ওরা দাঁড়িয়ে দেখছিল, ছবি তুলছিল
দিনের আলোয় স্ত্রীর সামনে প্রকাশ্যে দা দিয়ে কোপানো হচ্ছে স্বামীকে। প্রায়প্রিয় স্বামীকে বাঁচাতে এক সন্ত্রাসীর কাছ থেকে অন্য সন্ত্রাসীর কাছে স্ত্রীর ছোটাছুটি আর আত্মচিৎকার। আশপাশে বেশ কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে ঘটনা প্রত্যক্ষ করছেন। প্রকাশ্যে একজন মানুষকে এভাবে কোপানো হলেও কেউ তাঁকে বাঁচাতে এগিয়ে আসছে না। মনে হচ্ছিল যেন তারা সিনেমার শুটিং দেখছেন।
বাঁচানো তো দূরের কথা, প্রতিবাদ করারও যেন সাহস ছিল না কারো। তাদের মধ্যে অনেকে ব্যস্ত ছবি তোলায়। একজন মানুষকেও পাওয়া যায়নি যিনি ঘটনার প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ করতে ঠেকাতে গেছেন। মানুষরূপী হায়েনাদের এমন নির্মমতায় পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয় যুবক রিফাত শরীফকে। বর্বরোচিত এমন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সমালোচনার ঝড় বইছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
গতকাল বুধবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে স্ত্রীর সামনে কোপানো হয় শাহ নেয়াজ রিফাত শরীফকে। সন্ত্রাসী নয়নের নেতৃত্বে ৪-৫ জন যখন কোপাচ্ছিল, তখন স্বামীকে বাঁচাতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা। অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে দেখলেও রিফাতকে বাঁচাতে কেউ এগিয়ে আসেননি। পরে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
রিফাতকে কুপিয়ে হত্যার একটি ভিডিও দ্রুত ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে তা ভাইরাল হয়। ভিডিওটিতে দেখা যায়, সন্ত্রাসী দুই যুবক ধারালো দা দিয়ে একের এর এক কোপাতে থাকে রিফাতকে। এ সময় তাঁর স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি হামলাকারী দুই যুবককে বারবার প্রতিহত করার চেষ্টা করছেন।
তিনি একজনকে আটকানোর চেষ্টা করলে দ্বিতীয়জন হামলা চালায়, দ্বিতীয়জনকে থামানোর চেষ্টা করলেও অন্যজন রিফাতকে কোপাতে থাকে। আয়েশার চিৎকারে এলাকা প্রকম্পিত হলেও আশপাশের লোকজনের মধ্যে কেউ এগিয়ে যায়নি।
বরগুনা সদর উপজেলায় শত মানুষের উপস্থিতিতে এভাবে এক যুবককে কুপিয়ে হত্যার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পরেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হইছে সমালোচনার ঝড় বইছে। সড়কে প্রকাশ্য এতো মানুষের উপস্থিতিতে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না তারা। ক্ষোভ আর নিন্দা প্রকাশ করে হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে শাস্তির আওতায় আনার দাবি যেমন তারা জানাচ্ছেন, তেমনি ঘৃণা জানিয়েছেন দাঁড়িয়ে থাকা হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শীদের।
অধিকারকর্মী ও ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান লিখেছেন, চোখের সামনে কোনদিন কোনো অন্যায় দেখে পালিয়ে আসিনি। হয়রানির শিকার হয়েছি। নানা ভোগান্তিতে পড়েছি। তবু প্রতিবাদ করেছি। প্রতিরোধ করেছি। অথচ বরগুনায় আজ শত শত লোকের উপস্থিতিতে স্ত্রীর সামনে শাহ নেয়াজ রিফাত শরীফ নামে এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। কেউ একজন ভিডিও করেছেন। সেই ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। নানা বিপ্লবী মন্তব্য পাওয়া যাচ্ছে তাতে। কিন্তু একজন মানুষকেও পাওয়া যায়নি যিনি ঘটনার প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ করে ঠেকাতে গেছেন। চোখের সামনে অন্যায় দেখেও নিরব থাকার এমন প্রবণতা একটা জাতি ধ্বংস হওয়ার জন্য যথেষ্ট। আমি জানি না যারা আজ ঘটনাস্থলে ছিলেন, তারা কীভাবে ঘুমাবেন! জানি না কোন আফিম খেয়ে আমরা ঘুমাচ্ছি। জানিনা কবে এই ঘুম ভাঙবে।
সামছ রহমান নামে একজন লিখেছেন, ‘বিশ্বজিতের রায়ের পর আরেক নরকীয় হত্যাযজ্ঞের নমুনা দেখল বিশ্ববাসী। কোনো সুস্থ মানুষ এই ভিডিও দেখে ঠিক থাকার কথা নয়। অথচ শত শত মানুষের উপস্থিতিতে দিবালোকে নবাগত স্ত্রীর সামনে একজন তরতাজা যুবককে উপর্যপুরি কুপিয়ে রক্তাক্ত করে দেওয়া হলো। হাসপাতালে নেওয়ার ঘণ্টাখানেক পর যুবকটির মৃত্যু হয়েছে। নরঘাতকের সঙ্গে খালি দু'হাত দিয়ে যুদ্ধ করে পরাস্থ স্ত্রী সর্বশক্তি দিয়েও তার স্বামীকে বাঁচাতে পারল না। তবে কী মানুষ প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলেছে? নাকি সন্ত্রাসীদের দৌরাত্ম্যের কাছে সাধারণ মানুষ বড়ই অসহায় হয়ে পড়েছে। কে দেবে এ প্রশ্নের উত্তর।’
সাংবাদিক এনাম আহমেদ লিখেছেন, প্রকাশ্যে দু’জন সন্ত্রাসী স্ত্রীর সামনে স্বামীকে ধারালো দা দিয়ে কুপিয়ে বীরদর্পে চলে গেলো, আর রাস্তার ওপাশে অসংখ্য হিজড়া দাঁড়িয়ে দেখছিল। তোরা হিজড়া, অন্তত তালি ফুটানো শিখে নে, মাত্র দু’জন তোদের তালির শব্দ শুনেও ভড়কে গিয়ে পালিয়ে যেত!
সাংবাদিক মুক্তাদির রশিদ রোমিও লিখেছেন, ‘আহা উহু করার মানুষ আমাদের চারিপাশে ভরা। তারা রিফাতের ‘হত্যাকারীদের’ সামারি ট্রায়াল সমর্থন করছেন। গায়ের পাচড়া চুলকাচ্ছেন । তারা মূলত শাক দিয়ে মাছ ঢাকছেন। নিজে অনুভব করুন। জানুন, ন্যায়বিচার নিশ্চিত দাবি করুন। কেননা অন্যায়, অন্যায্যতা সংক্রমক। যদি সত্যি সাহসী হন তাহলে দাবি করুন ‘আইনের শাসন চাই’। কেননা সামাজিক ন্যায়বিচার ছাড়া রাষ্ট্র কেবলই তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত হয়।’
ইব্রাহিম নামে একজন লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের বিচার বিভাগ, আইন বিভাগ সারা দেশের মানুষের কাছে এখন প্রশ্নবিদ্ধ। যদি বিচার বিভাগ কিছুটা হলেও স্বাধীন থেকে থাকে, তাহলে নিশ্চয় এর বিচার হবে। আর যদি সঠিক আইনের প্রয়োগ হয়ে থাকতো তাহলে এরকম নির্মম ঘটনা আর ঘটতো না।’
লেখক আসাদুল্লাহ লিখেছেন, ‘সবাই দাঁড়িয়ে ভিডিও করাদের বিচার চাইছে। যারা কোপালো তাদের বিচার না করলেও হবে যেন।’
ঢাকাটাইমস/২৭জুন/এমআর