শিশু ধর্ষণে ভয়াবহ পরিস্থিতি

তানিয়া আক্তার, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ০৭ জুলাই ২০১৯, ০৮:০১
প্রতীকী ছবি

গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে চার বছরের শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে একজনকে আটক করেছেন স্থানীয় জনতা। অভিযোগ শিশুটিকে আম খাওয়ানোর লোভ দেখিয়ে ঘরে ডেকে নিয়ে তার কাম চরিতার্থ করেছেন। শিশুটির চিৎকারে পাশের বাড়ির লোকজন হাতেনাতে আটক করে।

এই বিষয়টি মোটেও অভিনব কোনো ঘটনা নয় দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, এই ধরনের মর্মান্তিক সংবাদ প্রায়ই করতে হয় গণমাধ্যমকর্মীদেরকে। প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও এই ঘটনাগুলো ঘটছে।

এমনকি এক বছর বা তার চেয়ে কম বয়সী শিশু ধর্ষণের মতো ঘটনাও ঘটেছে। মানুষ রীতিমতো আঁতকে উঠছে। যাদের ঘরে মেয়ে শিশু, তারা আতঙ্কে। বিশেষ করে রাজধানীর ওয়ারীতে সাত বছর বয়সী একটি শিশুকে ধর্ষণের পর মেরে ফেলার বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় চলছে।

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদন বলছে, শিশু ধর্ষণের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিকটজনরাই এসব ঘটনা ঘটিয়ে থাকে। আর এর বেশিরভাগই চেপে যায় ভুক্তভোগীরা। ফলে গণমাধ্যমে যেসব ঘটনা প্রকাশ হয়, প্রকৃত পরিস্থিতি তার চেয়ে বেশি ভয়াবহ। কেন এমন হচ্ছে, তা নিয়ে কথা হচ্ছে।

শিশুদের নিয়ে কাজ করেন এমন প্রতিষ্ঠানের গবেষক এবং একজন সমাজবিজ্ঞানী বলছেন, এই বিকৃতির কোনো একক কারণ নেই। বিকৃত যৌন লালসা, বিচার না হওয়ার প্রচার, জৈবিক চাহিদা পূরণ করার সুযোগ না থাকা, চাইল্ড পর্নোগ্রাফিও এর জন্য দায়ী।

শিশুদের নিয়ে কাজ করছে, এমন একটি সংগঠন বলছে, শিশুরা দুর্বল বলেই তাদেরকে টার্গেট করা হচ্ছে। আর ঘটনাগুলো বেশি ঘটছে নি¤œবিত্ত পরিবারগুলোতে। সেখানে শিশুদের দেখভালের জন্য পর্যাপ্ত লোকজন থাকে না। শিশুদের মধ্যে যৌনতা নিয়ে ধারণা না থাকায় তারা আক্রান্ত হওয়ার আগে বুঝতেও পারে না কী হচ্ছে।

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র জানাচ্ছে, গত ছয় মাসেই তারা ৮৯৫ শিশু নির্যাতন ও হত্যার তথ্য পেয়েছে। এর মধ্যে ১০৪ শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। ৪০টি শিশু আত্মহত্যা করেছে। এ ছাড়া রহস্যজনকভাবে মৃত্যু হয়েছে ৪১ শিশুর। এর মধ্যে বহু শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে।

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম-বিএসএএফ এর পরিসংখ্যান চলছে, চলতি বছরে প্রথম চার মাসে (২৯ এপ্রিল পর্যন্ত) ২৯০টি শিশু ধর্ষিত হয়েছে। জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে যথাক্রমে ৫২, ৬০, ৫২টি করে মোট ১৬৪ টি শিশু ধর্ষিত হয়েছে। আর শুধু এপ্রিল মাসেই ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১১৫টি শিশু। অর্থাৎ প্রতি মাসে গড়ে ৭০টির বেশি শশু ধর্ষিত হয়েছে, যা অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি। বিএসএএফের তথ্য অনুযায়ী গত চার মাসে সর্বনিম্ন আড়াই বছর বয়সের শিশুও ধর্ষণের শিকার হয়েছে।

মানবাধিকার বিষয়ক আরেক সংগঠন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন জানাচ্ছে ২০১৮ সালে সারাদেশে ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন, হত্যা ও শারীরিক নির্যাতনের কারণে মারা গেছে ২৭১টি শিশু। বছরটিতে কেবল ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৪৩৩টি শিশু।

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের ‘স্টেট অব চাইল্ড রাইটস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৭ সালে দেশে ৫৯৩টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর আগে ২০১৬ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছিল ৪৪৬টি শিশু।

ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান নেহাল করিম ঢাকা টাইমস বলেন, ‘জৈবিক চাহিদা পূরণের কোনো নিরাপদ ব্যবস্থা নেই। সমাজও রক্ষণশীল। পেটের ক্ষুধা নিবারণ না করে থাকা গেলেও জৈবিক ক্ষুধা না নিবারণ করে থাকা যায় না। কিন্তু আমাদের দেশে এই বিষয়গুলো নিয়ে খোলামেলা কথাও বলা যায় না। তাই এগুলো বাড়ছে।’

শিশুদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন সেভ দ্য চিলড্রেনের চাইল্ড রাইট গভর্নমেন্স অ্যান্ড চাইল্ড প্রটেকশন এর পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘পর্নোগ্রাফি বিশেষ করে চাইল্ড পর্নোগ্রাফি শিশু ধর্ষণের জন্য বিশেষভাবে দায়ী।’

‘এ ছাড়া শিশুরা টার্গেটেড হওয়ার কারণ তারা দুর্বল। ধর্ষকরা সাধারণত দুর্বলদের টার্গেট করে। এর ফলে নারী, শিশু কিংবা দরিদ্র শিশুরা এর মধ্যে পড়ছে। গত ছয় মাসের জরিপ বলে, অন্যান্য বছরের চেয়ে উদ্বেগজনক হলো ১০ বছরের নিচের শিশুদের টার্গেট করা হচ্ছে। এ ছাড়া মেয়ে শিশুদের চেয়ে ছেলে শিশুরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে।’

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায় শিশুরা প্রতিবেশী, উত্যক্তকারী, বন্ধু, আত্মীয়-স্বজন বা অপরিচিত ব্যক্তির দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছে।

গত বছর উত্যক্তকারী দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১১০ জন আর প্রতিবেশী দ্বারা ১০২ জন। গণধর্ষণের শিকার ৩৭ জন, শিক্ষক দ্বারা ১৭ জন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ফাতেমা রেজিনা ইকবাল মনে করেন পারিবারিক সচেতনতা জরুরি। তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘নি¤œবিত্ত পরিবারে এগুলো বেশি ঘটছে। সেখানে উন্নয়ন কর্মী, সমাজকর্মীরা কাজ করলে গণ সচেতনতা তৈরি হবে। এ ছাড়া টেলিভিশন খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। মীনা কার্টুনে বিভিন্ন সামাজিক ইস্যু সেখানে তুলে ধরা হয়েছে। শিশুদের বোঝার মতো করে যৌন হয়রানির বিষয়টিও তুলে ধরা যায়। সেই সঙ্গে বাবা মা তাদের সন্তানদেরকে যেন বিশ্বস্ত ছাড়া কারো কাছে রেখে না যান।

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী শাহীন আনাম বলছেন, এটা একটা উদ্বেগজনক বিষয় যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও বাচ্চাদের নিরাপত্তা দিতে পারছে না। প্রতিটি সূচকেই গত বছরের চেয়ে শিশুর প্রতি নিপীড়ন বেড়েছে।

‘আমরা শিশুদের নিরাপত্তা দিতে পারছি না। সংবাদপত্রে যেটা বের হয় আসলে ঘটনা তার চেয়েও অনেক বেশী ঘটে। কিন্তু এগুলো জানা যায় না কারণ মানুষ সহজে মামলা করে না কিংবা পুলিশের কাছে যায় না।’

বিচারহীনতা বা দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়ার কারণে দোষী ব্যক্তির শাস্তি নিয়ে মানুষের মধ্যে আস্থা নেই বলেও মনে করেন এই সমাজকর্মী। বলেন, ‘বিচারহীনতা বা দায়মুক্তির সংস্কৃতি বড় কারণ। মূল্যবোধের অবক্ষয় তো আছেই।’

(ঢাকাটাইমস/০৭জুলাই/ডব্লিউবি/জেবি)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন এর সর্বশেষ

কথায় কথায় মানুষ পেটানো এডিসি হারুন কোথায়? থানায় ছাত্রলীগ নেতাদের মারধরের তদন্ত কোথায় আটকে গেল?

মজুত ফুরালেই বাড়তি দামে বিক্রি হবে সয়াবিন তেল

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে ইরান-ইসরায়েল সংকট

ছাদ থেকে পড়ে ডিবি কর্মকর্তার গৃহকর্মীর মৃত্যু: প্রতিবেদনে আদালতকে যা জানাল পুলিশ

উইমেন্স ওয়ার্ল্ড: স্পর্শকাতর ভিডিও পর্নোগ্রাফিতে গেছে কি না খুঁজছে পুলিশ

জাবির হলে স্বামীকে বেঁধে স্ত্রীকে জঙ্গলে ধর্ষণ, কোথায় আটকে আছে তদন্ত?

নাথান বমের স্ত্রী কোথায়

চালের বস্তায় জাত-দাম লিখতে গড়িমসি

গুলিস্তান আন্ডারপাসে অপরিকল্পিত পাতাল মার্কেট অতি অগ্নিঝুঁকিতে 

সিদ্ধেশ্বরীতে ব্যাংক কর্মকর্তার মৃত্যু: তিন মাস পেরিয়ে গেলেও অন্ধকারে পুলিশ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :