পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি: এই ‘পাপ’ মমতারই

আমিনুল ইসলাম
 | প্রকাশিত : ২৬ জুন ২০১৯, ১৬:৪০
মমতা বন্দোপাধ্যায়

পশ্চিমবঙ্গে বিজেপিবিরোধী ঝান্ডা এখন যার হাতে, সেই মমতা বন্দোপাধ্যায়ের হাত ধরেই রাজ্যে হানা দিয়েছিল হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বিজেপি। দলটিকে তিনিই প্রথম এ রাজ্যবাসীর কাছে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।

পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য একবার মন্তব্য করেছিলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গের মতো উদার রাজ্যে বিজেপির মতো হিন্দুত্ববাদী দলকে আমন্ত্রণ জানিয়ে যে পাপ মমতা করেছেন, এ পাপের মাশুল তাকে দিতেই হবে।’

নিয়তির কী নির্মম পরিহাস! বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ভবিষ্যৎবাণী আজ অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেল। বিজেপি আজ সর্বশক্তি দিয়ে মমতাকে বিনাশের পথ খুঁজছে। ১৯৯৯ সালে যখন অটল বিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে বিজেপি সরকার গঠন করে, মমতা তখন সেই বিজেপি সরকারে যোগ দেন এবং রেলমন্ত্রী নির্বাচিত হন।

পশ্চিমবঙ্গে তখন অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়েও বিজেপিকে খুঁজে পাওয়া যেত না। সেই মুহূর্তে মমতা বিজেপিতে যোগ দেন। ২০০১ সালে আবার বিজেপি সরকার থেকে সরে আসেন। তেহলকা ডটকম কেলেঙ্কারিকে ইস্যু করে এই সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ২০০১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে মমতা কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করেন। তার এই রংবদলকে ভোটাররা ভালো চোখে দেখেন, তাই তার দলও বিধানসভায় সুবিধা করতে পারেনি।

মমতার ডিগবাজি

২০০১ সালে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করার তিন বছর পর ২০০৪ সালে আবার বিজেপিতে যোগ দেন মমতা। ভেবেছিলেন বিজেপি ফের ক্ষমতায় এলে আবার মন্ত্রিত্ব পাবেন। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে ক্ষমতায় আসে কংগ্রেস জোট। ৪২ আসনের পশ্চিমবঙ্গে মমতা পান মাত্র একটি আসন। তার নিজের আসনটিই হয়ে উঠে একমাত্র অবলম্বন।

সংসদে গরম গরম বক্তৃতা দিয়ে মাতিয়ে রাখতেন। আজ যে এজেন্ডা নিয়ে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের মাঠ গরম করছে, সেই এজেন্ডা নিয়ে সংসদে সরব হয়েছিলেন তিনি। অবৈধ বাংলাদেশি অনুপ্রবেশের ইস্যুতে তিনি স্পিকার সোমনাথ চ্যাটার্জির সঙ্গে ‘বেয়াদবি’ও করেন। স্পিকার বললেন, যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করে এই ইস্যু তোলা হয়নি। তাই এটা নিয়ে কোনো কথা হবে না। ক্ষুব্ধ মমতা স্পিকারের সামনেই ফাইল ছুঁড়ে মারেন।

পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের বোঝা উচিত, তাদের একমাত্র বন্ধু হবে তাদের যোগ্যতা, দক্ষতা ও শিক্ষা। কোনো রাজনৈতিক দল তাদেরকে বাঁচাতে পারবে না। বাঁচতে হবে নিজেদের শক্তি দিয়ে। বর্তমান মুসলিম দরদী মমতা বহুবার মুসলমানদের বিরুদ্ধে তোপ দাগিয়েছেন। আর আজ মুসলমানদের ভোটের জন্য তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। আগেরটাও ছিল রাজনীতি, আর এখানেরটাও।

মমতার অন্ধ বাম বিরোধিতা মুসলমান ভোটের জন্য আকুতি

বিজেপির সঙ্গে মেশার কারণে ২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে মমতার দল একেবারে গো-হারা হারে। ২৯৪ আসনের বিধানসভা নির্বাচনে মমতা পান মাত্র ৩০টি। বামফ্রন্ট পায় ২৩৫টি আসন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদের ভট্টাচার্য বলেছিলেন, ‘আমরা হচ্ছি ২৩৩, আর ওরা শুধু ৩০। ওদের কথা আর কী শুনব?’

কিন্তু ওদের কথাই শুনতে হয়েছে। মমতা এবার বুঝতে পারলেন, ১৯৭৭ সাল থেকে টানা ক্ষমতায় থাকা বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানবিরোধী একটি হাওয়া লাগছে। পশ্চিমবঙ্গের লোকজন একটা পরিবর্তন চাইছে। সেই চাওয়াটাকেই প্রাধান্য দিয়ে মমতা বাম বিরোধিতার প্রতীক হয়ে ওঠেন। বামদের বিরুদ্ধে তুমুল সংগ্রামে নামলেন।

শিল্পে একদম শেষের সারিতে পড়ে থাকা রাজ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম পশ্চিমবঙ্গে বামরা শিল্প কারখানা স্থাপন করতে চাইল। বামফ্রন্ট সরকার পূর্ব মেদিনীপুর জেলার নন্দীগ্রামে ১০ হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করে শিল্পপার্ক স্থাপন করতে চাইল। জমি দিতে অনিচ্ছুক কৃষকেরা তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলল। ‘বোকার হদ্দ’ বামফ্রন্ট সরকার না পারল ইন্দোনেশিয়ার সালিম গ্রুপকে জমি দিতে, না পারল কৃষকদেরকে ঠান্ডা করতে।

২০০৭ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ- এই টানা তিন মাস রাস্তা ব্লক করে আন্দোলন চলল। জনজীবন হয়ে উঠল দুর্বিসহ। আন্দোলনে সমর্থন দিল মাওবাদীরা। বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে যুগপৎ দুর্বার আন্দোলন শুরু করলো-মাওবাদী, কৃষক আর গ্রামের মানুষেরা। ১৪ জন গ্রামবাসী নিহত হলো একদিনেই। মমতা বুঝলেন-এই তো সুযোগ। আন্দোলনের ফল পকেটে পুরতে তিনি প্রত্যক্ষ মদদ দিলেন সবাইকে। নিরীহ কৃষক নিহত হওয়ায় কলকাতার প্রায় সমস্ত বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় বামফ্রন্টের নিন্দায় সরব হলেন। আস্তে আস্তে বামফ্রন্টের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল। কালকাতা চলচ্চিত্র উৎসব বয়কট করলেন অপর্ণা সেন আর ঋতুপর্ণা ঘোষের মতো চিত্রপরিচালকেরা। সব কেলেঙ্কারি ঘটিয়ে অবশেষে নন্দীগ্রাম থেকে পিছু হটল বাম সরকার। মমতার উত্থানপর্ব শুরু হলো সেখান থেকেই।

কিছুটা একই রকম ঘটনা ঘটলো হুগলি জেলার সিঙ্গুরে। টাটা কোম্পানি তাদের ন্যানো গাড়ির কারখানা করতে চাইল সেখানে। কবিতা আবৃত্তি, রাজনৈতিক প্যাঁচালী আর থিয়েটার-নাটকে মত্ত থাকা বাঙালি কোনো শিল্পকারখানা হোক-সেটা চাইল না। ৯৯৭ একর জমি বামফ্রন্ট সরকার অধিগ্রহণ করতে চাইল। আবার জমি দিতে অনিচ্ছুক কৃষক। আবার আন্দোলনের ঘনঘটা। মমতাকে সমর্থন জানালেন অরুন্ধতী রায় আর মেধা পাটেকার মতো ভারতের বিখ্যাত বুদ্ধিজীবীরা। কলকাতার বুদ্ধিজীবীরা তো আছেই।

পরিস্থিতি দেখে টাটা গ্রুপের কর্ণধার রতন টাটা কারখানা সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলেন। কারখানা চলে যায় বাণিজ্যবান্ধব রাজ্য নরেন্দ্র মোদির গুজরাটে। শিল্প কারখানা করতে গিয়ে ভেতো বাঙালির চক্ষুশূল হয়ে উঠল বামফ্রন্ট সরকার। আজকাল অবশ্য অনেকেই আক্ষেপ করেন, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে শিল্পায়নবিরোধী আন্দোলন করাটা সর্বনাশ হয়ে উঠেছে পশ্চিমবঙ্গের জন্য। দরিদ্র পশ্চিমবঙ্গ আরও দরিদ্র হয়ে ওঠেছে। ফাঁকতালে আন্দোলনের ফসল ঘরে তুলে মুখ্যমন্ত্রী হয়ে উঠেছেন মমতা।

প্রায় ৩০ শতাংশ মুসলিম জনসংখ্যা অধ্যুষিত পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান ভোটাররা বামদের ভোট দিয়ে আসছিল দশকের পর দশক। মালদহ-মুর্শিদাবাদ জেলায় অবশ্য মুসলমানেরা ভোট দিতো কংগ্রেসকে। বিজেপির সঙ্গে মেশার কারণে মুসলিম ভোট তেমন পাচ্ছিলেন না মমতা। এবার ইফতার পার্টিতে অংশগ্রহণ আর মাথায় পট্টি বেঁধে মোনাজাতে শামিল হতে লাগলেন মমতা। বিজেপির বিরুদ্ধে তোপ দাগাতে শুরু করলেন। মুসলমানদের প্রিয়পাত্র হতে শুরু করলেন।

২০১১ বিধানসভা নির্বাচন: বামফ্রন্টের লাল দুর্গ ধ্বংস করে মমতার উত্থান

২০০৯ সালের ভারতের লোকসভা নির্বাচনের আগে এবার নতুন ভেল্কি দেখালেন মমতা। কংগ্রেসের সঙ্গে করলেন জোট। এই জোট তার জন্য আশীর্বাদ হয়ে ওঠে। ৪২ আসনের লোকসভা নির্বাচনে ১৯টি আসন পেয়ে পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে উঠেন মমতা। বামদের আসন ২০০৪ সালে প্রাপ্ত ৩৫টি থেকে কমে এক ধাক্কায় ১৫-তে নেমে আসে। রাজ্যজুড়ে মমতা ঝড় বইতে শুরু করে। এই ধাক্কা আর সামলাতে পারেনি বামরা। স্মরণ করা যেতে পারে যে-মাত্র একটি আসন পেয়েছিল বিজেপি সেই সময়।

সবাই ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলের দিকে তাকিয়েছিল। সবাই ধরে নিয়েছিল, ৩৪ বছরের বাম জমানার অবসান হতে চলেছে এবার। হলোও তাই। ২৯৪ আসনের বিধানসভার নির্বাচনে মমতার দল ও তার জোটসঙ্গীরা ২২৭ আসনে বিজয়ী হয়। বামফ্রন্ট পায় মাত্র ৬২টি। ২০২১ সালে মমতাকে উৎখাত করার স্বপ্ন দেখা বিজেপি একটা আসনও পায়নি সেবার। ১০ বছরের ব্যবধানে আজ বিজেপির রণহুংকারে সরে যাচ্ছে মমতার পায়ের মাটি।

মমতার পতনের ইঙ্গিত উত্থানের মতোই

বামবিরোধী রাজনীতির প্রিয়মুখ পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেস কমিটিতে ছিলেন মমতা। রাজনীতির হাতেখড়ি তার ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের একজন কর্মী হিসেবে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামের ইতিহাস বিষয়ে এম এ পাস করেন। পশ্চিমবঙ্গ মহিলা কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ১৯৭৬ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত। ১৯৮৪ সালের ভারতের সাধারণ নির্বাচনে বামফ্রন্টের বর্ষীয়ান নেতা সোমনাথ চ্যাটার্জীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তিনি প্রথমবারের মতো লোকসভার সদস্য মনোনীত হন। সোমনাথ বাবুর মতো ব্যক্তিকে হারিয়ে তিনি হৈ চৈ ফেলে দেন। পরে ভারতীয় যুব কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক পদে দায়িত্ব পান। ১৯৮৯ সালের নির্বাচনে দেশে কংগ্রেসবিরোধী হাওয়া বইলে তিনি অবশ্য হেরে যান। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে তিনি আবার জিতে আসেন সাউথ কলকাতা থেকে। তারপর থেকে সে আসনেই নির্বাচন করে নিয়মিতই নির্বাচিত হয়ে আসছেন তিনি।

১৯৯৭ সালে মমতা বন্দোপাধ্যায় কংগ্রেস ত্যাগ করে নিজের দল তৃণমূল কংগ্রেস গঠন করেন। তারপর থেকেই কংগ্রেসের বারোটা বাজিয়ে দেন। দিন যতই গড়িয়েছে, কংগ্রেস থেকে নেতা, কর্মী, বিধায়ক, এমপি দিয়ে তিনি দলভারী করেন। আজ তৃণমূল কংগ্রেস ছেড়ে যখন দলে দলে লোকজন বিজেপিতে যোগ দিচ্ছে, তখন বলতেই হচ্ছে মমতার প্রতি এটা তার ভাগ্যবিধাতার বিচার। নিজে কংগ্রেসকে ধ্বংস করেছেন তার দলে লোক টেনে, তাই তার দল আজ খালি হচ্ছে বিজেপির আগ্রাসনে।

লেখক: পরিচালক, ইংলিশ অ্যাডভেঞ্চার

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :