মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে রং ফর্সাকারী ক্রিম

ঢাকা টাইমস ডেস্ক
| আপডেট : ০৬ জুলাই ২০১৯, ০৯:০৩ | প্রকাশিত : ০৬ জুলাই ২০১৯, ০৮:৪৯

গায়ের রং কিছুটা মলিন। এই রং নিয়ে হিনমন্যতায় ভোগেন অনেক নারী। তারা চান আরও ফর্সা হতে। তারপরই বেশিরভাগ সময় ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়াই বাজারে থাকা বিভিন্ন নামী-বেনামী রং ফর্সাকারী ক্রিম মাখতে শুরু করেন। কিন্তু এসব ক্রিম উপকার করার বদলে বেশিরভাগ সময় ক্ষতি করে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ে ত্বক।

এ নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি। সেখানে এমন সব ক্রিম ব্যবহারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন ও ব্যবহার না করতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে।

শিরোমা পেরেইরা (ছদ্মনাম) নামের এক নারী জানান, ‘বিয়ের দিন আমাকে দেখতে সত্যিই খুব খারাপ লাগছিল। এতো খারাপ আর কখনো লাগেনি’।

শ্রীলঙ্কায় রাজধানী কলম্বোর কাছেই থাকেন ৩১ বছর বয়সী শিরোমা। গত বছর বিয়ের আগে তিনি তার ত্বকের রঙ ফর্সা করতে চেয়েছিলেন। তার মতো দক্ষিণ এশিয়ায় আরও অনেক নারীই তাদের গায়ের রঙ উজ্জ্বল করতে আগ্রহী।

তিনি বলেন, ‘বিয়ের দু’মাস আগে আমি একটি সেলুনে গিয়েছিলাম। রঙ ফর্সা করার জন্যে তারা তখন আমাকে একটি ক্রিম দিয়েছিল। দু’সপ্তাহ ব্যবহার করার পর দেখলাম আমার মুখ জ্বলে গেছে। আমি ত্বক ফর্সা করতে চেয়েছিলাম কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা পুড়ে গেল।’

শিরোমা যখন তার বিয়ের কেনাকাটা এবং অনুষ্ঠানে কারা কারা অতিথি হয়ে আসবেন সেদিকে নজর দেওয়ার কথা ছিল তখন তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তার ত্বকের চিকিৎসায়। এর পেছনে অনেক অর্থও খরচ হয়েছে তার। তার কথায়, ‘আমার মুখে প্রথমে সাদা রঙের ছোপ ছোপ দেখা গেল যা পরে কালো দাগে পরিণত হলো।’

সেলুন থেকে তাকে রং ফর্সাকারী যে ক্রিম দেওয়া হয়েছিল সেটি কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত কোন প্রসাধনী সামগ্রী ছিল না। এই ক্রিম অবৈধভাবে আমদানি করে কালো বাজারে বিক্রি করা হচ্ছিল।

এক বছর ধরে চিকিৎসার পর পেরেইরার গলায় এখনো সেই কালো দাগ রয়ে গেছে। এরকম আরও কিছু অভিযোগ পাওয়ার পর শ্রীলংকার কর্তৃপক্ষ এখন অনুমোদন নেই এরকম রং ফর্সাকারী ক্রিম বিক্রির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে।

কিন্তু এই সমস্যা শুধু শ্রীলঙ্কারই সমস্যা নয়। এশিয়া এবং আফ্রিকাতে লাখ লাখ নারী ও পুরুষ গায়ের রং ফর্সা করার জন্যে এমন কিছু ব্যবহার করেন যা শেষ পর্যন্ত তাদের জন্যে ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়।

বাজার

সারা বিশ্বে গায়ের রং ফর্সা করার এই বাজারের আকার ২০১৭ সালে ছিল প্রায় ৪৮০ কোটি ডলার। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৭ সালের মধ্যে এই বাজার দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়াবে ৮৯০ কোটি ডলারে। এর চাহিদা মূলত এশিয়া ও আফ্রিকার মধ্যবিত্ত পরিবারে।

