্নয়নের ক্ষেত্রে সহায়ক হতো। এদিকটি সরকার গভীরভাবে বিবেচনা করবে বলে আশা করি।সারাদেশে ২৬ হাজার ২০০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৪৮ হাজার ৯৪৭টি মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ, ২০০টি ল্যাংগুয়েজ কাম আইসিটি ল্যাব, ১ হাজারটি সায়েন্স ল্যাব, ২ হাজার ১২০টি স্মার্ট শ্রেণিকক্ষ, ৪৬টি হোস্টেল নির্মাণ এবং আসবাবপত্র, অফিস সরঞ্জামাদি ও আইসিটি উপকরণ সরবরাহ করার কথা বলা হয়েছে। এগুলো খুবই ইতিবাচক উদ্যোগ। শিক্ষার গুণগত মানের উন্নয়নে এগুলোর বিকল্প নেই।

তবে একটা কথা, শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অবকাঠামো শিক্ষার উন্নয়নের ক্ষেত্রে যেমন গুরুত্বপূর্ণ,তেমনি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষার্র্থীর সামর্থ্য ও যুগের চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করা। এক্ষেত্রে আমরা উন্নত বিশ্বের দেশগুলো থেকে ভীষণ পিছিয়ে আছি। এবারের বাজেটে শিক্ষার অন্যান্য ফ্যাক্টরগুলোকে গুরুত্ব দেয়া হলেও শিক্ষাক্রমের বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়নি। অথচ যুগের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের শিক্ষাক্রমগুলো ঢেলে সাজানোর নির্দেশনা এই বাজেটে থাকা দরকার ছিল। আরেকটি বিষয় না বললেই নয়, আমাদের দেশের শিক্ষাক্রম পরিকল্পনা ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়েনর সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের বেশিরভাগই শিক্ষা বিশেষজ্ঞ নয়। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে যেখানে শিক্ষা ও গবেষণায় উচ্চতর ডিগ্রিধারীরা এই কাজে যুক্ত সেখানে আমাদের দেশে বিভিন্ন বিষয়ের উচ্চতর ডিগ্রিপ্রাপ্তরা এ কাজে যুক্ত।

এবারের বাজেটে আইন পাশ হওয়া নতুন পাঁচটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলা হয়েছে। আমাদের দেশে ক্রমান¡য়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে আমরা আনুভূমিক উন্নয়নের দিকে গুরুত্ব দিয়ে একের পর এক পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় গঠন করে চলছি। এতে গ্র্যাজুয়েটের সংখ্যা বাড়ছে এটা সত্য, কিন্তু সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা।পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে উচ্চ শিক্ষার হার কম কিন্তু বিশেষায়িত শিক্ষার্থীর হার অনেক বেশি। আমাদের দেশে ঠিক এর উল্টো দৃশ্যপট।

উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে যুগের চাহিদা বিবেচনা করে বিশেষায়িত শিক্ষার উপর গুরুত্ব দিয়ে এবারের বাজেটে নির্দেশনা থাকলে ভালো হতো। আবার প্রযুক্তি বিদ্যার সঙ্গে সঙ্গে মানবিক ও কলা বিদ্যার উন্নয়নের জন্য নির্দেশনা থাকাও বাঞ্চনীয় ছিল। বঙ্গবন্ধু আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা কেবল আমলা সৃষ্টি করেছে, মানুষ সৃষ্টি করেনি।’ আমাদের বর্তমানের উচ্চ শিক্ষার প্রকৃত লক্ষ্যই যেন হয়ে দাঁড়িয়েছে একটা ভালো চাকুরি পাওয়া, মানুষ হওয়া নয়।তাই তো এদেশে দুর্নীতির সঙ্গে যে তথাকথিত শিক্ষিত মানুষরাই দায়ী এই কথা বঙ্গবন্ধু বলিষ্ঠভাবে বলেছিলেন। আশার কথা বর্তমানসরকার ইতোমধ্যে জাতীয় শুদ্ধাচার কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। তবে তা কেবল চাকুরিজীবীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণকারীদের মাঝেও বিস্তৃত করার কার্যক্রম সংশোধিত বাজেটে অর্ন্তভুক্ত করা উচিত। উচ্চ শিক্ষার গবেষণায় বাজেট অপ্রতুলতা বহুল আলোচিত একটি বিষয়।

