বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে মিথ্যাচার আর কতদিন?

প্রকাশ | ২৯ জুন ২০১৯, ১৪:২৬ | আপডেট: ২৯ জুন ২০১৯, ১৪:৪৫

মহিবুল ইজদানী খান ডাবলু
ঈদের জামাতে বঙ্গবন্ধুর পাশে দাঁড়িয়ে শেখ রাসেল ও জিল্লুর রহমান। পেছনে চশমা পড়া লেখকের বাবা আলী মেহদী খান।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে যারা হত্যার পরিকল্পনা করে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একজন হলেন মেজর ডালিম। তিনি ওই সময় সামরিক বাহিনীর আইনভঙ্গের কারণে মেজর পদ থেকে বহিষ্কৃত হন। তবে চাকরি হারালেও বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাসভবনে বহিষ্কৃত মেজর ডালিমের অবাধ যাতায়াত ছিল। প্রধানমন্ত্রীর বাসার দোতলার সিঁড়ি বেয়ে উপরে অন্দরমহলে যে কেউ যেতে পারে না। পারে শুধু পরিবারের সদস্য ও অত্যন্ত নিকটতম আত্বীয়স্বজন।

সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো বহিষ্কৃত মেজর ডালিম বঙ্গবন্ধুর কোনো নিকটাত্মীয় না হওয়া সত্ত্বেও বাড়ির ভেতরে প্রবেশের অনুমতি তার ছিল। অনেকে বলেন বঙ্গবন্ধু নাকি মেজর ডালিমের বিয়েতে উকিল বাবা ছিলেন। তবে যেভাবেই হোক আর যে কারণেই হোক ডালিমের অবাধ যাতায়াত ছিল বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে।

বঙ্গবন্ধু ডালিমকে খুব স্নেহ ও বিশ্বাস করতেন। পরিবারের আত্মীয় না হওয়া সত্ত্বেও ডালিম সিঁড়ি দিয়ে ওপরে অন্দরমহলে যেতেন। কথায় বলে ঘরের শত্রু বিভীষণ। হয়েছেও তাই। ডালিম বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাস ও ভালোবাসার সুযোগ নিয়ে ১৫ আগস্ট ভোরে জাতির জনককে হত্যা করার সংবাদ ঢাকার রেডিও স্টেশন থেকে উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করেন। বলেন, আমি মেজর ডালিম বলছি, শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে। খন্দকার মোশতাক দেশের নুতন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। সারা দেশে আজ থেকে সান্ধ্য আইন জারি করা হলো ইত্যাদি ইত্যাদি। এই স্বঘোষিত খুনি ডালিমসহ সকল খুনিদের প্রথমে খন্দকার মোশতাক ও পরবর্তীতে জেনারেল জিয়ার সামরিক সরকার বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসে স্থায়ীভাবে পুনর্বাসিত করে। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী সকলকেই জেনারেল জিয়া ও বেগম খালেদা জিয়ার সরকার বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলোতে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করে।

স্বাধীনতার পর পর আমরা থাকতাম কলাবাগান ফাস্টলেনের একটা ভাড়াটিয়া বাসায়। বাসার ওপর পাশে ছিল আমার ল্যাবরেটরিজ। এখান থেকেই বাবাকে প্রতিদিন বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাড়িতে যেতে হতো। সময়টা খুব সম্ভবত ৭২ সালের শেষের দিকের একটি ঘটনা। বঙ্গবন্ধু তখনও শেরেবাংলা নগরের গণভবনে যাননি। তিনি রমনার গণভবনে অফিস করতেন।

একদিন রমনার গণভবনে যাওয়ার পথে হঠাৎ করেই বঙ্গবন্ধু বাবাকে জিজ্ঞেস করলেন, মেহদী সাহেব, আপনার ছেলে মেয়ে কয়জন? বাবা বললেন আটজন। বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল, আপনি থাকেন কোথায়? কলাবাগানে স্যার। কয় রুমের বাসা? এটা কি কোনো সরকারি বাসা? না স্যার, একটা প্রাইভেট বাসা ভাড়া নিয়ে থাকি। ছোটো ছোটো তিনটি রুম স্যার। আপনি আট ছেলে মেয়ে নিয়ে এত কষ্টে আছেন অথচ আমাকে কোনো দিন বলেননি কেন? মাত্র তিন রুমের বাসায় ১০ জন মানুষ থাকে কি করে? প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু  আমাদের এই  অবস্থার কথা  শুনে  নিজেকে  আর  স্থির  রাখতে পারেননি। সত্যি  তো  তিন  রুমের  বাসায় ১০ জন  মানুষ  থাকে  কি  করে?

