আড়ালেই থাকবেন গডফাদার?

প্রকাশ | ০৫ জুলাই ২০১৯, ১৪:১১ | আপডেট: ০৫ জুলাই ২০১৯, ১৯:৩০

আরিফুর রহমান দোলন

মিষ্টি বিতরণ হয়েছে শহর বরগুনায়। প্রকাশ্যে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছেন আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার অনেকেই। বেশির ভাগেরই চোখে-মুখে খুশির আমেজ। গত মঙ্গলবার (২ জুলাই) শহর বরগুনার চিত্রটা এমনই। নয়ন বন্ড নামের একজন ‘খুনি’ সন্ত্রাসী পুলিশের সঙ্গে তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধে খুন হয়েছে। এই খুশি সেই খুনের জন্য। এই উচ্ছ্বাস খুনিও খুন হয়েছেন বলে। কী বিচিত্র আমরা! আমরা কতটা বদলে গেছি আর বদলে যাচ্ছি-এটা তো তারই প্রমাণ।

কিন্তু এই বদল কতটা স্বাভাবিক। নয়ন বন্ডদের মতো খুনিরা খুন হলেই কি ভয়ংকর সব অপরাধ, অপরাধীরা নির্মূল হয়ে যাবে?

সন্ত্রাসী নয়ন বন্ড খুন হয়েছে। কিন্তু তার গডফাদার? কে, কারা তৈরি করে নয়ন বন্ডদের। তাদের কী হবে? তারা আড়ালেই থেকে যাবেন?

নয়ন বন্ডরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সারা দেশেই। একেক জায়গায় একেক নামে। এরা কীভাবে তৈরি হয়? কারা তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেন? এর উত্তর কি একেবারেই অজানা? ক্রসফায়ার বলি কিংবা বিচারবহির্ভূত হত্যা তাতে কী যায় আসে। অপরাধী খুন হয়ে গেলেই কি অপরাধ নির্মূল হয়? হয় না। যদি হতো তাহলে গত দেড় দশকে সারা দেশে জেলায় জেলায় ক্রসফায়ার কি কম হয়েছে? কখনো ধর্ষক, কখনো মাদক কারবারি, কখনো ভয়ংকর কোনো সন্ত্রাসী। কিন্তু তাতে কি ওইসব অপরাধী থেমেছে? কোথাও কোথাও অপরাধের মাত্রায় সাময়িক সময়ের জন্য হেরফের হয়েছে মাত্র।

তাহলে বরগুনার ভয়ংকর সন্ত্রাসী, খুনি নয়ন বন্ড পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে খুন হয়ে যাওয়ায় এই উচ্ছ্বাস কেন? ফেসবুকে অনেকেই স্বস্তি প্রকাশ করে পোস্ট দিচ্ছেন। বাহবা দেওয়া হচ্ছে একজন খুনির করুণ পরিণতি যারা নিশ্চিত করলেন তাদের।

কিন্তু আমার প্রশ্ন তো অন্য জায়গায়। একজন নয়ন বন্ড কি এক দিনেই তৈরি হয়? ছিঁচকে চুরি, ছিনতাই, মাদক ব্যবসা কত ধরনের অপরাধকর্ম করে এরপরে ভয়ংকর রকমের সন্ত্রাসী হয়েছিল নয়ন? এটা কি কোনো শক্তির সহযোগিতা, মদদ, পৃষ্ঠপোষকতা, নেতৃত্ব ছাড়া সম্ভব হয়েছে?

কোন শক্তি ছিল নয়নের পেছনে? রাজনৈতিক? সামাজিক-সাংস্কৃতিক? অর্থনৈতিক? প্রশাসনিক? এখন পর্যন্ত পত্রপত্রিকায় যেসব খবর বেরিয়েছে তাতে বেপরোয়া খুনির রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা সম্পর্কে অনেক তথ্যই জানা গেছে। বরগুনা সদর আসনের সাংসদ ও সাবেক উপমন্ত্রী ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর ছেলে সুনাম দেবনাথের ডান হাত ছিল নয় বন্ড- এটি নাকি স্থানীয়ভাবে সর্বজনবিদিত। যদিও নয়ন বন্ড পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার পর সুনাম দেবনাথ ফেসবুক পোস্টে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, ‘আহ! কি শান্তি। দিস ইজ কল জাস্টিস।’

সুনাম দেবনাথ একদিকে যেমন সাংসদ ধীরেন্দ্র নাথ শম্ভুর ছেলে আরেক দিকে জেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদকও। দল হিসেবে আওয়ামী লীগ কখনোই বিচারবহির্ভূত হত্যাকে সমর্থন করে না; প্রশ্রয় দেয় না- এটা আমরা সবাই জানি। এটা সুনাম দেবনাথেরও অজানা নয়। অথচ বিস্ময়করভাবে তিনি স্রোতে গা ভাসালেন। সন্ত্রাসী নয়ন বন্ড পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে খুন হওয়ায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন। আমি তো মনে করি এভাবে আসলে নতুন কৌতূহলও তৈরি হলো। জীবিত নয়ন বন্ড কি তাহলে কারো কারো পৃষ্ঠপোষকতার বিষয় প্রকাশ করত! এই আশঙ্কা যাদের ছিল উচ্ছ্বাস কি তাদেরই? এই প্রশ্ন তো আসছে। এটা কি খুব অমূলক?

প্রবীণ জনপ্রিয় আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ তো রাখঢাক না করে সন্ত্রাসী নয়ন বন্ড তৈরির পেছনে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার বিষয়টিই সামনে নিয়ে এসেছেন? স্পষ্টবাদী ও সুবক্তা খ্যাত তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, ‘নয়ন বন্ড এক দিনে তৈরি হয়নি। রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় না পেলে নয়ন বন্ডরা তৈরি হতে পারে না।’ বরগুনার আওয়ামী লীগ নেতাদের উদ্দেশে সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, আপনারা কেন খেয়াল রাখছেন না? বৃহস্পতিবার বরিশালে আওয়ামী লীগের বিভাগীয় প্রতিনিধি সভায় তিনি বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরগুনার ঘটনাটি অবগত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী চীন সফর থেকে দেশে আসছেন। নয়ন বন্ডের সঙ্গে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পেলে প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন।

শুনেছি এই প্রতিনিধি সভায় আওয়ামী লীগের দুইজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বক্তৃতায় বলেছেন, বরগুনার ঘটনা দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। এটা মেনে নেওয়া যায় না। এ ঘটনার সঙ্গে যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে, তাদের বিরুদ্ধে দলীয়ভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সন্ত্রাসী, ‘খুনি’ নয়ন বন্ড ইস্যুতে এই খোলামেলা বক্তব্য দেওয়া দলীয় ও ব্যক্তিগত অবস্থান স্পষ্ট করায় ধন্যবাদ জানাই তোফায়েল আহমেদকে। প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। দলের সব পর্যায়ে গ্রহণযোগ্য জনপ্রিয় নেতা। পাশাপাশি একজন দায়িত্বশীল নেতা হিসেবেও স্বীকৃত। ‘খুনি’ সন্ত্রাসী নয়ন বন্ডদের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন, তার পরবর্তী পদক্ষেপ যেন সত্যিই কার্যকর হয়। এটি যেন স্রেফ রাজনৈতিক বক্তব্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থাকে। কারণ আমাদের অতীতের অভিজ্ঞতা কিন্তু এসব ক্ষেত্রে মোটেও সুখকর নয়। অপরাধীকে ক্ষেত্রবিশেষ ধরা হলেও বরাবরই গডফাদাররা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যান। এটি যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে।

খোদ হাইকোর্ট বলেছেন, নয়ন বন্ডরা এক দিনে একা একা তৈরি হয় না। কেউ না কেউ তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকে। উচ্চ আদালত বিচারবহির্ভূত হত্যার বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সতর্ক করে বলেছেন, ‘আমরা বিচারবহির্ভূত হত্যা পছন্দ করি না। এতে পাবলিকের কাছে ভুল তথ্য যেতে পারে।’

আমরা অপরাধের বিচার চাই। চাই আইনের শাসন। হাইকোর্টের মতো আমরাও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সমর্থন করি না। কারণ এতে অন্য অপরাধী আড়াল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও থাকে।