এবারের বাজেটেও উচ্চ শিক্ষায় গবেষণার ওপর খুব একটা গুরুত্ব দেয়া হয়নি। সংশোধিত বাজেটে বিভিন্ন খাতওয়ারী উচ্চশিক্ষার গবেষণায় বরাদ্দ বৃদ্ধি করা উচিত। সেই সঙ্গে সেই বরাদ্দ সঠিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে কিনা সেটা মনিটরিং করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ দরকার। এক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় না বললেই নয়, আমাদের দেশে দেখা যাচ্ছে সরকারি আমলারা সরকারি সহায়তায় পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করছে যা মনে হয় না তাদের পেশাগত জীবনে খুব একটা কাজে লাগে। পিএইডি গবেষণা মূলত শিক্ষক ও গবেষকদের জন্যই বেশি প্রয়োজন। গুরুত্ব বিবেচনা নিয়েই সরকারকে এই সহায়তাগুলো দেয়া উচিত। আমাদের দেশে কেউ অ্যাপ্লাইড ফিজিক্স পড়ে ব্যাংকার হচ্ছে, কেউ বুয়েট ও মেডিক্যাল থেকে পাশ করে বিসিএস ক্যাডারসহ অন্যান্যপেশায় যাচ্ছে যা শিক্ষায় বিনিয়োগের ভীষণ অপব্যয় ছাড়া আর কিছু নয়। এ বিষয়ে এবারের বাজেটে কোনো নির্দেশনা নেই অথচ থাকা দরকার ছিল।

শিক্ষার সঙ্গে বাজারের চাহিদার সংযোগ সৃষ্টি করা অত্যন্ত জরুরি। এবারের বাজেটে সেই বিষয়টি মাথায় রেখে কারিগরি শিক্ষার অগ্রগতির জন্য প্রতিটি উপজেলায় একটি করে টেকনিক্যাল স্কুল তৈরির প্রস্তাব দেয়া হয়েছে এই বাজেটে। প্রাথমিক পর্যায়ে ২ হাজার ২৮১ কোটি টাকা ৬৯ লক্ষ টাকা ব্যয়ে ১০০টি উপজেলায় টেকনিক্যাল স্কুলের প্রস্তাব করা হয়। এছাড়াও ভূমি জরিপ শিক্ষা উন্নয়ন, ২৩টি জেলায় পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট, কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরাধীন ৬৪টি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজের সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে।

কারিগরি শিক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে ৪টি বিভাগীয় শহরে ( সিলেট, বরিশাল, ময়মনসিংহ ও রংপুর) মহিলা পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট স্থাপনের প্রস্তাব করা হয়েছে।কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা কর্মসূচিতে বৈচিত্র্য আনার লক্ষ্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে। তবে জনগণকে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় উৎসাহিত করার জন্য প্রেষণামূলক কার্যক্রম গ্রহণের কথা বাজেটে উল্লেখ করা হয়নি। এটি অত্যন্ত জরুরি। মাদ্রাসা শিক্ষায় এ বছর সর্বোচ্চ ৭ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয় যা ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ছিল ৫ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকা। এই অর্থ মাদ্রাসার অবকাঠামো উন্নয়ন, পাঠ্যপুস্তক বিতরণ, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও বৈষম্য দূরে ব্যবহারে ব্যয় হবে বলে জানানো হয়েছে। তবে সবচেয়ে আশার কথা হচ্ছে মাদ্রাসাগুলোতে ভোকেশনাল শিক্ষার প্রচলনের যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তা অত্যন্ত জীবনঘনিষ্ঠ একটি উদ্যোগ। এর ফলে মাদ্রাসা থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীরাও দক্ষ জনসম্পদে পরিণত হবে।

জাতীয় সংসদে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষার উন্নয়নে প্রয়োজনে বিদেশ থেকে শিক্ষক আনার কথা বলা হয়েছে।এই বিষয়ে জাপানের সম্রাট মেইজির উদাহরণ টেনে তিনি বলেছেন, মেইজির সময়ে জাপান শিক্ষায় অনগ্রসর ছিল। তখন তিনি অনুধাবন করেন জাপানে ছাত্রের অভাব নেই, আছে উপযুক্ত শিক্ষকের অভাব। তাই তিনি প্রযুক্তি নির্ভরপ্রশিক্ষিত কয়েক হাজার শিক্ষককে জাপানে নিয়ে আসেন। এভাবে জাপান জ্ঞান বিজ্ঞানে অগ্রসর হয় এবং পাশ্চাত্যের দেশগুলোকেও ছাড়িয়ে যায়। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর এই কথাতেই প্রমাণ হয় তিনি শিক্ষার গুণগত মানের বৃদ্ধি ও যুগের চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষা কার্যক্রমকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তবে একটা কথা হচ্ছে, বাইরে থেকে বিদেশিদের আনার আগে আমাদের দেশ থেকে যেসব মেধাবীরা চলে গেছে তাদেরকে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া উচিত। আমাদের দেশের প্রচুর মেধাবী মানুষ এখন বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাসহ নানান পেশায় অনেক ভালো করছেন।অনেকে তাঁর মেধা ও মনন দিয়ে বিশ্বের মানুষকে তাক লাগিয়ে দিচ্ছেন। তবে আমরা কেন তাদেরকে কাজে লাগাতে পারছি না? যতদ্দূর মনে হয় এঁদের বেশির ভাগই যদি উপযুক্ত সম্মান, স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা পায় তবে বিদেশে প্রাপ্ত অর্থের তিনভাগ কম পেলেও এদেশে এসে তাঁরা দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখবেন।এ বিষয়টি সরকার ভেবে দেখতে পারে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের জাতির পিতাকে নিয়ে গবেষণা সেন্টার করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে তেমন কোনো গবেষণা সেন্টার নেই। অনেকেই তাঁকে নিয়ে অনেক বই লিখেছেন, কিন্তু গবেষণার সংখ্যা অপ্রতুল। আর বেশির ভাগ গবেষণাই হয়েছে ব্যক্তিক উদ্যোগে। আশা করেছিলাম এবারের বাজেটে বঙ্গবন্ধু গবেষণা সেন্টার প্রতিষ্ঠা বিষয়ে কোনো ঘোষণা আসবে। কিন্তু এলো না। বাঙালি জাতিকে বঙ্গবন্ধুর আর্দশে দীক্ষিত করার জন্য এমন সেন্টারের কোনো বিকল্প নেই।

পর্যালোচনার মাধ্যেমে আমরা দেখছি এবারের বাজেটে শিক্ষার ক্ষেত্রে কিছু কিছু দুর্বলতা রয়ে গেছে। তারপরও সরকারকে ধন্যবাদ জানাতে হয় এবারের বাজেটে শিক্ষার গুণগত মানের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করায়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ড. কুদরত ই খুদার নেতৃত্বে গঠিত শিক্ষা কমিশন যে সুপারিশগুলো করেছিল এত বছর পর হলেও সেই সুপারিশগুলোর বাস্তবায়ন উদ্যোগ এবারের বাজেটে অনেকটাই প্রতিফলিত হয়েছে। তবে বাজেটের সঙ্গে সঙ্গে বরাদ্দকৃত অর্থের সুষ্ঠু ব্যবহার ও শিক্ষা উদ্যোগগুলোর সঠিক বাস্তবায়নে কঠোর তদারকির ব্যবস্থা করা বাঞ্চনীয়। তাহলেই ‘সমৃদ্ধ আগামীর পথযাত্রায় বাংলাদেশ : সময় এখন আমাদের, সময় এখন বাংলাদেশের’ শিরোনামটি সার্থক হবে।

লেখক: ড. মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান লিটু, সহযোগী অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান বিশেষ শিক্ষা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং আরিফুর রহমান, শিক্ষা গবেষক, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

শিক্ষা বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :