বুক রিভিউ: শেখ হাসিনা, নির্বাচিত উক্তি

প্রকাশ | ২৬ জুন ২০১৯, ১৬:৫৬

ঢাকাটাইমস ডেস্ক

একটি বর্ণিল পৃথিবীর জন্য বলীয়ান চিন্তার অংশগ্রহণ কতভাবে মানুষকে সুন্দর হতে শেখায় নানা জবুথবু অন্ধকারকে চিন্তায় নির্ণয় করে, ভাসমান সুন্দরের পাশ কাটিয়ে অর্থবোধক নিবিড় সত্যের সন্ধানে যেখানে জীবন শুধুই সুন্দর, মন ভরে। নিবিড় জীবনবোধ মানুষকে কল্যাণকর সুন্দরে উৎসাহিত করে। শেখ হাসিনার জীবন আদর্শের দিকে লক্ষ্য করলে সে প্রসঙ্গই উঠে আসে। ব্যাথা ভরা উপলব্ধির জীবন দর্শন যেমন সত্যের সন্ধানে শান্তির সন্ধানে নিজেকে খুঁজতে শেখে।

বইটি পড়ে উঠার পর, বিশেষত রাজনীতি বিষয়গুলো পড়ে উঠার পর রাষ্ট্র বিজ্ঞানের কৌটিল্যের অর্থ শাস্ত্রের কথা মনে এসে গেল। কিন্তু তা ছিল বিস্তারিক প্রাচীন এবং রক্ষণশীল রাজ্য পরিচালনার সমান্তরাল। কিন্তু এখানে এ বিষয়খানি অনেক সংক্ষিপ্ত তবুও অধিক উদার মানসিকতায় আর মানবিকতায় তা হয়ে উঠেছে বিশ্ব চরিত্রে শান্তির শ্বাস-প্রশ্বাসের নতুন রাষ্ট্র-চিন্তা কিংবা বিশ্ব-চিন্তা, যা নতুন মনে করা যায় শেষ পর্যন্ত। তিনি বাসযোগ্য পৃথিবীর সুন্দর আনয়নে চিন্তার জন্য কতগুলো সুন্দর ভাবনা ছেঁড়ে দিয়েছেন, মানুষ যা ভাবতে পারবে তাদের শেষ পর্যন্ত তাদের নিজেদের কল্যাণের জন্য।

রাজনীতির সঞ্চিত অভিজ্ঞতার আলোকে এই নতুন ভাবনা পড়ার সময় মনু সংহিতার রাজধর্ম অংশটুকু আবার নেড়ে-চেড়ে দেখলাম, আধুনিক রাষ্ট্র চিন্তার সাথে প্রাচীন রাষ্ট্র চিন্তার তুলনায়, আমরা সেখান থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিশ্লেষণ অনুসারে অধিক বেশি মানুষের পক্ষের হয়ে গেছি। মনে হলো আমরা নতুন হয়ে গেছি ভাবনার গভীরতায়, বক্তব্যের উন্মুক্ত সহযোগিতায়। জীবনে চিন্তার সঞ্চয় মানুষকে নতুন হয়ে উঠতে সাহস দেয়, সাহস দেয় মানুষের মুক্তির পথে, মর্যাদার পথে। যা বঙ্গবন্ধুই নিজের অজান্তেই তাঁকে শিখিয়েছিলেন কীভাবে একটি জাতিকে মর্যাদান্বিত চিন্তায় ভাবতে শেখানো যায়,নিজেদের উৎসর্গ করে দেওয়া যায় মানুষের কল্যাণে।  

নীতি কিংবা সুনীতির অংশটুকু ভর্তৃহরির নীতিশাস্ত্রের বার্ধক্য রেখা ছাড়িয়ে আধুনিক আত্মচিন্তায় বলিষ্ঠ এক নতুন জীবনের প্রশংসা দিয়ে গেছে মানবতার সন্ধানে।

তিনি ন্যায়নীতি নিয়ে উপলব্ধি করেছেন যেন নিজের ভেতর থেকে যা হয়ে উঠেনি কোন আইনি পরিভাষার মারপ্যাঁচ হয়ে উঠেছে যেন গণ মানুষের উপলব্ধি। যেমন তিনি এ প্রসঙ্গে বললেন ‘ন্যায়নীতিবোধকে ঠেলে দিয়ে মানুষ ছুটছে। ছুটছে ঊর্ধ্বশ্বাসে, ছুটছে কৃত্রিমতার দিকে। মৌলিকতা ছেড়ে দিয়ে কৃত্রিমতাকেই বেছে নিচ্ছে, কিন্তু এর পরিণতি যে ভয়াবহ-এ ভয়াবহ পরিণতি সমাজে সৃষ্টি করেছে গভীর ক্ষত। এ ক্ষতের এখনই চিকিৎসা প্রয়োজন। অতি জরুরিভাবে প্রয়োজন।’

নীতি চিন্তার অনুসরণে তিনি সূফী দর্শনের নরম স্পর্শের মধ্যে নিজেকে ভাবতে শিখিয়েছেন এভাবে যেমন তিনি তাঁর নিজের অনুভবে বললেন ‘আত্মার পরিশুদ্ধির মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনই হলো সুফি দর্শনের মর্মকথা।পরমসত্তা মহান আল্লাহকে জানার আকাঙ্ক্ষা মানুষের চিরন্তন।’

মানবাধিকার বিষয়ে যেন নিজের বিশ্বাসকে তিনি বলে দিলেন একেবারে সরল করে ‘আমি বিশ্বাস করি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য নিরাপত্তা এবং যা কিছু নাগরিকদের যথোচিত ও মর্যাদাকর জীবনের অংশ তার সবই মানবাধিকারের অন্তর্গত।’

জ্ঞানের কোন নির্দিষ্ট অধ্যায় নাই, বহু বন্ধনে তা উন্মুক্ত, তবুও একটি শান্তির স্নেহে বাস করার জন্য যতখানি দরকষাকষির পরিবর্তে যতখানি সভ্যতার চর্চা করার দরকার তা এখানে আছে। বিষয়গুলো উল্লেখ করলে এক নজরে বুঝে নিতে সুবিধা হবে সুন্দর সহজেই ফুটে আছে সহজ হয়ে যেন গ্রন্থের সূচীর মধ্যেই। বিষয়গুলো ক্রমানুসারে যদি উল্লেখ করা যায়, দেখা যায় পর্যায়ক্রমে তিনি অটিজম, অভিবাসী চিন্তা, সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য, গ্রাম, সুশাসন, শিক্ষা, সেনাবাহিনী, স্বনির্ভরতা, স্বনির্ভরতার স্বপ্ন, স্বল্পোন্নত দেশসমূহের উন্নয়ন, স্বাধীনতা, শান্তি ও সমৃদ্ধি, স্বাস্থ্যনীতি ইত্যাদি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে মোট ১০০টি প্রসঙ্গে প্রাসঙ্গিক শান্তির পক্ষে প্রবল ছায়ার মতো হয়ে গেছেন তিনি তাঁর উক্তির মুক্তিতে। 

অনেক -অনেক, যেমন অনেক ভালো কিছুই এখানে নতুন ভাবে উপস্থাপিত হয়েছে, প্রবলভাবে ছুঁয়ে গেছে। যেমন অনেকে তাঁদের নানা বিশ্লেষণ থেকে বঙ্গবন্ধুকে নানা অনুভবে অনুভব করার চেষ্টা করেছেন, তিনিও করেছেন। তবে এই অনুভবটুকু চিন্তায় সাধারণ যে কোন শিল্পিকেও ভাবাবে, যেমনটা তিনি বঙ্গবন্ধু সম্বন্ধে বললেন-‘জাতির পিতাও শিল্পী ছিলেন। তবে তাঁর ক্ষেত্র রঙ-তুলির জগতে ছিল না, তিনি ছিলেন রাজনীতির নান্দনিক শিল্পী।’

বইয়ের শেষে গিয়ে শিল্প নিয়ে আর একটি উক্তি পড়লাম সেখানে মনে হলো, মনের নতুন অনুপ্রেরণা অনুভবে তিনি যেন নিজেই শিল্পী হয়ে বললেন-‘শিল্প হচ্ছে জীবনেরই বহিঃপ্রকাশ। আর এর উদ্দেশ্য হলো মানবসমাজকে ঋদ্ধ ও সুন্দর করে তোলা। সমাজে সুন্দরের প্রতিষ্ঠার আগে অবশ্যই সেখান থেকে সব ধরনের কদর্যতা অপসারণ আবশ্যক।’

কদর্যতা অপসারণ প্রসঙ্গে এর আগে সাহিত্যে নানা যুক্তি দিয়ে অনেকে সাহিত্যকে সমাজের দর্পণের সাথে তুলনা করলেও সাহিত্য নিয়ে তিনি শুধু এভাবেই বললেন, ‘সাহিত্য শুধু মানুষের সুকুমারবৃত্তিগুলকেই জাগ্রত করে না, সাহিত্য মানব ইতিহাসের মহাসড়ক।’

নিজের অনুভূতির আদলে তিনি বললেন সত্যের পথ নিয়েও। ‘সত্যের কাছে মাথা একসময় নুয়ে আসে। সত্যের মুখোমুখি হওয়া বড় কঠিন। মানুষ সহজ পথ খোঁজে। এটাই মানুষের স্বভাব। সত্যের মুখোমুখি হতে চায় না। সত্যকে এড়িয়ে যেতে চাই। কিন্তু তা কি পারা যায়? ’

অবিচার বিষয়ে পড়তে গিয়ে তাঁর অবিচারের সাধারণ সংজ্ঞাটি মনে গেঁথে গেল যেন, যেমন তিনি বললেন, ‘প্রচলিত সর্বজনীন মূল্যবোধ, আইন ও অধিকার-বিরুদ্ধ কর্মকাণ্ড যখন সংঘটিত হয় তখনই অবিচার হয়।’

পড়তে গিয়ে সহজ একটি লাইন চোখে আটকে গেল, ‘সমাজের কাজ সমাজেরই করা দরকার।’

আরেক জায়গায় দেখলাম বলেছেন, ‘বিদ্যাদান থেকে জলদান, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা থেকে সড়ক নির্মাণ, আইনশৃঙ্খলা থেকে সংস্কৃতিচর্চা সবকিছুর জন্যই আমরা হাত বাড়িয়ে অনুদান চাচ্ছি রাষ্ট্রের কাছে। যেন রাষ্ট্রের দ্বারস্থ হওয়া ভিন্ন আমাদের করণীয় কিছু নেই বা তা বাস্তবায়নের ক্ষমতা নেই। এ চরম রাষ্ট্র-নির্ভরতা ভেতরে ভেতরে সমাজের নিজস্ব উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষমতাকে অবশ করে দিচ্ছে। যে কাজ সমাজের করার কথা তা রাষ্ট্র নিজের কাঁধে তুলে নিচ্ছে।’

রাষ্ট্রের কাঁধে নিয়ে চলা নানা অংশগ্রহণের মধ্যে বর্তমান সময়ে আলোচিত সবচেয়ে বহুমুখী অংশগ্রহণের মধ্যে একটি হচ্ছে টেকসই উন্নয়ন। নানা সময়ে আমরা টেকসই উন্নয়ন নিয়ে নানা সংজ্ঞা শুনেছি, তবে টেকসই উন্নয়নের তাঁর এই সংজ্ঞাটি আমার কাছে অনেক বেশি জুতসই আর মনঃপুত হয়েছে, অনেক নতুন শুনিয়েছে যেমনটি তিনি এ প্রসঙ্গে শোনালেন,‘আমি মনে করি টেকসই উন্নয়নের অর্থ হচ্ছে নারীর ক্ষমতায়ন এবং জীবনের সকল ক্ষেত্রে পুরুষের সঙ্গে নারীর সমান অংশগ্রহণ।’

আরেক জায়গায় তিনি নারীমুক্তির বিষয়ে যেন একটু উপলব্ধির মতোই উল্লেখ করলেন ‘নারীমুক্তির প্রধান বাধা যদি হয় পুরুষ, তবে নারীমুক্তির পথপ্রদর্শকও পুরুষ।’

এরপর নারীর ক্ষমতায়নেও তিনি উপলব্ধির নির্যাস থেকে এভাবেই বলে দিলেন, ‘আমি মনে করি নারীর ক্ষমতায়নের জন্য নারীদের অধিক হারে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ জরুরি।’

এভাবে বলতে বলতে রাজনীতির পরিবর্তন নিয়েও জোর দিয়েছেন তিনি। যেমন তিনি বললেন, ‘আমি মনে করি আমাদের রাজনীতির একটা পরিবর্তন প্রয়োজন। প্রতিযোগিতা হবে জনকল্যাণমূলক কর্মসূচির। আন্দোলন হবে সমাজ সংস্কারের জন্য, অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য। আর এ উন্নয়ন মুষ্টিমেয় মানুষের জন্য নয়। এ উন্নয়ন অবশ্যই হতে হবে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জন্য।’

ধর্মনিরপেক্ষতার নিরিখে তিনি নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করেছেন, আবার নিজেই সহজ করে দিয়ে বললেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ কী? এর অর্থ হলো সহনশীলতা-ধর্মহীনতা নয়।’

শিক্ষাকে প্রসঙ্গ করে বলতে গিয়েও তিনি ধর্মনিরপেক্ষতাকেই স্পর্শ করে বললেন- ‘আমাদের রাষ্ট্র ও সংবিধানের অন্যতম মূলস্তম্ভ 'ধর্মনিরপেক্ষতা' সংহতকরণের জন্য শিক্ষার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।’

তারপর তিনি নিজের মতো আপন করে বাঙালির স্বভাব বলে দিলেন যেন সহজে, ‘মানুষে-মানুষে ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্য, অতিথিপরায়ণতা হচ্ছে বাঙালির আদর্শ।’

অনেক আগে মাইকেল জ্যাকসনের ‘হিল দ্যা ওয়ার্ল্ড' নামে একটা গান শুনেছিলাম, সেখানে আমি বাসযোগ্য পৃথিবীর একটি অনুভূতি অনুভব করেছিলাম, ছোটবেলায় সুকান্তের কবিতা থেকেও জেনেছিলাম। তবে এবার একটু বড় বয়সে শুনলাম কিন্তু সহজ করে, বিশ্বচিন্তার বড় অঙ্গন করে একটি আধুনিক বসবাসযোগ্য শান্তিপূর্ণ পৃথিবীর স্বপ্ন দেখিয়ে যেন তিনি বললেন- ‘আমাদের সন্তানদের জন্য এবং তাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি বৈষম্যহীন বিশ্ব নির্মানে কাজ করে যেতে হবে যার জন্য তারা আমাদের স্মরণ করবে শ্রদ্ধা আর কৃতজ্ঞতার সাথে। এর জন্য আত্মকেন্দ্রিক ও অদূরদর্শী স্বার্থচিন্তা থেকে বের হয়ে একযোগে কাজ করা ছাড়া আমাদের সামনে কোনো বিকল্প নেই।’

গ্রন্থটির ভূমিকার শেষ অংশে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ রেহেনা যেভাবে লিখেছেন- ‘এই পুস্তিকাটি আমার বোন শেখ হাসিনার উক্তিসমূহের একটি সংকলন, যা বছর পরিক্রমায় বাংলাদেশ ও বহির্বিশ্বে তাঁর প্রদত্ত ভাষণ, বিবৃতি, এবং প্রবন্ধ-নিবন্ধ থেকে চয়ন করা হয়েছে। আমি আশা করি, এটি তাঁর মধ্যে বিদ্যমান প্রজ্ঞা, সাহস ও উদ্যম -মুগ্ধতার সাথে আমি যার প্রশংসা করি -তার কিছুটা প্রতিফলন ঘটাবে।’

বইটি প্রকাশ করেছেন পাঠক সমাবেশ,মূল্য ধরা হয়েছে ৬৯৫ টাকা, US $: 50, UK £ 30, বইটির একটি ইংরেজি ভার্সনও বেরিয়েছে SHEIKH HASINA, SELECTED SAYINGS নামে। গ্রন্থটি খুবই ছোট, কিন্তু অভিজ্ঞতা রয়েছে সারা বিশ্ব জ্ঞানের। এটি একটি সম্পাদিত গ্রন্থ, গ্রন্থটি সম্পাদনা করেছেন মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া।

রিভিউ লিখেছেন: আব্দুল্লাহ আল হাদী

কবি ও সাহিত্যিক।