ভূমধ্যসাগরে মৃত্যুর মুখ থেকে ফেরা সেন্টুর গল্প

প্রকাশ | ০৮ জুলাই ২০১৯, ০৮:৩৬

রেজাউল করিম, টাঙ্গাইল

‘ভূমধ্যসাগরের উত্তাল ঢেউয়ে ছোট্ট একটি নৌকায় আমরা ৭৫ জন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থেকেও বেঁচে ফিরতে পেরেছি। মনে হচ্ছিল সাগরের মধ্যেই না খেয়ে মারা যাবো। কখনো ভাবিনি বেঁচে ফিরতে পারবো।’ চার মাস পর তিউনিসিয়া থেকে ফেরত আসা টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার বাঘেরবাড়ী গ্রামের সেন্টু মিয়া এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন। তিনি ওই গ্রামের চানু মিয়ার ছেলে।

ইতালিতে অভিবাসনপ্রত্যাশী ৬৪ বাংলাদেশির দেশে ফেরার ঘটনা সম্প্রতি বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। গত ২৫ জুন দেশে ফেরা কয়েকজনের মধ্যে রয়েছেন টাঙ্গাইলের নাগরপুরের সেন্টু। তিনি পাঁচ বছর বয়সী দুই জমজ ছেলের বাবা। চার ভাইয়ের মধ্যে সেন্টু সবার বড়। অভাবের সংসার হওয়ায় স্কুলের গ-ি পেরুতে পারেননি তিনি। বাবা কৃষি কাজ করে সংসার চালাতেন। পরিবারের বড় ছেলে হওয়ায় সংসারের দায়িত্বভার পড়ে তার ওপর। এরপর কিশোর বয়সেই ঢাকায় একটি বইয়ের ছাপাখানায় কাজ নেন সেন্টু।

তার ছোট ভাই মিন্টুকে ধার-দেনা করে কাতারে পাঠান। সেখানে মিন্টুর সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে উঠে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার বাসিন্দা হামিদের সঙ্গে। হামিদের ভাই থাকেন ইতালিতে। মিন্টুর স্বপ্ন জাগে বড় ভাই সেন্টু মিয়াকে ইতালি পাঠাবেন। এরপর সেন্টুর ইতালি যাওয়ার বিষয়ে মিন্টু তার বন্ধু হামিদের সঙ্গে কথা বলেন। বিষয়টি হামিদ তার ভাই ইতালি প্রবাসী জনিকে জানান।

পরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার ইতালি প্রবাসী জনি ও একই এলাকার লিবিয়া প্রবাসী রফিকুল ইসলাম সেলিম মিলে সেন্টুকে ইতালি পাঠানোর জন্য সাড়ে আট লাখ টাকায় চুক্তি করেন। চুক্তি মোতাবেক সেন্টুর পরিবার ঋণ, গরু বিক্রি, জমি বন্ধক ও স্বজনদের কাছ থেকে ধার নিয়ে সাড়ে আট লাখ টাকা জমা দেয় ব্যাংকের মাধ্যমে।

ভুক্তভোগী সেন্টু মিয়া বলেন, চলতি বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বিমানবন্দর থেকে দুবাই, মিসর হয়ে লিবিয়ার বেনগাজী এলাকার একটি ক্যাম্পে পৌঁছাই। সেখানে এক সপ্তাহ থাকার পর দালাল রফিকুল ইসলাম সেলিম আমাকেসহ পাঁচজনকে সেখান থেকে নিয়ে অন্য আরেকটি রুমে আটকে রেখে অতিরিক্ত টাকা দাবি করেন। টাকা আদায়ে বিভিন্নভাবে নির্যাতনও চালান। পরে দালাল সেলিমকে ১০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। ওই সময় একটি রুমে বিভিন্ন এলাকার ৫৩ জন লোক ছিল। তাদেরকেও বিভিন্নভাবে নির্যাতন করা হতো। সেখানে প্রায় চার মাস থাকার পর ইতালির উদ্দেশে সাগরপাড়ে আমাকেসহ আরও ৭৫ জনকে নিয়ে যায়।

এর আগে বড় একটি জাহাজের ছবি দেখানো হয়। ওই জাহাজে করে ইতালি নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু সাগরপাড়ে গিয়ে দেখা যায় ছোট্ট একটি নৌকা। আমরা ওই নৌকায় উঠতে চাচ্ছিলাম না। আমাদেরকে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে সবার মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে নৌকায় উঠানো হয়। ৭৫ জন এক নৌকায় ইতালির উদ্দেশে রওনা হই। কয়েক ঘণ্টা যাওয়ার পর নৌকার মটরের তেল শেষ হয়ে যায়। ভাসতে থাকি ভূমধ্যসাগরে।

সেন্টু বলেন, ‘সাগরে ব্যাপক ঢেউ ছিল। কোনো ধরনের খাবার ছিল না আমাদের সঙ্গে। শুধু পানি খেয়ে সাগরের মধ্যে নৌকায় চার দিন কেটে যায়। সবার জীবনই তখন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ছিল। চার দিনের মাথায় একটি তেলের জাহাজ সাগর দিয়ে যাচ্ছিল। আমরা ওই জাহাজ দেখে হাত ইশারা করে ডাকার চেষ্টা করি। এরমধ্যে অনেকেই নৌকা থেকে লাফিয়ে জাহাজের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। পরে তিউনিসিয়ার তেলবাহী জাহাজের লোকজন এসে আমাদের সবাইকে জাহাজে উঠান। পরে তিউনিসিয়া দেশটির কেউ আমাদের নিতে চায়নি। এরপর ওই জাহাজে ১০ দিন কেটে যায়। পরে জাহাজকর্মীরা সংশ্লিষ্টদের বিষয়টি জানালে আমাদেরকে বাংলাদেশে পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়। আমি তৃতীয় ধাপে গত ২৫ জুন বাংলাদেশে ফিরেছি। পরে ২৬ জুন গ্রামের বাড়িতে আসি।

মৃত্যুর মুখ থেকে ফেরা এই যুবক বলেন, ‘এখন দালাল জনি ও রফিকুল ইসলাম সেলিমের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। এখন আমি নিঃস্ব। কী করবো কিছুই বুঝতেছি না।’ 

সেন্টুর বাবা চানু মিয়া বলেন, ‘ঋণ, জমি বন্ধক ও আত্মীয়দের কাছ থেকে দার নিয়ে সাড়ে আট লাখ টাকা দালালদের দেওয়া হয়। এখন আমাদের আর কিছুই রইল না। কোন জনমে এই ঋণ সুদ করতে পারবো সেটাও জানি না।’ 

(ঢাকাটাইমস/০৮জুলাই/জেবি)