গণপরিবহনে নৈরাজ্য-১

আরও কঠিন হয়েছে বাসে চড়া

প্রকাশ | ০৬ জুলাই ২০১৯, ০৭:৫৪ | আপডেট: ০৬ জুলাই ২০১৯, ০৭:৫৯

কাজী রফিক, ঢাকাটাইমস

নির্ধারিত জায়গায় দাঁড়াবে বাস, লাইন ধরে টিকিট কেটে উঠবে, নামবে যাত্রীরা। এমন ঘোষণা আর সিদ্ধান্ত এসেছে বারবার। কিন্তু এখন বাস্তবতা হচ্ছে নির্ধারিত কোনো স্থানে যাত্রী উঠানামা হয় না। বাসগুলো চলতে থাকে, এর মধ্যেই লাফ দিয়ে নামতে আর উঠতে হয়।

২০১৮ সালের জুলাইয়ের শেষে বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় দুজন শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে তীব্র ছাত্র আন্দোলনের পর সরকারের পক্ষ থেকে নানা ব্যবস্থার ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু এক বছরে দৃশ্যত কোনো পরিবর্তন নেই।

এর মধ্যে গত ৪ সেপ্টেম্বর  ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া ঘোষণা দেন, ঢাকায় কেবল নির্ধারিত বাস স্টপেজে বাস থামবে। সেদিন বাস থামার জন্য নির্ধারণ করে দেয়া হয় ১২১টি জায়গা। কথা ছিল, কেবল এসব স্টপেজ থেকেই যাত্রীরা বাসে উঠবে এবং নামবে। কিন্তু ঘোষণাই সার। পুলিশের আর কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ দেখা যায়নি।

যদিও ঘোষণা চলতেই থাকে। গত ২০ মে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র সাঈদ খোকন ঘোষণা দেন, ঢাকায় টিকিট ছাড়া কোনো বাস চলবে না। অর্থাৎ যাত্রীদের টিকিট কেটে নির্ধারিত স্থান থেকে বাসে উঠতে হবে লাইন ধরে, নামতেও হবে নির্ধারিত স্টপেজে। পথে কোথাও যাত্রী উঠানামা করবে না।

সেদিনের ঘোষণা ছিল, ঈদুল ফিতরের পরেই এই পদ্ধতি চালু হয়ে যাবে। কিন্তু ঈদের পর এক মাস পেরিয়ে গেল। বাস চলছে আগের মতোই বিশৃঙ্খলভাবে। যাত্রীরা নামছেন যেখানে খুশি সেখানে, উঠছেনও সেভাবেই। তার চেয়ে বড় কথা কর্মদিবসে দু-একটি স্টপেজ ছাড়া বাকি পথে উঠানামা সবই দৌড়ে করতে হয়। বাস চলতে থাকে, এর মধ্যেই চলে যাত্রী উঠানামা। দাঁড়ালেই তাড়া দেয় পুলিশ। 

রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকায় বাসে উঠানামার জন্য একটি জায়গা নির্দিষ্ট আছে। সেখানে কেবল বিআরটিসি এবং গ্রিন ঢাকা নামে দুটি পরিবহনের বাসের যাত্রীরা টিকিট কেটে লাইন করে বাসে উঠতে পারেন। অন্য লোকাল বাসগুলোর কোনোটারই দাঁড়িয়ে যাত্রী তোলার সুযোগ নেই। বিশেষ করে অফিস সময়ে যাত্রীদের ঝুঁকি নিয়ে বেশ জোরেশোরে দৌড় দিয়েই উঠানামা করতে হয়।

পায়ে ব্যথা থাকায় ক্র্যাচ নিয়ে খিলক্ষেতে অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছেন আল ফারুক। একের পর এক বাস আসছে, কিন্তু দ্রুত টান দিয়ে চলে যাচ্ছে। যাত্রীরা যার যার মতো লাফ দিয়ে চড়ছে। কিন্তু ফারুকের সে অবস্থা ছিল না। আধা ঘণ্টার বেশি সময় পার হয়ে যাওয়ার পর তিনি সেখানে দায়িত্ব পালন করা এক পুলিশ সদস্যকে বললেন, ‘এটা কেমন করছেন। বাসগুলোকে দাঁড়াতে দেন।’

