এক বিএনপি হরেক খবর

প্রকাশ | ২৭ জুন ২০১৯, ১২:৫৭ | আপডেট: ২৭ জুন ২০১৯, ১৩:১৫

আরিফুর রহমান দোলন

খন্দকার মাহবুব হোসেন কেন বিএনপির স্থায়ী কমিটিতে নেই? গুলশানের গ্লোরিয়া জিনস কফিশপে কফির মগে চুমুক দিতে দিতে এক যুবক জিজ্ঞেস করে সামনে বসা আরেক যুবককে। পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম, একা। কাছাকাছি বসলাম। তাদের কথোপকথনে খানিকটা উত্তেজনা। ‘কিচ্ছু হবে না, এই বিএনপি দিয়ে’। সুপ্রিম কোর্ট বারের তিনবারের নির্বাচিত সভাপতি, সিনিয়র আইনজীবী, সবার কাছে উপস্থাপনযোগ্যকে বাদ দিয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অযোগ্যকে যেই দল নীতিনির্ধারণী কমিটিতে নেয়, সেই দলকে কে গ্রহণ করবে? খন্দকার মাহবুব হোসেনের পক্ষে যে ওই যুবকদ্বয়ের অবস্থান তাই শুধু নয়, বিএনপির অভ্যন্তরে ঘটে যাওয়া একের পর এক ঘটনা-দুর্ঘটনায় তাদের চোখে-মুখে হতাশার ছাপ।

কান পাতলেই পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে দুই যুবকের আলাপচারিতা। তারা বলছেন, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন জিয়াউর রহমানের সময় থেকে দলে আছেন। এই মুহূর্তে সবচেয়ে সিনিয়র নেতা। অথচ তাঁর মর্যাদা নেই।

ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদকেও কাজ করতে দেওয়া হয় না। মির্জা আব্বাসও কোনোমতে টিকে আছেন। স্থায়ী কমিটির অধিকাংশ নেতাই ঠুঁটো জগন্নাথ। ফরমান আসে লন্ডন থেকে। আর তা কার্যকর করেন মির্জা ফখরুল। এভাবে কি চলে!

আলোচনায় বিরতি নেই। তারা বলছেন, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু তো ভোটে লড়ারই অযোগ্য। দুর্নীতির মামলায় জেল হয়েছে। জাতীয় রাজনীতিতে কোনোদিনই সক্রিয় নন। তিনি স্থায়ী কমিটিতে ঢুকলেন কোন বিবেচনায়?

দলে ‘যখন খুশি’, ‘যা খুশি’ দিয়ে কি আর দল চলে? একজন আরেকজনের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছেন আর ক্রমাগত হতাশা ব্যক্ত করছেন। পরিচিত মুখ নন তারা। তবে বোঝা গেল, সাম্প্রতিক বিএনপির হাঁড়ির অনেক খবরই তাদের জানা। তাদের কথাবার্তাতেই জানা গেল ড. মোশাররফ, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের অনীহা আছে স্কাইপিতে যেভাবে তারেক রহমান দলের স্থায়ী কমিটির সভায় সভাপতিত্ব করেন। আরও দু-একজন নেতাও নাকি দল চালনার এই ধরন নিয়ে নানাভাবে তাদের নেতিবাচক মনোভাব তুলে ধরেছেন। এভাবে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্ব প্রকাশ্যে চাপের মুখে পড়ছিল।

পরোক্ষে তারেক রহমানেরও। মওদুদ-মোশাররফ যদি আরও দু-একজন সিনিয়রকে সঙ্গে নিয়ে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে অনুপস্থিত থাকা শুরু করেন তাহলে কোরাম সংকটের শঙ্কা ছিল। স্থায়ী কমিটিতে সংখ্যার বিচারে সদস্যসংখ্যা এখন তারেক-ফখরুলেরই কবজায়। বোঝা গেল বিএনপিতে নতুন সমীকরণ হয়েছে, যেখানে মহাসচিব পূর্ণ আস্থা অর্জন করেছেন তারেক রহমানের। পাশাপাশি খালেদা জিয়ার আস্থাভাজনও তিনি। বিষয়টি খানিকটা বৈসাদৃশ্যও লাগে, সাম্প্রতিক বেশ কিছু ঘটনায়। তাই নানাভাবে খোঁজখবর করতে থাকি। তাতে নিশ্চিত হই, মির্জা ফখরুল বিএনপির ভেতরে এখন বেশ প্রভাবশালী হয়ে উঠেছেন।

সম্প্রতি ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ও সেলিমা রহমানকে নাকি তার পরামর্শেই বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য করা হয়েছে। উভয়েই তার ঘনিষ্ঠ। স্থায়ী কমিটির বাকি তিন শূন্য পদে যারা আসবেন একইভাবে তারাও ফখরুল-ঘনিষ্ঠ হবেন এবং যাদের মূল আনুগত্য থাকবে তারেক রহমানের প্রতি।