বরগুনার রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যার প্রধান নায়ক ও মামলার প্রধান আসামি সাব্বির আহমেদ ওরফে নয়ন বন্ডকে ঘৃণা করছিল সারা জাতি। নয়নকে জীবিত ধরে সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করা যখন সব মহলের দাবি তখনই পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে খুন হয় সন্ত্রাসী ‘খুনি’ নয়ন বন্ড। জঙ্গি দমন, দুর্ধর্ষ সব জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করে আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যখন তাদের সক্ষমতা কয়েক ধাপ বৃদ্ধির প্রমাণ দিয়েছে বিভিন্ন সময়, তখন নয়ন বন্ডের মতো স্থানীয় সন্ত্রাসীকে জীবিত ধরতে না পারা খুব স্বাভাবিকভাবেই নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সন্ত্রাসী, ‘খুনি’ নয়নের উত্থানের পেছনে কে বা কারা? কাদের স্বার্থে নয়ন বা তার বাহিনী কাজ করত? নয়ন হত্যার মাধ্যমে এ বিষয়গুলো পুরোপুরি চাপা পড়ে যাবে কি না, এই প্রশ্নগুলো কিন্তু রয়েছে।

তবে আশার আলো কিছুটা হলেও দেখতে চাই প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ ও অন্য সিনিয়র নেতারা ‘খুনি’ নয়নের পৃষ্ঠপোষকদের মুখোশ খুলে দেওয়ার আশ্বাস দেওয়ায়। নয়ন বন্ডদের পৃষ্ঠপোষকদের মুখোশ খুলে দিয়ে সন্ত্রাসীদের লালন-পালনে রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ের ক্ষেত্রে নীতিগত উন্নতি হোক- এটাই সবার চাওয়া। যদিও কাজটি কঠিন।

বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যার আরেক খলনায়ক রিফাত ফরাজী। সন্ত্রাসী রিফাত ফরাজীকে প্রশ্রয় দেওয়ার ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক নেতাদের নাম আসছে। এক্ষেত্রে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও সাবেক স্বতন্ত্র সাংসদ দেলোয়ার হোসেনের নাম বিভিন্ন গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার হয়েছে।

বরগুনায় গত কয়েক দশক ধরে স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে শম্ভু-দেলোয়ার বিপরীতমুখী অবস্থানে। বারবার চেষ্টা করেও কেন্দ্র এই দুই নেতারা দ্বন্দ্ব নিরসন করতে পারেনি। ২০০১ সালে কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত অমান্য করে শম্ভুর নৌকা মার্কার বিরুদ্ধে জয়ীও হয়েছেন দেলোয়ার। দল বিদ্রোহী এই নেতাকে পরে আবার ফিরিয়েও নিয়েছে আওয়ামী লীগে। শোনা যায়, নিজের অবস্থান সুসংহত করতে ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু ও দেলোয়ার হোসেন দীর্ঘদিন ধরে শহর বরগুনা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় পেশিশক্তির রাজনীতিকে পৃষ্ঠপোষকতা করছেন। তাদের দুজনের দ্বন্দ্বে জেরবার জেলা আওয়ামী লীগ। এতটাই যে, সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনে বরগুনা সদর আসন থেকে শতাধিক নেতা আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চান। যা ছিল সারা দেশে রেকর্ড। এ রকম অমিল যেখানে দুই নেতার সব কাজে, সেখানে একটি বিষয়ে তাদের মিল লক্ষণীয়। সেটা সন্ত্রাস, সন্ত্রাসী মদদ দেওয়া।

আমরা ‘খুনি’ নয়ন বন্ড তৈরি হওয়া দেখতে চাই না। চাই তাদের যারা তৈরি করে সেই হাত ভেঙে দেওয়া হোক। মানুষ বাঁচুক স্বস্তিতে, শান্তিতে। সারা দেশে সরকার যে অভাবনীয় উন্নতি করছে তার সুফল আরও ভালোভাবে মানুষ ভোগ করতে পারবে, যদি জেলায় জেলায় নয়ন বন্ডরা আর তাদের পৃষ্ঠপোষকরা দমে যায়। নির্মূল হয়। সেই প্রক্রিয়া শুরু হোক বরগুনা থেকেই।

গডফাদাররা কি ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাবে? এই প্রশ্নের সুরাহা হোক। আইনের শাসন সুনিশ্চিত হোক। আমরা শৃঙ্খল জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে আরও মাথা উঁচু করে চলি। আশায় সংসার। এই আশা করব। এই প্রশ্নে দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ। আর মানুষ ঐক্যবদ্ধ হলে সব সম্ভব। সংশ্লিষ্টরা যেন তা ভুলে না যায়।

লেখক: সম্পাদক, দৈনিক ঢাকা টাইমস, ঢাকা টাইমস ২৪ ডটকম এবং সাপ্তাহিক এই সময়