ওই পুলিশ সদস্য বললেন, ‘কত যাত্রী উঠছে, আপনি উঠতে পারেন না, সেটা আপনার সমস্যা।’

কবির হোসেন নামে একজন যাত্রী বলেন, ‘বাসে উঠার কিছু সিস্টেম থাকে। কিন্তু ঢাকায় সিস্টেম বলতে কিছুই নাই। কোথা থেকে উঠতে হবে আর কোথায় নামতে হবে এমন কিছুই নাই। আমরা পুরুষ মানুষ দৌড়াদৌড়ি করে উঠি। এটা অনেক কষ্টের কাজ। কিন্তু নারীদের কথা চিন্তা করুন। তাদের কতটা কষ্ট হয়।’

নন্দন পার্ক থেকে মতিঝিল পর্যন্ত চলা ওয়েলকাম পরিবহনের সহ-সভাপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘পুলিশ অনেক জায়গায় এখন বাস দাঁড়াতে দেয় না। পুলিশের ভয়ে গাড়ি টান দেয়, মানুষ পড়ে যায়।  অনেক সময় দুর্ঘটনা ঘটে। কাউন্টার সিস্টেম হলে গাড়ি একটা নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড়াবে। মানুষও লাইন ধরে উঠবে।’

এর মধ্যে পাল্টানো বলতে দৃশ্যমান কেবল একটি বিষয়। চলার পথে বাসগুলো দরজা বন্ধ করে রাখছে। এ বিষয়ে পুলিশের ব্যাপক কড়াকড়ি। দরজা খোলা দেখলেই দেওয়া হয় মামলা।

আরো পাল্টায়নি চালকদের পাল্লাপাল্লি, বেতনের বদলে শ্রমিকদের সঙ্গে মালিকদের চুক্তিতে বাস চালানো। এর ফলে শ্রমিকরা বাসে সর্বোচ্চ সংখ্যক যাত্রী তোলার চেষ্টা করেন। সিটিং সার্ভিসের নামে ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েও ঠেসে যাত্রী নেয়া নিয়মিত ঘটনা। কিন্তু এসব অব্যবস্থাপনায় পুলিশ কখনো ব্যবস্থা নিয়েছে, সেই উদাহরণ নেই।

মেয়রের ঘোষণা ‘কথার কথা’

টিকিট কেটে যাত্রী উঠানামা হলে বাড়তি ভাড়া নেয়া, যেখানে সেখানে উঠানামা বন্ধ হয়ে যেত। এ বিষয়ে মেয়রের ঘোষণার পর আশা করা হচ্ছিল, কিছুটা হলেও শৃঙ্খলা ফিরবে। কিন্তু ছয় সপ্তাহেও এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি নেই। পরিবহন মালিকরা বলছেন, এ বিষয়ে তারা কিছুই জানেন না।

গত ২০ মে নেয়া সিদ্ধান্তটি দ্রুত সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন, ডিটিসিএ (ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ), ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ, বাস মালিক সমিতি, বিআরটিএকে নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু অতীতের বহুবারের মতো এবারও কিছুই করা হয়নি।

মোহাম্মদপুর থেকে মতিঝিল পর্যন্ত চলা রজনীগন্ধা পরিবহনের অন্যতম মালিক আব্দুল কাদের ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘টিকিটের মাধ্যমে বাস চলাচলের যে কথা ছিল সেটা যে অবস্থায় ছিল, তাতে ঈদের আগেই সব হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সিদ্ধান্ত পুরোপুরি আসেনি। তাই করা হয়নি। আর এটা আমার একার সিদ্ধান্ত তো না। সবাই যে সিস্টেমে চলবে। আমরাও সে সিস্টেমে চলব।’