তারেক-ফখরুল একাট্টা না হলে বগুড়া সদর আসনে জিতেও ফখরুল সংসদে গেলেন না কেন? এ প্রশ্ন তো স্বভাবতই আসে। খোঁজখবর নিয়ে জানা গেল, এটা হলে বেগম জিয়ার আস্থা হারাতেন ফখরুল। কারণ, বেগম জিয়া চাননি বিএনপি সংসদে যাক। ফখরুল খুব সহজেই কারাবন্দি খালেদা জিয়াকে বুঝিয়ে দিলেন, তিনি যা চান তার প্রতি শতভাগ আস্থা আছে বলেই তিনি এমপি হিসেবে শপথ নিলেন না। অথচ সেই ফখরুলই আবার বিএনপির অন্য এমপিদের সংসদে যোগ দেওয়া, এ নিয়ে তারেক রহমানের সব সিদ্ধান্তে সবার আগে এক পা বাড়িয়ে সমর্থন দেন ভেতরে ভেতরে। বিএনপির নাটাই তারেক রহমানের হাতে। ফখরুল চান মহাসচিব পদ যেন হাতছাড়া না হয়। তাই তারেক রহমানকে খুশি করার ব্যাপারে তিনি আপাতত এককাঠি সরেস- বিএনপির অভ্যন্তরে এই আলোচনাই বেশি।

তাই যদি না হবে তাহলে বগুড়া উপনির্বাচনে জি এম সিরাজকে তারেক রহমান যখন মনোনয়ন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন তখন সবার আগে ফখরুল কেন এটা সঠিক বলে মেনে নিলেন? সেনাসমর্থিত এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে জি এম সিরাজ যে শুধু দলের সংস্কারপন্থী ছিলেন তা নয়, ছিলেন খালেদা জিয়াবিরোধীও। ওই সময় সংস্কারপন্থীদের মূল নেতা মান্নান ভুইয়ার বাসায় প্রকাশ্যে সভায় তিনি বিএনপিতে ইমাম (নেতা) পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে বলে বক্তৃতাও দেন। এমন একজন নেতাকে দীর্ঘদিন দলের বেইরে রেখে আচমকা অন্য আসন থেকে সাংসদ হিসেবে জিতিয়ে আনার পেছনে নাকি নানা ধরনের সুবিধাদি আদান-প্রদানের বিষয় কাজ করেছে।

সর্বশেষ নির্বাচনের সময় থেকেই জি এম সিরাজরা নাকি বিএনপির অভ্যন্তরে অন্যতম চালিকাশক্তি। যেখানে চট্টগ্রাম বিভাগের কয়েকজন ব্যবসায়ী নেতা আছেন অন্যতম পরিচালনায়। এরাই নাকি কোন আসনে দলীয় প্রার্থীর কী কী সহযোগিতা লাগবে তা দেখভাল করেছেন। বিএনপিতেই প্রশ্ন উঠেছে, হঠাৎ দলটিতে ক্ষমতার প্রশ্নে এক-এগারোর সময়ে সংস্কারপন্থী বলে খ্যাতরা শক্তিশালী হয়ে উঠেছেন। এদের লন্ডন কানেকশন এখন খুবই শক্তিশালী। পাশাপাশি তাদের স্থানীয় কানেকশন হলেন মহাসচিব এবং কয়েকজন ব্যবসায়ী নেতা।

বেগম খালেদা জিয়ার নিয়ন্ত্রণ বিএনপিতে অনেকটাই কমে এসেছে। এমনটাই ক্রমশ দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। যে মোসাদ্দেক আলী ফালু ছিলেন তার ছায়াসঙ্গী, সেই ফালু বহুদিন ধরেই বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন না। এমনকি গুলশানে খালেদা জিয়া যে ভাড়া বাড়িতে উঠেছিলেন, তার ভাড়া বাকি ছয় মাসের বেশি। একসময় ফালুই প্রতি মাসে তিন লাখ টাকা করে এই ভাড়া মেটাতেন। এখন ভাড়ার চুক্তি নবায়ন করতেও অস্বীকার করছেন। কী দাঁড়ালো? এটা কি সহজ সমীকরণ? পাশেই নিজের বিরাট আলিশান বাড়ি থাকতে খালেদা জিয়া ভাড়া বাড়িতে কেন উঠেছিলেন? এ প্রশ্ন সব সময়ই ছিল। এমনকি দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও এই প্রশ্ন উঠেছিল। কিন্তু এর চেয়েও তো এখন বড় প্রশ্ন, বেগম জিয়া বাড়ি ভাড়া খেলাপি? বিএনপির এই দৈন্যদশা?

আন্দোলন-সংগ্রামের ডাক দিয়ে গত পাঁচ বছরের বেশি সময়ে বিএনপি যুবদল, ছাত্রদল নেতাদের মাঠে পেয়েছে? কর্মী তো দূরের কথা। যেই ছাত্রদল কমিটি স্থগিত, নতুন কমিটি গঠন নিয়ে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে কি তাণ্ডবটাই না করছে!

এর আগে সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় মনোনয়ন কেনাবেচার খবর নিয়ে গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের কার্যালয় ভাঙচুর হয়েছে একাধিকবার। বিএনপির সংগ্রাম মনে হচ্ছে নিজেদের সঙ্গে। নিজেদের মধ্যে এক, একাধিক উপদলের সৃষ্টি করে। দলের ভঙ্গুর এই শৃঙ্খলা নিয়ে কতদূর যাবে বিএনপি? এই প্রশ্ন তো আসবেই।

দুর্নীতি, শৃঙ্খলা, নৈতিকতার প্রশ্নে বিএনপি বরাবরই আপোষকামী, এই অভিযোগ বহু পুরনো এবং অনেক ক্ষেত্রে বিষয়টি প্রমাণিত। গঠনতন্ত্র সংশোধন করে বিএনপি দুর্নীতি ও ফৌজদারি অপরাধে দণ্ডিতদের দলের পদে থাকার সুযোগ নিশ্চিত করেছে এবং এখনো বেছে বেছে দণ্ডিত ও শৃঙ্খলাভঙ্গকারীদের দলীয় পদ পাইয়ে দিচ্ছে। বিষয়টি কিন্তু মোটেও স্বাভাবিক নয়।

বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতৃত্ব বিভিন্ন সময় প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে দাবি করেছে ১/১১’র সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাদের আজকের দুরবস্থার জন্য দায়ী। তাইই যদি হয় তাহলে ১/১১’র সরকারের কুশীলবদের আনুকূল্য পাওয়া বিএনপি নেতারা তারেক রহমানের আস্থাভাজন হন কীভাবে? এর নেপথ্যে কি? এসব নিয়ে নানা কানাঘুষা হচ্ছে।

জাতীয় সংসদে একটি প্রশংসনীয় অভিনন্দনযোগ্য বক্তব্য দিয়েছেন বিএনপি দলীয় সাংসদ হারুনুর রশিদ। বিস্ময়করভাবে তিনি ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের সমালোচনা করেছেন, নিন্দা জানিয়েছেন।

ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হত্যার বিচার বন্ধ করা অন্যায় হয়েছে বলে সংসদে অভিমত ব্যক্ত করেছেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হারুন। কিন্তু ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি ও পরে সেটি সংসদে পাস করা বিএনপি এর দায় এড়াতে পারবে কি?

প্রয়াত জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান থাকাকালে ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ‘খুনি’ মোশতাক আহমেদ ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেন। যেহেতু মোশতাক সরকার ছিল সেনা সমর্থিত, তাই জিয়াউর রহমান এর দায় এড়াতে পারেন না। ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল জাতীয় সংসদে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশসহ চার বছরে সামরিক আইনের আওতায় সব অধ্যাদেশ ঘোষণাকে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে আইনি বৈধতা দেওয়া হয়। জিয়াউর রহমান তখন রাষ্ট্রপতি। আর সংসদে দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাও জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপির। তাহলে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচারের পথ রুদ্ধ করে সংবিধান সংশোধনের মূল দায় তো সেই জিয়ারউর রহমান ও বিএনপিরই।

সংসদে সাংসদ হারুনের বক্তব্যের সূত্র ধরে বিএনপিও তার দায় স্বীকার করুক। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ সংসদে পাস করা, সংবিধান সংশোধন করা ছিল ‘ঐতিহাসিক ভুল’ এটা মেনে নিক। নাহলে সাংসদ হারুন ভুল করেছেন সেটা বলুক।

সংসদে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ নিয়ে সাংসদ হারুনের বোধোদয় যদি বিএনপির বিলম্বিত বোধোদয়ও হয়, তাহলেও দেশের রাজনীতিতে একটি সুস্থ সংস্কৃতির শুরুর একটি পদক্ষেপ হতে পারে। এই মুহূর্তে নিজেদের কর্মে লেজেগোবরে হওয়া বিএনপি সে পথে যাবে কি?

আসলে কোন পথে যাবে বিএনপি। এক বিএনপিতে হরেক রকম কারবার। হরেক খবর। নিজেদের মধ্যেই সন্দেহ আর অবিশ্বাস। এটা আদৌ আর দূর হবে!

লেখক: সম্পাদক, দৈনিক ঢাকা টাইমস, ঢাকা টাইমস২৪ ডটকম ও সাপ্তাহিক এই সময়।