রেল খাতের একটু যত্ন নিন

প্রকাশ | ০৪ জুলাই ২০১৯, ১১:৪৭ | আপডেট: ০৪ জুলাই ২০১৯, ১২:০০

রেজাউল করিম

লেখার শুরুতে অনুসন্ধানী সংবাদকর্মীদের কৃতজ্ঞতা জানাই। দেশ-বিদেশে কোনো ঘটনা ঘটলে তার শেঁকড়ের সন্ধান খোঁজে সংবাদকর্মীরা। দুর্ঘটনার তদন্ত কমিটি, প্রতিবেদন তৈরি আর অভিযুক্তদের সাময়িক বরখাস্তে সরকারিভাবে অনেকটা সময় লেগে যায়। কিন্তু বেসরকারি সংবাদকর্মীরা ঘটনার পরক্ষণেই রহস্য উদঘাটন করতে সর্বাত্মক চেষ্টা করে। সম্প্রতি পত্রিকার পাতা বা অনলাইনে ঢুকলেই চোখে পড়ে দেশের রেল বিভাগ নিয়ে প্রতিবেদন। বিশেষ করে রেললাইনের বিষয়টি।

গত ২৩ জুন রবিবার রাত ১২টার দিকে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় সিলেট থেকে ঢাকাগামী উপবন এক্সপ্রেসের দুটি বগি লাইন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে খালে পড়ে। লাইনচ্যুত হয় আরও তিনটি বগি। এতে বেশ কয়েকজন ট্রেনযাত্রী মারা যান। আহত হন অনেকে।

ফায়ার সার্ভিসের ১৩টি ইউনিট উদ্ধার কাজে করায় ২০ ঘণ্টা পর ওই রুটে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়। পরদিন বড়ছড়া ব্রিজের নিচে পড়ে থাকা বগি উদ্ধার করতে ফের ৭ ঘণ্টা ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে। এমন দুর্ভোগ নতুন কিছু না। প্রায়ই নজরে পড়ছে। এরপর নিয়মিত আয়োজন।

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান যান্ত্রিক প্রকৌশলী মো. মিজানুর রহমানকে প্রধান করে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন হয়। প্রতিবেদন কবে হবে কেমন হবে এটা যেকোনো ঘটনার অনেক পরের বিষয়।

এদিকে রেলসচিব মো. মোফাজ্জল হোসেন ও রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন, মন্ত্রিপরিষদের সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম সবাই বললেন মানুষ হুমড়ি খেয়ে রেলে উঠে। তাই এই দুর্ঘটনা। রেল বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ চেয়ারে থাকা মানুষদের কাছ থেকে আরেকটু গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য জাতির প্রত্যাশা ছিল। এই ঘটনার পর সংবাদকর্মীরা নিজ উদ্যোগেই রেললাইন পর্যবেক্ষণ করছে। সংবাদকর্মীদের ক্যামেরায় ধরা পড়ে রেল দুর্ঘটনা হওয়ার মতো নানা অব্যবস্থাপনা। রেললাইনের বিভিন্ন সংযোগে নাটের পরিবর্তে বাঁশে গোজ লাগিয়ে রাখার ছবি বা সংবাদ প্রকাশ হচ্ছে। কাঠের পাটাতনের পরিবর্তে বাঁশের খন্ড ফেলে রাখার সংবাদও পাচ্ছি। রেললাইনে লোহার লম্বা পাত অনায়েসে নাড়ানো যাচ্ছে। লাইনের এমন অব্যবস্থাপনা কি রেল দুর্ঘটনার জন্য যথেষ্ট না?

মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় না হয় আলোচিত একটি দুর্ঘটনা। তবে রেললাইনে অন্যান্যভাবেও মৃতের মিছিলের সারি কিন্তু খুব একটা খাটো না। রেললাইনে রয়েছে অসংখ্য রেলক্রসিং। ক্রসিং ওভার অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। অধিকাংশ ক্রসিংয়ে নেই কোনো ক্রর্সিংগেট। আবার কোথাও গেট থাকলেও নেই তার জনবল। ফলে ক্রসিং দিয়ে নির্বিঘেœ পারাপার হচ্ছে মালবাহী যানবাহনসহ পথচারী। ফলে অনেক সময় ঘটছে দুর্ঘটনা।

রেলমন্ত্রী বললেন, মানুষ হুমড়ি খেয়ে রেলে উঠেন বলে দুর্ঘটনা হয়। এর মানে রেলে পর্যাপ্ত যাত্রী হচ্ছে। বাস্তবেও তাই। রেলে উঠতে প্রায়ই আগাম টিকেট কাটতে হয়। মাঝেমধ্যেই দেখতে হয় টিকেট নেই। প্রশ্ন হচ্ছে হুমড়ি খেয়ে রেলে উঠলে এই খাতে লোকসান কেন হচ্ছে?

২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশ রেলওয়ের নিট লোকসান ছিল ১ হাজার ৮৫২ কোটি ৯৪ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। ওই অর্থবছরে রেলের আয় ছিল ১ হাজার ২৮৯ কোটি ৩৫ লাখ ৬৪ হাজার টাকা। আর ব্যয় ছিল ৩ হাজার ১৪২ কোটি ৩০ লাখ ৩০ হাজার টাকা। ২০১৮ সালের ১০ জুন জাতীয় সংসদে সরকারি দলের সাংসদ মামুনুর রশীদের প্রশ্নের জবাবে ওইসময়ের রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক এ তথ্য জানিয়েছিলেন।

যাত্রীতো কম ছিল না। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে যাত্রী ছিল ৬ কোটি ৪৯ লাখ, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ছিল ৬ কোটি ৭৩ লাখ, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৭ কোটি ৮০ হাজার এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে যাত্রী ছিল ৭ কোটি ৭৮ লাখ। তাহলে কি তদারকির অভাব?

আসা যাক দুর্ঘটনায়। বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব অংশ টাঙ্গাইল থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত রেললাইনের ১৭৬ কিলোমিটার সড়কে ২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সাত বছরে এই রেললাইনে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ২ হাজার ৭ জন। ট্রেনে কাটা পড়া ও ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে যাওয়াকেই এসব মৃত্যুর কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে রেলওয়ে পুলিশ। ঢাকা রেলওয়ে থানা ২০১৪ সালে ৩১৮ জন মারা যায়।

২০১৫ সালে ২৮৫ জন, ২০১৩ সালে ৩০৫ জন, ২০১২ সালে ৩০৬ জন, ২০১১ সালে ২১৫ জন ও ২০১০ সালে ২০৩ জন মানুষ ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা যায়। এছাড়া বাংলাদেশে রেল পুলিশের হিসেবে ২০১৬ সালে সারাদেশে এক হাজার মানুষ রেললাইনে কাটা পড়ে মারা যায়। ২০১৭ সালে সারাদেশে ট্রেনে কাটা পড়ে দুই হাজার ১০০ লোকের মৃত্যু হয়েছে। দুর্ঘটনা কিন্তু কমছে না। বরং বাড়ছে।

এবার আসা যাক আইন-কানুনে। রেলওয়ে আইন ১৮৯০। এ আইনে রেল চলাচলের জন্য পূর্ণ দিকনির্দেশনা দেওয়া আছে। রেললাইনের আশপাশে যেন কোনো অবৈধ স্থাপনা না উঠতে পারে, এজন্য কার্যকর আছে রেলওয়ে সম্পত্তি (অবৈধ দখল উদ্ধার) অধ্যাদেশ ১৯৭৯। রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী অধ্যাদেশ ১৯৭৬ অনুযায়ী রেলওয়ের নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনী রয়েছে। রয়েছে রেল পুলিশ (জিআরপি)।

১৮৯০ সালের রেল আইনে রেললাইনের দুই পাশে ১০ ফুটের মধ্য দিয়ে মানুষের চলাচল নিষিদ্ধ। এমনকী এর মধ্যে গরু-ছাগল ঢুকে পড়লে সেটিকেও নিলামে বিক্রি করে দেয়ার ক্ষমতা রয়েছে রেল কর্তৃপক্ষের। রেলে কাটা পড়ে কেউ আহত হলে উল্টো ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধেই মামলা করতে পারে রেলওয়ে। এতোসব কঠোর নিয়ম থাকার পরও প্রতিবছর এতো মৃত্যু কেন?

আধুনিক যুগে এক কিলোমিটার সড়ক পায়ে না হেঁটে আধা ঘণ্টা অপেক্ষা করে অটোরিকশার জন্য। এ যুগে যোগাযোগ ব্যবস্থায় যেমন জনপ্রিয় তেমন গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু এ খাতে মানুষ প্রয়োজনের তাগিদে খরচ করতে প্রস্তুত সেই খাতে লোকসান কেন হবে? সেহেতু নিঃসন্দেহে রেল একটি লাভবান খাত। একটি অটোরিকশা চালিয়ে পরবর্তী বছর মানুষ আরেকটি অটোরিকশা কেনে। তাহলে রেলে ক্ষতি কেন? বিশে^র বহু দেশ রেল থেকে বড় অংকের মুনাফা অর্জন করছে।

কার্বন ডাই-অক্সাইড যত বাড়ে, বাতাস তত বিষাক্ত হয়। দেশের বাতাসে নির্গত ২০ শতাংশ কার্বন ডাই-অক্সাইড পরিবহন থেকে আসে। এর মধ্যে সড়কযান থেকেই নির্গত হয় ৯০ শতাংশ। সড়কপথে প্রতি ট্রাফিক ইউনিট জ্বালানি খরচ রেলপথের চেয়ে সাড়ে তিন গুণ বেশি। সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধবই শুধু নয়, ট্রেন একই সঙ্গে নিরাপদ ও আরামদায়কও। সড়কপথে পরিবহনে পরিবেশদূষণ বেশি; ট্রেনের চেয়ে প্রাইভেটকারে ৮.৩ গুণ এবং ট্রাকে ৩০ গুণ বেশি। আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যা বেশি হওয়ায় দেশে মাথাপিছু কৃষিজমি মাত্র ১০-১১ শতাংশ। জমি সাশ্রয়ের দিক থেকেও সড়কের চেয়ে রেলপথ বেশি উপকারী। পাঁচটি বড় বাসের যাত্রী একটি ট্রেনে চলাচল করতে পারে। সাশ্রয়ী হওয়ায় পরিবহন হিসেবে গণমানুষের একান্ত নিজের পরিবহন হয়ে উঠেছে ট্রেন। এরকম মহা-উপকারী একটি পরিবহন খাত বছরের পর বছর ক্ষয় হচ্ছে অবহেলা, গাফিলতি আর দুর্নীতিতে। অথচ এ খাতে মনোযোগ দিলে ও যত্ন নিলে দেশবাসীর মূল্যবান অর্থ ও সময় যেমন সাশ্রয় হতো। যাতায়াত যেমন আরামদায়ক ও নিরাপদ হতো তেমনি দেশও হতে পারত পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে সমৃদ্ধ এবং অর্থনৈতিকভাবে লাভবান।

সম্প্রতি রেলওয়ের ১৩ খাতের অনিয়ম চিহ্নিত করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অনিয়ম বন্ধে ১৫টি সুপারিশও করেছে সংস্থাটি। দুদকের প্রতিবেদনে রেলের প্রধান অনিয়ম খাতগুলোর মধ্যে রয়েছে- ভূমি অধিগ্রহণ, রেলের যন্ত্রপাতি ক্রয়, যন্ত্রপাতি স্থাপন, লাইন নির্মাণে দুর্নীতি, যন্ত্রাংশের যথাযথ ব্যবহার না হওয়া ও আমদানিতে অনিয়ম ও দুর্নীতি, রেলের স্লিপার কারখানা অকার্যকর রেখে আর্থিক ক্ষতি ও এসবে তদারকির অভাবের কথা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

দুদকের দেয়া পরমর্শও কাজে আসার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। রেললাইনের দুর্ঘটনা কমাতে ও এ খাতকে লাভবান করতে একটু যতœ নিন।

লেখক: সংবাদকর্মী