ওয়েবিলের তুলনায় টিকিট কাউন্টার মালিকদের জন্য ব্যয়সাপেক্ষ এবং কিছুটা অনিরাপদ বলে মনে করেন এই বাস মালিক। বলেন, ‘বর্তমানে ওয়েবিল পরিচালনা করতে বাড়তি লোক লাগছে ১৭ জন। কিন্তু টিকিট কাউন্টার সিস্টেম করলে লোক লাগবে ৪৫ জন। আবার ৫ থেকে ৬ লাখ খরচ বাড়বে। অনেক সময় কাউন্টার থেকে টাকা-পয়সা ছিনতাই হয়।’

‘সরকার বললে আমরা অবশ্যই এটা করব। আমিও স্বীকার করি, টিকিট সিস্টেম করলে হুড়োহুড়ি পাড়াপাড়ি কমবে, সবাই সুশৃঙ্খলভাবে বাসে উঠতে পারবে। আমরাও এটা চাই।’

ওয়ালকাম পরিবহনের সহ-সভাপতি জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘বাস দাঁড়ানোর জন্য যদি জায়গা দেয়া হয় তাহলে আমাদের ভালো হয়। কাউন্টার বসানোর মতো ওই রকম জায়গা দরকার। কাউন্টারের সামনে পাঁচটা, সাতটা গাড়ি দাঁড়াতে পারে এমন জায়গা দেওয়া উচিত। এতে করে মানুষজন সুশৃঙ্খল ভাবে বাসে উঠতে পারবে। আমরা সুশৃঙ্খলতা চাই।’

টিকিট পদ্ধতি কবে থেকে বাস চলবে এবিষয়ে তেমন কিছুই জানেন না এই পরিবহন মালিক। বলেন। ‘এখন পর্যন্ত মৌখিক ভাবে শুনেছি টিকিট সিস্টেম হতে পারে। আমাদের কিছু দাবি আছে। সেগুলো মেনে টিকিট সিস্টেম চালু করা হোক।’

এয়ারপোর্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউ পরিবহন মালিক সমিতির নেতা বাবুল শেখ ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমরা তো শুনে আসছি, টিকেট সিস্টেম হবে। কিন্তু কোনো সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা আমরা এখনো পাইনি।’

তবে অতি অল্প সময়ের মধ্যে নগরীতে টিকেট পদ্ধতি বাস চলবে বলে জানিয়েছেন গণপরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ। ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, ‘টিকিট পদ্ধতি গণপরিবহনের ভাড়া নির্ধারণ পদ্ধতি প্রায় গুছিয়ে আনা হয়েছে। আর টিকিট বিক্রির কাউন্টার তৈরির সাথে সাথে বর্তমানে চলমান যাত্রী ভোগান্তিও কমে আসবে।’

ঘোষণা তো ছিল ঈদের পরই এই পদ্ধতি চালু হবে- এমন প্রশ্নে এনায়েত বলেন, ‘টিকিট সিস্টেম করতে যে কাউন্টার প্রয়োজন তার কাজ চলছে। পার্কিংয়ের জায়গার জন্য কাজ চলছে। শিগগিরই টিকিট সিস্টেম চালু হবে।’

‘আমরা যেখানে যেখানে স্টপেজ করব সেটার রুট তৈরির কাজ চলছে। বর্তমানে যেসব স্টপেজ আছে, সেগুলো চেঞ্জ হবে। যেখানে যেখানে পার্কিং হবে, কাউন্টার হবে সেখানে সেখানে স্টপেজ হবে।’

টিকিট পদ্ধতি চালু হলে অতিরিক্ত ভাড়ার সমস্যারও সমাধান হবে বলে আশ্বাস দিচ্ছেন গণপরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব। জানান, ২০১৫ সালে গণপরিবহন ভাড়ার নীতিমালা দেয় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। সরকার নির্ধারিত ভাড়ায় গত পাঁচ বছর ধরে চলছে রাজধানীর গণপরিবহন। সরকারের উচিত ভাড়া বাড়ানো। সরকার ভাড়া না বাড়ানো পর্যন্ত এই ভাড়াই কার্যকর থাকবে।

(ঢাকাটাইমস/০৬জুলাই/ডব্লিউবি/জেবি)