বাস্তব  হলো  আমরা  দুই  ভাই  তখন  থাকতাম বাসার  বারান্দায়।  রাতে বৃষ্টি পড়লে  বিছানা  গুটিয়ে বারান্দার এক কোণে বসে রাত কাটিয়ে দিতাম। এতো  কষ্টে  থাকা  সত্ত্বেও  আমার  সৎ বাবা কোনোদিন মুখ খুলে বঙ্গবন্ধুকে কিছুই  বলেননি। আমরা আট ভাই বোন এত কষ্টের মধ্যে থাকলেও বাবা কোনদিন বঙ্গবন্ধুর কাছে সরকারি বাসার জন্য আবদার করেননি। অথচ আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু নিজে থেকেই একদিন জিজ্ঞেস করে বসলেন বাবাকে। সবই আল্লাহর ইচ্ছা। পুলিশের একজন সাধারণ ডি এস পি কেমনভাবে আছেন তার পরিবার নিয়ে সে খবরও রাখতে আগ্রহী আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু।

একজন মহান নেতা বলেই হয়তো বঙ্গবন্ধু সেদিন বুঝতে পেরেছিলেন আমাদের কষ্টের কথা। পাঠক একটু লক্ষ্য করুন, দেশের সর্বময় ক্ষমতাধারী প্রধানমন্ত্রী ইচ্ছা করেই জানতে চেয়েছেন একজন ডিএসপি র পারিবারিক অবস্থানের কথা। একেই বলে মহান নেতা।

সেদিন বঙ্গবন্ধু গণভবনে এসে প্রথমেই ডাক দিলেন তার রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমেদ ভাইকে। তোফায়েল ভাই বঙ্গবন্ধুর সামনে এলে বঙ্গবন্ধু বললেন, মেহদী সাহেব তার আট সন্তান নিয়ে এত কষ্ট করছেন। তুমি তাড়াতাড়ি দেখো ওনার জন্য কোনো সরকারি বাসা পাওয়া যায় কি-না। তোফায়েল ভাই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে খুব শিঘ্রই আমাদের জন্য সরকারি বাসার ব্যবস্থা করলেন। পরবর্তীতে আমরা কলাবাগান থেকে এসে উঠলাম সোবানবাগ সরকারি কলোনির একটি বাসায়। এই বাসা থেকেই ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট রাত পর্যন্ত বাবা বঙ্গবন্ধুর সিকিউরিটি অফিসার হিসেবে তার দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট সকালে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গিয়েছেন শেরে বাংলা নগর গণভবন ও সন্ধ্যা শেষে আবার ফিরে আসেন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে। ১৫ আগস্ট সকালে বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে নিয়ে যাওয়ার ডিউটি ছিল বাবার। কিন্তু সেই দায়িত্ব আর পালন করা হলো না।

স্বাধীনতার পর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু বাংলার মাটিতে পা রেখে প্রথমেই মদ বিক্রয় ও পান করা নিষিদ্ধ করেছিলেন। আমার মনে পড়ে ওইসময় তরুণ তরুণীরা মদ না পেয়ে ভিন্ন পন্থায় নেশা করার চেষ্টা করে। এদের কেউ কেউ ঢাকার হাইকোর্টের মাজার কিংবা পরিবাগের মাজারে এসে তখন গাঁজা সেবন করে নেশা করতেন। অনেকের সাথী ছিল মৃতসঞ্জীবনী। শুধুমাত্র বিদেশিদের জন্য ঢাকা কন্টিনেন্টাল হোটেলে মদ বিক্রয় হতো। মদ নিষিদ্ধ করাতে ভারত থেকে চোরাপথে বাংলাদেশে নানা ধরনের নেশাজাতীয় তরল পদার্থ স্মাগলিং হতো। একজন মুসলমান হিসেবে বঙ্গবন্ধু তার এই মহান দায়িত্ব পালন করেছিলেন সেদিন। এই সময় রাষ্ট্রীয় কোনো অনুষ্ঠানে কখনো মদ পরিবেশন করা হতো না। সম্ভবত এখনো এই নিয়ম প্রযোজ্য আছে।