রং ফর্সাকারী এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে সাবান, ক্রিম, ব্রাশ, ট্যাবলেট, এমনকি ইঞ্জেকশনও। মানব দেহে মেলানিন পিগমেন্টের উৎপাদন কমিয়ে দেয় এই ইঞ্জেকশন এবং এগুলো অনেক জনপ্রিয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক হিসেবে দেখা গেছে, আফ্রিকাতে প্রতি ১০ জন নারীর চারজন রং ফর্সাকারী পণ্য ব্যবহার করে থাকেন। সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় নাইজেরিয়াতে। সেখানে ৭৭ শতাংশ নারী ত্বকের রং উজ্জ্বল করার জন্যে নানা ধরনের প্রসাধনী ব্যবহার করে থাকেন। তারপরই রয়েছে টোগো ৫৯ শতাংশ এবং দক্ষিণ আফ্রিকা ৩৫ শতাংশ। এশিয়ায় ৬১ শতাংশ ভারতীয় নারী এবং চীনে ৪০ শতাংশ নারী এসব ব্যবহার করেন।

গবেষণায় দেখা গেছে, এসব জিনিসের প্রতি ভোক্তাদের চাহিদাও বাড়ছে। একই সঙ্গে এসব মোকাবেলা করাও কঠিন হয়ে পড়েছে। গত বছর ঘানাতে কর্তৃপক্ষ গর্ভবতী নারীদেরকে সতর্ক করে দিয়েছিল রং ফর্সাকারী ট্যাবলেট না খাওয়ার জন্যে। কারণ এসব ট্যাবলেটে পাওয়া গেছে এন্টিঅক্সিডেন্ট গ্লুটাথিওন। গর্ভবতী নারীরা মনে করেন তারা যদি এই ট্যাবলেট খান তাহলে তাদের গর্ভে থাকা সন্তানের গায়ের রং ফর্সা হবে।

এ ধরনের পণ্য মোকাবেলার জন্যে দক্ষিণ আফ্রিকাতে আছে কঠোর আইন। গাম্বিয়া, আইভরি কোস্ট এবং রোয়ান্ডাতে রং ফর্সাকারী যেসব পণ্যে হাইড্রোকুইনোন আছে সেগুলো নিষিদ্ধ করেছে।

শরীরে মেলানিনের (বাদামী কিম্বা কালো পিগমেন্ট, যার কারণে ত্বকের রঙ নির্ধারিত হয়) উৎপাদন কমিয়ে দেয় হাইড্রোকুইনোন। একই সঙ্গে এটি স্থায়ীভাবে ত্বকের ক্ষতিও করতে পারে।

চিকিৎসা

ব্রিটিশ স্কিন ফাউন্ডেশন বলছে, ‘চর্ম চিকিৎসকদের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধানে হাইড্রোকুইনোন আছে এরকম পণ্য নিরাপদে ব্যবহার করা যেতে পারে। ত্বকের যেসব স্থানে কালো দাগ পড়ে গেছে সেগুলো এর মাধ্যমে চিকিৎসা করা যায় এবং তাতে ভালো ফল পাওয়াও সম্ভব।’

ব্রিটিশ স্কিন ফাউন্ডেশনের একজন মুখপাত্র এন্টন আলেকজানড্রফ জানিয়েছেন, ‘রং ফর্সাকারী ক্রিমের কোনো কোনোটি হয়তো সহায়ক। কিন্তু সেটা একজন ত্বক বিজ্ঞানীর পরামর্শে ও তত্ত্বাবধানে ব্যবহার করতে হবে। অন্যথায় সেগুলো বিপদজনক হয়ে উঠতে পারে।’

কার্যকারিতা

তবে ব্রিটিশ স্কিন ফাউন্ডেশন বলছে, ‘পুরো ত্বক ফর্সা করার নিরাপদ কোন উপায় নেই’। আলেকজানড্রফ জানান, ‘দোকানে যেসব ক্রিম বিক্রি হয় সেগুলো যে আসলেই গায়ের রং ফর্সা করে এমন প্রমাণ নেই। এর উল্টো ফলও হতে পারে। এই ক্রিম আপনার ত্বককে অস্বাভাবিক রকমের সাদা অথবা আরও কালো করে দিতে পারে। এর ফলে নষ্ট হয়ে যেতে পারে ত্বকের স্বাভাবিক গুণাবলীও’।

তবে ম্যালাসমার মতো কিছু কিছু সমস্যার চিকিৎসার জন্যে চিকিৎসকরা রং ফর্সাকারী পণ্য প্রেসক্রাইব করে থাকেন। বয়স হলে শরীরে এরকম সমস্যা দেখা দেওয়া খুবই সাধারণ বিষয়। এতে ত্বকে বাদামী কিম্বা ধূসর রঙের দাগ তৈরি হয়। বিশেষ করে মুখে। নারীদের দেহে এরকম হওয়ার হার বেশি। বিশেষ করে গর্ভধারণের সময়।

আলেকজানড্রফ জানান, ‘একজন চর্ম চিকিৎসকের মাধ্যমে ত্বকের রং ফিরিয়ে আনা সম্ভব। তবে সেজন্যে অনুমোদিত কিছু ক্রিম আছে যা ডাক্তারদের পরামর্শে ব্যবহার করা যেতে পারে।’

পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া

কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে নারীরা চিকিৎসকদের পরামর্শ ও নজরদারি ছাড়াই এসব রং ফর্সাকারী কসমেটিক ব্যবহার করতে শুরু করে দেন। কিন্তু এসব প্রসাধনীর গুরুতর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া থাকতে পারে। যেমন:

  • ত্বকে চুলকানি
  • প্রদাহ
  • জ্বালাপোড়া
  • ফুলে যাওয়া
  • ফুসকুড়ি পড়া
  • মার্কারি

কিছু কিছু পণ্য যেগুলো দ্রুত রং ফর্সা করার দাবি করে সেগুলোতে নানা রকমের ক্ষতিকর উপাদানও থাকতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ‘যেসব পণ্যে মার্কারি আছে সেগুলো স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর’।

কিন্তু তারপরও মার্কারি আছে এরকম পণ্য চীন, লেবানন. মেক্সিকো, পাকিস্তান, ফিলিপিন, থাইল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদিত হচ্ছে। শরীরে মেলানিন গঠনের প্রক্রিয়াকে শ্লথ করে দেয় এই হাইড্রোকুইনোন।

যেসব পণ্যে মার্কারি আছে সেগুলোর বিক্রি ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং আফ্রিকার বহু দেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ফিলিপাইন এবং আরও কয়েকটি দেশ অল্প পরিমাণে মার্কারি আছে যেসব পণ্যে সেগুলো বিক্রির অনুমোদন দিয়ে থাকে।

স্বাস্থ্য

আলেকজানড্রফ বলেন, ‘মার্কারি হচ্ছে বিষ। এর ফলে নানা রকমের স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরি হতে পারে’। যেসব সাবান ও ক্রিমে মার্কারি আছে সেগুলো ব্যবহার করলে কী কী ক্ষতি হতে পারে সেবিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে-

  • কিডনির ক্ষতি
  • ত্বকে ফুসকুড়ি হওয়া, রং বদলে যাওয়া, কালশিটে দাগ পড়া
  • ব্যাকটেরিয়া ও ফাংগাল সংক্রমণ প্রতিরোধের ক্ষমতা কমে যাওয়া
  • উদ্বেগ উৎকণ্ঠা, বিষণ্ণতা, মানসিক অস্থিরতা থেকে বৈকল্য
  • স্নায়ু-জনিত সমস্যা

ধারণা

আমেরিকান ত্বক বিজ্ঞানী শুয়াই জু বলেন, ‘লোকেরা মনে করেন যে ত্বকের ক্রিম সাধারণত নিরাপদ। এর ফলে স্বাস্থ্যের কী ক্ষতি হতে পারে এটা নিয়ে তারা চিন্তাও করেন না। এই মানসিকতা পরিবর্তনের প্রয়োজন।’

তিনি বলেন, ‘আমার কাছে যেসব রোগী আসেন তারা আমাকে বিভিন্ন রকমের ক্রিম দেখান যেগুলো তারা কোন ধরনের প্রেসক্রিপশান ছাড়াই বাজার থেকে কিনেছেন। সেগুলো দেখে সত্যিই আমি অবাক হয়ে যাই।’

তিনি যেখানে পড়ান সেখানে এসব ক্রিমের ব্যবহারের উপর একটি গবেষণা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে স্টেরয়েড আছে এরকম কিছু কিছু ক্রিম ঠিকমতো ব্যবহার না করলে শরীরের ক্ষতি করতে পারে।

বিপদ

বিপদজনক এসব পণ্যের বিক্রি ঠেকাতে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপের পক্ষে ড. শু। তার কথায়, ‘ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্প যেরকম নিয়ন্ত্রিত, কসমেটিক শিল্প সেরকম নয়। শীর্ষস্থানীয় যেসব কোম্পানি আছে তারা এধরনের বিপদজনক পণ্য তৈরি করে না। কিন্তু এধরনের পণ্য যখন বাইরে থেকে আমদানি করে আনা হয় তখনই নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেয়’।

বাজারে এরকম অনেক জাল পণ্য বিক্রি হচ্ছে, সেগুলো চিহ্নিত করা কঠিন। যারা এসব উৎপাদন করে তাদেরকে পাকড়াও করাও সহজ নয়।

শু বলেন, ‘কিছু কিছু পণ্য আছে যেগুলোতে কী কী উপাদান আছে সেসবও উল্লেখ করা হয় না। আপনি জানতেও পারেন না কারা এসব উৎপাদন করেছে। পণ্যটি ধরে এর উৎপাদনকারীদের খুঁজে বের করাও সম্ভব হয় না।’

ফলে ত্বকের রং ফর্সা করার এরকম দ্রুত সমাধানের ব্যাপারে লোকজনকে তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ‘অনেক পণ্যই নিরাপদ। কিন্তু আপনি যদি অনলাইনে এসব জিনিস কেনেন তখন আপনাকে অনেক সতর্ক থাকতে হবে’।

সামাজিক আন্দোলন

এসব পণ্য জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পেছনে অনেকে সিনেমা নাটকের মতো বিনোদন শিল্পকে দায়ী করে থাকেন। কারণ এগুলোতে বিশেষ ধরনের শারীরিক কাঠামো ও ত্বকের রং-এর উপর জোর দেওয়া হয়। আর এর ফলে হুমকির মুখে পড়ে লাখ লাখ নারীর স্বাস্থ্য।

গায়ের রং ফর্সা হতে হবে- এই মানসিকতার পরিবর্তনের জন্যে বিভিন্ন সমাজে নানা ধরনের আন্দোলন চলছে। ভারতে এরকম এক আন্দোলনের নাম: ‘কালোই সুন্দর’। পাকিস্তানে এরকম এক আন্দোলনের স্লোগান: ‘সুন্দর হতে হলে আপনার ত্বকের রং ফর্সা হতে হবে না’।

ঢাকা টাইমস/০৬জুলাই/একে

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

ফিচার এর সর্বশেষ

কিডনি রোগ বাড়ছে শিশুদেরও! যেসব লক্ষণ দেখলেই সতর্কতা জরুরি

সস্তার পেয়ারার গুণে বশে থাকে ডায়াবেটিস-উচ্চ রক্তচাপসহ নানা জটিল রোগ

যে পাঁচ সমস্যায় আক্রান্তরা গুড় খাওয়ার আগে একবার ভাবুন, নইলে...

সাজেদুর রহমান শাফায়েতের স্বপ্ন পৃথিবী ঘুরে দেখা

খাওয়ার পরপরই চা পান উপকার না ক্ষতি? কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা

জ্বরের মধ্যে যে পাঁচ খাবার খেলেই বিপদ! জানুন, সাবধান হোন

গরমে হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে ডায়াবেটিস রোগীদের! সুস্থ থাকবেন যেভাবে

মুখে দুর্গন্ধের কারণে হা করতেও অস্বস্তি লাগে? সমাধান কী জানুন

লিভার ভালো রাখে লাউ! ওজন এবং উচ্চ রক্তচাপও থাকে নিয়ন্ত্রণে

কিডনি ভালো রাখে আমের পাতা! উচ্চ রক্তচাপও থাকে নিয়ন্ত্রণে

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :