বিচারের দীর্ঘসূত্রতার ভুক্তভোগী খোদ প্রধানমন্ত্রী

প্রকাশ | ০৪ জুলাই ২০১৯, ০৮:২০

সৈয়দ ঋয়াদ, ঢাকাটাইমস

১৯৯৮ সালে ডেমরা থানায় করা হযরত আলী হত্যা মামলার নিষ্পত্তি হয়নি এখানো। চলে গেছে ২১ বছর। এতদিনেও বিচারকাজ শেষ না হওয়ায় ঢাকার পঞ্চম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ নুরুল আমিন বিপ্লবকে তলবও করেছে হাইকোর্ট।

মামলার দীর্ঘসূত্রতা কিন্তু অভিনব বা ব্যতিক্রম বিষয় না। লাখ লাখ মামলা রয়ে গেছে যেগুলো নিষ্পত্তিতে অস্বাভাবিক সময় লেগে যাচ্ছে। কখনো পরবর্তী প্রজন্মকেও চালাতে হচ্ছে মামলা।

প্রধানমন্ত্রী বা বিরোধী দেল থাকাকালে শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় একটি মামলাও নিষ্পত্তি করা যায়নি এক যুগের মধ্যে। সবচেয়ে কম সময়ে বিচারিক আদালতে রায় এসেছে ১৪ বছরে। একটি মামলা নিষ্পত্তিতে লেগেছে ২৮ বছর।

নানা ঘটনাপ্রবাহের পর বিচারিক আদালত থেকে রায় এলেও উচ্চ আদালতে মীমাংসা হয়নি এখনো। ফলে কারো সাজা চূড়ান্ত হয়নি।

আবার ৩১ বছর আগে চট্টগ্রামে বঙ্গবন্ধু-কন্যাকে প্রাণ বাঁচাতে জীবন দেওয়া ২৪ জনের পরিবার বিচারই পায়নি। প্রকাশ্য জনসভায় ঘটা এই হত্যাযজ্ঞের বিচার কোন পর্যায়ে তা জানে না কেউ।

প্রশ্ন উঠেছে প্রধানমন্ত্রীকেই যদি বিচার পেতে এতে বিড়ম্বনা আর দীর্ঘসূত্রতায় পড়তে হয়, তাহলে সাধারণ মানুষের কী হবে। কার্যক্ষেত্রে দেখাও যাচ্ছে না। বছরের পর বছর ঝুলে থাকতে থাকতে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় মামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৩ লাখেরও বেশি।

১৯৬৭ সালের মামলাও অনিষ্পন্ন অবস্থায় ঝুলে আছে আদালতে। মামলার বিচারে এই দীর্ঘসূত্রতার জন্য আইনগত জটিলতা, সংশ্লিষ্টদের অদক্ষতা ও সময়ক্ষেপণের প্রবণতাকে দায়ী করছেন আইনজীবীরা।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলছেন, মামলাজট কমাতে তারা সিঙ্গাপুরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে চান। সে দেশেও এক সময় ব্যাপক মামলা জট ছিল। বাংলাদেশেও কীভাবে সেই দেশের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো যায়, সেটা নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন মনে করেন, মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি না হওয়া সমাজে বিচারহীনতা নিয়ে এক ধরনের প্রচার আছে। তিনি বলেন, ‘মামলার বিচার না হওয়ার দুটি দিক আছে। একটি ভিকটিম (ভুক্তভোগী) এর দিক থেকে আর অন্যটি অপরাধীর দিক থেকে। বিচার না হওয়ার ফলে অপরাধী অপরাধ করতে আর দ্বিতীয়বার ভাবে না। অন্যদিকে ভুক্তভোগী পারিবারিক, সামাজিক ও আর্থিক নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। দীর্ঘদিন বিচার না পেয়ে মামলা লড়তে লড়তে সর্বস্বান্ত হওয়ার অনেক ঘটনা আমাদের সমাজে আছে। আর অন্যের বিরূপ অভিজ্ঞতা দেখে অনেকে আইনের আশ্রয় নেওয়ার কথাও ভাবেন না।’

শেখ হাসিনার জীবনের অভিজ্ঞতা

চার মেয়াদের প্রধানমন্ত্রী। তার বাবার নেতৃত্বে হয়েছে স্বাধীনতার সংগ্রাম। অথচ তার হত্যার বিচার কার্যকর হতে লেগেছে ৩৫ বছর। ততদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে তাকে।

বাবা হত্যার ছয় বছর পর দেশে ফেরা শেখ হাসিনাকেও বারবার তাড়া করেছে মৃত্যু। এক-দুই বার নয় অন্তত ১৯ বার হত্যাচেষ্টার তথ্য আছে। এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে অন্তত ১৪টি। কিন্তু বিচারিক আদালতে নিষ্পত্তি হয়েছে কেবল চারটি।

এই চারটি মামলার মধ্যে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় বিচারিক আদালত থেকে রায় এসেছে ১৪ বছর পর। উচ্চ আদালতে আপিলের দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগও নেই।

শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে ২০০১ সালে ৭৬ কেজি বোমা পুঁতে হত্যার যে চেষ্টা হয়েছিল, সেটার রায় পেতেও লেগেছে ১৬ বছর। হাইকোর্টে দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ দেওয়া হলেও দুই বছরেও শেষ হয়নি শুনানি।

গতকাল পাবনা আদালতে নয়জনকে ফাঁসি, ২৫ জনের যাবজ্জীবন এবং ১৩ জনের ১০ জনের কারাদ-ের রায় এসেছে যে কারণে, সেটি ঘটেছে ২৫ বছর আগে। ১৯৯৪ সালে শেখ হাসিনা রেলে পাবনায় গেলে ঈশ্বরদী স্টেশনে তার বগিতে গুলি ও বোমা ছোড়া হয়। প্রাণে বেঁচে যান তিনি। মামলা হলেও তদন্তই আটকেছে বিএনপি শাসনামলে। মাঝে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল ১৫ বছর। তবু শেষ করা যায়নি বিচার।

১৯৮৯ সালে ধানমন্ডিতে বাসায় গুলি করে হত্যাচেষ্টার রায় পেতে লেগেছে আরও বেশি সময়, ২৮ বছর। ২০১৭ সালের শেষ দিকে ১১ জনকে ২০ বছরের কারাদ- দিয়ে দেওয়া আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিলের মীমাংসা আটকে আছে।

১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামের লালদিঘি ময়দানে জনসভাস্থলে যাওয়ার পথে শেখ হাসিনার ট্রাক মিছিলে সশস্ত্র হামলা হয়। চট্টগ্রাম আদালত ভবনের পাশে পুলিশ নির্বিচারে গুলি ছুড়লে নিহত হন ২৪ জন। (ঘটনাস্থলে ২৪ জনের নামফলক আছে)। তাদের মধ্যে নয়জনের মতো নিহত হন শেখ হাসিনাকে মানববর্ম তৈরি করে রক্ষা করতে গিয়ে। এই ঘটনায় মামলা হলেও সেটি এখনো রায় আসেনি।

এ রকম আরও অন্তত নয়টি মামলার তথ্য আছে যেগুলোর তদন্ত কোন পর্যায়ে, বিচার কবে হবে, সে বিষয়ে কোনো ধারণা নেয়াই কঠিন।

সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘এটা প্রসিকিউশনের ব্যাপার পার্টিকুলার এই মামলাটি কেন দেরি হয়েছে তারা ভালো বলতে পারবে। সাক্ষীরা মামলায় অনুপস্থিত থাকতে পারেন। নানা কারণে দেরি হতে পারে।’

১৫ বছরের প্রধানমন্ত্রীর যদি রায় পেতে এত বিলম্ব হয় তাহলে সাধারণ মানুষের কী হবে- এমন প্রশ্নে বিশিষ্ট এই আইনজীবী বলেন, ‘আমাদের এখানে মামলায় দীর্ঘসূত্রতা তো আছেই। মামলার জট লেগে আছে। সেকারণে এখন বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘ হওয়ার একটা নিয়ম চালু হয়েছে। এল ফলে সাধারণ মানুষ ভোগান্তিতে পড়ছে। এর থেকে আমাদের বের হতে হবে।’

প্রবীণ আইনজীবী এম আমীর উল ইসলাম ইসলাম এই প্রসঙ্গেকে বলেন, ‘আমাদের দেশের বিচার প্রক্রিয়া যে বিলম্ব হচ্ছে সে কারণে আইনের শাষণে শৈথিল্য দেখা দিচ্ছে।

উত্তরণের উপায় সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রখ্যাত এই আইনজীবী বলেন, ‘বিচারিক  দীর্ঘসূত্রতা থেকে বাঁচতে এটা নিয়ে জাতীয়ভাবে ভাবতে হবে। কারণ বিচার পাওয়া মানুষের মৌলিক অধিকার। বিচারিক প্রকিয়া দেরি হলে ভুক্তভোগী ক্ষতিগ্রস্ত হন।’