তবে বঙ্গবন্ধু মদ বিক্রয় ও পান করা নিষিদ্ধ করলেও তার দলের অনেকে পর্দার আড়ালে মদ পান করতেন। একদিন তার মন্ত্রিপরিষদের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীকে (এখানে নাম প্রকাশ করা হলো না) নেশা অবস্থায় দেখে বঙ্গবন্ধু সরাসরি তাকে নাম ধরে বললেন, .....Can you see me? মন্ত্রী মহোদয় তখন একটু বেশি খেয়ে ফেলেছিলেন, যার কারণে নেতার চোখে ধরা পরে যান। বলতে বাধা নেই ওইসময় শুধু মন্ত্রীরাই নয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ এমনকি ছাত্রলীগের কেউ কেউ গোপনে মদ পান করেছেন। অথচ আমাদের নেতা বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন খাঁটি মুসলমান যিনি কখনই মদ স্পর্শ করেননি।

একদিন গণভবনের বারান্দায় একটি চেয়ারে বসেছিলেন বাবা। এমন সময় যুবলীগের একজন প্রভাবশালী নেতা (এখানে নাম উল্লেখ করা হলো না) বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে এলেন। তিনি আগে থেকেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করার সময় নিয়েছিলেন। যুবলীগ নেতা বঙ্গবন্ধুর রুমের ভেতরে ঢুকলে বাবা দরজা বন্ধ করে দেন। বাহির থেকে সব কথা পরিষ্কারভাবে শোনা না গেলেও কিছু কিছু কথা বাবা শুনতে পারেন। বঙ্গবন্ধু প্রচণ্ড রেগে বার বার ধমক দিচ্ছিলেন সেই নেতাকে। একসময় যুবলীগ নেতার কন্ঠে কান্নার শব্দ শোনা গেল। বাবা বললেন সম্ভবত যুবলীগ নেতা তখন বঙ্গবন্ধুর পা ধরে কেঁদে কেঁদে বার বার মাফ করে দেওয়ার জন্য বলছিলেন। তিনি আর এধরনের কাজ করবেন না বলে বার বার বলছিলেন। অনেকক্ষণ পর যখন যুবলীগ নেতা রুমের ভেতর থেকে বের হয়ে এলেন তখন বাবা পরিষ্কারভাবে দেখলেন তার দুই চোখ চোখের পানিতে লাল হয়ে আছে।

পাঠক এখন শুনুন আসল ঘটনাটা কি। কেন সেদিন বঙ্গবন্ধু ওই যুবলীগ নেতার ওপর রেগে গিয়েছিলেন? কেন তাকে প্রচণ্ডভাবে উচ্চস্বরে ধমক দিয়েছিলেন? এই নেতা একসময় লন্ডন সফরে এসেছিলেন। এখানে এসে তিনি সরকারের টাকা খরচ করে মদের বিল পরিশোধ করেন। লন্ডন বাংলাদেশ হাই কমিশনের মাধ্যমে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হয়ে রিপোর্ট বঙ্গবন্ধুর কাছে আসে। আর এজন্যই বঙ্গবন্ধু যুবলীগ নেতাকে গণভবনে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু তখন নাকি এতই রেগেছিলেন যে তাকে তার রাজনৈতিক পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার কথাও বলেন।

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর দীর্ঘ ২১ বৎসর দেশের ক্ষমতায় যারা ছিলেন তারাই পরবর্তীতে বাংলাদেশে মদ বিক্রয়ের লাইসেন্স আইনগতভাবে বরাদ্দ করে। হায়রে বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধুর মত একজন খাঁটি মুসলমানকে নিয়ে আজ ধর্মান্ধরা করছে সমালোচনা! ধর্মের নামে আসছে আক্রমনণ! আর কতদিন চলবে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এই মিথ্যার রাজনীতি?

লেখক: সুইডিশ লেফট পার্টি (ভেনস্টার পার্টি) সেন্ট্রাল কমিটির মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য