প্লিজ, সরি বলুন সাংসদ রাজী

প্রকাশ | ২৮ জুন ২০১৯, ১৮:৫২ | আপডেট: ২৮ জুন ২০১৯, ২০:০৫

আরিফুর রহমান দোলন

সাংসদ রাজী মোহাম্মদ ফখরুল হয়ত দাবি করবেন তাঁর নামে ফেসবুকে ফেক আইডি খোলা হয়েছে। নতুবা বলবেন, তার আইডি হ্যাক হয়েছে। অথবা তিনি যেকোনো সময় দুঃখ প্রকাশ করে ফেসবুকেই নতুন পোস্ট দেবেন। আমি এখনো এই আশাতেই আছি।

কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারছি না একজন জাতীয় সংসদ সদস্য সামাজিক গণমাধ্যমে একজন নারীকে আঘাত না করায় কার্যত উষ্মা প্রকাশ করছেন! যে নারী কি-না নিজের চোখের সামনে উপর্যুপরি চাপাতির আঘাতে নিজের স্বামী খুন হওয়ার একমাত্র বাধাদানকারী। যে খুন হয়েছে প্রকাশ্যে দিবালোকে, শত মানুষের সামনে।

বরগুনায় বুধবার যেভাবে সবার সামনে যুবকেরা কুপিয়ে রিফাত শরীফকে খুন করেছে তা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানায়। কোথায় খুনিদের বিচার নিশ্চিতের জন্য গলা ফাটাবেন এক সাংসদ তা-না! সাংসদ রাজী মোহাম্মদ ফখরুল দাবি করে বসলেন, ‘খুনি’ নয়ন আর নিহত রিফাত এই দুই বন্ধুর মধ্যে নষ্টের মূল নাকি নিহতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি। ফেসবুক পোস্টে এই দাবি করে সাংসদ রাজী প্রশ্ন তুলেছেন, তা না হলে মেয়েটার ওপর আঘাত করলো না কেন?

আপনি কি সুস্থ রাজী মোহাম্মদ ফখরুল এমপি? মেয়েটার ওপর আঘাত হলে কি আপনি খুশি হতেন? আইন হাতে তুলে নেওয়ার উস্কানিদাতা এই আপনি আইনপ্রণেতা। কোথায় আছি আমরা? রাজী মোহাম্মদ ফখরুলেরা আমাদের কী শেখাচ্ছেন?

তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম নিহত রিফাত শরীফ আর তার তথাকথিত বন্ধুখ্যাত ‘খুনি’ নয়নের ব্যক্তিগত সম্পর্ক নষ্টের পেছনে আয়েশা সিদ্দিকার ভূমিকা আছে। ফেসবুকে সাংসদ রাজী এই ধরনের তথ্যই পোস্ট করেছেন।

তাতে কী হয়েছে? দুই বন্ধুর সম্পর্ক নষ্টের কারণ একজন নারী সেটি বড় ঘটনা, নাকি প্রকাশ্যে দিবালোকে শত জনতার সামনে কুপিয়ে হত্যার ঘটনা-দুর্ঘটনাই মূল ও একমাত্র অপরাধ?

নারকীয় কায়দায় কুপিয়ে হত্যার ঘটনার নিন্দা না করে একজন সাংসদ উল্টো প্রশ্ন তুলেছেন ঘটনার তথাকথিত নেপথ্যে যে নারী, তাকে কেন আঘাত করা হলো না? কতবড় দায়িত্বজ্ঞানহীন প্রশ্ন! শুধুই দায়িত্বহীনতার পরিচয় নাকি এটা এক ধরনের উস্কানিও?

একজন সাংসদ তো আইনপ্রণেতা। তাঁর কাছ থেকে আমরা কি এ ধরনের আচরণ আশা করব? সাংসদ সব বিচারেই প্রভাবশালী ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। আর তিনি যদি হন সরকারি দলের তাহলে তো কথাই নেই। সাংসদের কথায়, আচার-আচরণেও অনেক কিছু প্রভাবিত হয়। এমনকি একজন সাংসদের বক্তব্যে দলের ভাবমূর্তি ইতিবাচক হবে না কি নেতিবাচক হবে তাও নির্ধারিত হয়।

কুমিল্লার দেবীদ্বার থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ দলীয় সাংসদ ভেবেচিন্তে ফেসবুকে তাঁর মন্তব্য পোস্ট করেছেন নাকি উত্তেজনাবশত সাময়িক আবেগের বশে, সেটি ভাবছি। যদি সাময়িক আবেগের বশে তিনি বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যার বিষয়ে তাঁর অবিবেচনাপ্রসূত মন্তব্য করে থাকেন তাহলে সেটি প্রত্যাহার করতে তাঁকে বিনীতভাবে অনুরোধ করছি। আর যদি ভেবেচিন্তেই সাংসদ রাজী মোহাম্মদ ফখরুল বলে থাকেন, নিহত রিফাত ও ‘খুনি’ নয়ন এই কথিত বন্ধুর মধ্যে সম্পর্ক নষ্টের কারণ মেয়েটি (আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি), তাহলে বলব, তিনি অন্যায় করেছেন এবং এজন্য অবশ্যই তাঁর দুঃখ প্রকাশ করা উচিত।

আপনাকে বলছি সাংসদ রাজী মোহাম্মদ ফখরুল। ভেবে দেখুন তো আর দশজন স্বাভাবিক অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টের মতো আপনিও কি যখন খুশি, যেমন খুশি মন্তব্য ফেসবুক বা অন্য কোনো সামাজিক গণমাধ্যমে করতে পারেন? এটি আসলে কেউই পারে না। তবে সাংসদ বা এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকলে দায়িত্বটা আরও বেশি।

দশম জাতীয় সংসদে স্বতন্ত্র সাংসদ থাকা রাজী মোহাম্মদ ফখরুল কি ভুলে গেলেন, ওই সংসদে তারাই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস করেছেন। অথচ সেই আইনপ্রণেতাই ওই আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন হয় এমন মন্তব্যই ফেসবুকে পোস্ট করলেন! তা-ও আবার কোন বিষয়ে?

সারা দেশে যখন নিন্দার ঝড় উঠেছে, দেশের মানুষ যেখানে স্তম্ভিত। কীভাবে একজন মানুষকে প্রকাশ্যে দিবালোকে কতিপয় খুনি কোপাচ্ছে আর নীরব দর্শক হয়ে আছে অন্যরা।

খুশি হতাম যদি সাংসদ রাজী মোহাম্মদ ফখরুল রোমহর্ষক, হৃদয়বিদারক ওই ঘটনার নীরব দর্শকদের সমালোচনা করে ফেসবুকে পোস্ট দিতেন। যেমনটি দিয়েছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। ‘নীরব দর্শকদেরও’ গ্রেপ্তার দাবি করেছেন। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে সাধুবাদ জানাই।

কী অমানবিক ঘটনা! একজন মানুষকে এলোপাতাড়ি কোপানো হচ্ছে। চারিদিকে কত মানুষ। কেউ দেখছেন, কেউ ভিডিও করছেন। তাঁকে বাঁচানোর জন্য স্ত্রী আহাজারি করছেন, চিৎকার করে সাহায্য চাইছেন। কেউ এগিয়ে এলেন না। নিজেই প্রাণপণ চেষ্টা করলেন খুনিদের হাত থেকে স্বামীকে বাঁচাতে। পারলেন না।

আমরা কি এতটাই নষ্ট হয়ে গেলাম? সমাজ কি রসাতলে চলে গেল? সভ্যতা কি এভাবেই ধ্বংস হয়ে যাবে? কী করে এভাবে চেয়ে চেয়ে শত মানুষ একজনকে খুন হতে দিলেন? এ দায় কি সমাজের না? ওই যে মানুষগুলো নীরবে দেখলেন তারাও কি দায়ী নন? বিবেকের ডাকে সাড়া না দিয়ে তারা কি খুনির সহযোগী হননি? আমাদের মানবিক হওয়ার শিক্ষা চাই।

সাংসদ রাজী মোহাম্মদ ফখরুলের কাছে আবেদন, তিনি যেন তাঁর ভুলকে স্বীকার করে দায়িত্বশীল হন। তিনি যেন বোঝেন যে, একজন আইনপ্রণেতা এভাবে ইচ্ছা হলেই তার আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারেন না। তিনি যেন বোঝেন যে, স্পর্শকাতর ঘটনাগুলোয় নিজেকে আরও বেশি পরিণত আচরণ করতে হয়।

বরগুনার রিফাত শরীফ খুনের নেপথ্যে কারণ কী সেটা পুলিশই খুঁজে বের করুক। বর্বর এই খুনের সাথে জড়িত যারা, সবাই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পাক। আর যারা তাকিয়ে তাকিয়ে এই দৃশ্য দেখলো তাদের এবং আমাদের সবার বিবেকও জেগে উঠুক। আমরা মানবিক হয়ে উঠি। সভ্যতাকে বাঁচাতে আমরা যেন অসভ্য, বর্বর ঘটনার প্রতিবাদ করি। মানবতার পক্ষে শামিল হই। আপনিও এই দলে যোগ দিন সাংসদ রাজী মোহাম্মদ ফখরুল, আপনাকে এই অনুরোধ করছি।

লেখক: সম্পাদক, দৈনিক ঢাকা টাইমস, ঢাকা টাইমস ২৪ ডটকম এবং সাপ্তাহিক এই সময়