প্রথম রায়

গতকাল পাবনা আদালতের আগে শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় আরো তিনটি রায় আসে। এর মধ্যে প্রথম রায়টি আসে ২০১৭ সালের ২০ জুলাই। ২০০১ সালের ২০ জুলাই প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে গোপালগঞ্জে কোটালীপাড়ায় জনসভা স্থলের কাছে ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে রাখা হয়েছিল। পরদিন ৮০ কেজি ওজনের আরও একটি বোমা উদ্ধার করা হয় কোটালীপাড়ার হেলিপ্যাড থেকে। এই মামলার নিষ্পত্তি হতে লেগে যায় ১৬ বছর।

মামলায় ১০ জনকে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদ- কার্যকর করার আদেশ হয়েছিল। একই সঙ্গে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে নয়জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- দেওয়া হয়।

এ মামলার রায়সহ সব নথি ২০১৭ সালের ২৪ আগস্ট হাইকোর্টে পাঠানো হয়। এরপর প্রধান বিচারপতির কাছে নথি উপস্থাপন করা হলে তিনি জরুরি ভিত্তিতে এ মামলার পেপারবুক তৈরির নির্দেশ দেন। প্রধান বিচারপতির নির্দেশে এরই মধ্যে পেপারবুক তৈরি হলে হাইকোর্টে আসামিদের ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের ওপর শুনানি শুরু হয়। কিন্তু এখনো এর নিষ্পত্তি হয়নি।

দ্বিতীয় রায়

১৯৮৯ সালের ১০ আগস্ট মধ্যরাতে ফ্রিডম পার্টির অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী কাজল ও কবিরের নেতৃত্বে শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসভবনে গুলি ও গ্রেনেড ছুড়ে বলে অভিযোগ আছে। শেখ হাসিনা তখন ওই বাসাতেই থাকতেন। ওই ঘটনায় বাড়ির নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ কনস্টেবল জহিরুল ইসলাম একটি মামলা করেন।

২০১৭ সালের ১৯ অক্টোবর এই মামলায় ফ্রিডম পার্টির ১১ জনকে ২০ বছর করে কারাদ- দেয় ঢাকার একটি আদালত। দ-িতরা উচ্চ আদালতে আপিল করলেও এর শুনানি হয়েছে কি না, হলে সেটি কোন পর্যায়ে আছে, এ বিষয়ে নিশ্চিত তথ্য দিতে পারছে না রাষ্ট্রপক্ষ। তবে আপিলের নিষ্পত্তি হয়নি, এটা নিশ্চিত।

অন্যান্য অনেক মামলার মতো এই মামলাটিতেও তদন্তে অবহেলার অভিযোগ ছিল। এরশাদ আমলে তো নয়ই, ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর পাঁচ বছরও মামলাটির তদন্ত আগায়নি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর পুলিশ তদন্ত করে। হামলার সাড়ে সাত বছর পর ১৯৯৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ১৬ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয়া হয়।

২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পর এই মামলাটি আবার আটকে যায়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরার পর ওই বছরের ৫ জুলাই আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরু হয়।

তৃতীয় রায়

২০০৪ সালে ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা মামলায় ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ১৯ জনকে যাবজ্জীবন এবং ১৯ জনকে মৃত্যুদ- দেয়া হয়।

এই মামলাটি তদন্তের পর্যায়ে থাকার সময় নানা ঘটনা ঘটে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার প্রকৃত হামলাকারীদের বাঁচিয়ে নিরীহ জজ মিয়াকে ফাঁসানোর চেষ্টা ফাঁস হয়েছে। অনেক ঘটনাপ্রবাহে এক যুগেরও বেশি সময় লেগে যায় বিচারিক আদালতে রায় আসতে।

বিচারিক আদালতে দীর্ঘ সময়ক্ষেপণের পর এই মামলাটি উচ্চ আদালতে দ্রুত মীমাংসার আশা করা হচ্ছিল। শুরুতে তৎপরতাও দেখা গেছে। ২০১৮ সালের ২৭ নভেম্বর দুই মামলার রায়সহ ৩৭ হাজার ৩৮৫ পৃষ্ঠার নথি পৌঁছে হাইকোর্টে। এরপর সাত মাসেও শুনানি হয়েছে- এমন তথ্য নেই। কবে শুনানি হবে, এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ কিছু বলতেও পারছে না।

(ঢাকাটাইমস/০৪জুলাই/ডব্লিউবি/জেবি)