গ্যাস বনাম লাকড়ি, রান্নার খরচ বেশি কাদের?

প্রকাশ | ০৮ জুলাই ২০১৯, ১০:০৭ | আপডেট: ০৮ জুলাই ২০১৯, ১১:৫৬

জহির রায়হান, ঢাকাটাইমস

গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তের পর সবচেয়ে বেশি কথা হচ্ছে আবাসিক সংযোগে বিল ১৭৫ টাকা বৃদ্ধি নিয়ে। রান্নার জন্য ৮০০ টাকার বদলে এখন থেকে দিতে হবে ৯৭৫ টাকা।

এই বাড়তি বিল দিতে হবে বলে ক্ষোভ গ্রাহকদের মধ্যে। এর প্রতিবাদে হরতালও হয়েছে আধাবেলা। বামপন্থী দলগুলোর এই কর্মসূচি শেষে ঢিলেঢালা এই কর্মসূচি পালন শেষে আরো কঠোর কর্মসূচির ঘোষণা এসেছে।

তবে এই কর্মসূচিতে মানুষের অংশগ্রহণ কিন্তু বেশি হয়নি। কারণ নিয়ে ফেসবুকে নানা আলোচনা, যুক্তি, পাল্টা যুক্তি, ধারণা আর ব্যাখ্যা চলছে।

পরিসংখ্যান বলছে, গ্যাসের সরাসরি সুবিধাভোগীরা কিন্তু দেশে সংখ্যাগুরু নয়, ভীষণভাবে সংখ্যালঘু। পাইপলাইনের গ্যাসে রান্না হয়, এমন বাড়ির সংখ্যা ২০ লাখের কিছু বেশি। আর শতকরা ১০ শতাংশ মানুষও গ্যাসে রান্না করতে পারে না।

বাকিরা কী দিয়ে রান্না করেন? যাদের অর্থের টানাটানি কম, তারা সিলিন্ডার গ্যাসে রান্না করেন। কিন্তু সেখানে পাইপলাইনের মতো হিসাব না কষে গ্যাস খরচের সুযোগ নেই।

সিলিন্ডারে খরচ বেশি

বরিশালের গৌরনদীর হেমায়েত উদ্দিনের সংসারে সদস্য চার জন। আগে রান্না হতো লাকড়ি পুড়িয়ে। কিন্তু ঝামেলার কারণে সিলিন্ডার গ্যাসে ভরসা এখন। খরচ কেমন? ঢাকা টাইমসকে হেমায়েত বলেন, ‘একটি সিলিন্ডার লাগে মাসে। খরচ হয় এক হাজার টাকার  মতো। তবে গ্যাস কম পোড়াতে ভাত রান্না হয় রাইস কুকারে। পানি গরম করার ক্ষেত্রেও সাবধান থাকি।’

রংপুরের সাংবাদিক রফিকুল ইসলামের পরিবারে সদস্য সংখ্যা তিন জন। তরকারি আর বাচ্চার দুধ গরম হয় গ্যাসে। ভাত রান্না হয় গ্যাসে। তার দেড় মাসে দুটি সিলিন্ডার লাগে। খরচ হয় দুই হাজার ৫০ টাকা। পাইপলাইনের ৯৭৫ টাকা দিতেও তিনি রাজি। বলেন, ‘তাহলে আমার খরচ কমত। বিদ্যুৎ বিলও এত লাগত না।’

বরিশালের গৌরনদীর আঁখি নূরের পরিবারে সদস্য সংখ্যা পাঁচ জন। সব রান্না হয় গ্যাসে। তাই তার দুটি সিলিন্ডার লাগে। খরচ হয় দুই হাজারের বেশি। আরো সিলিন্ডার পরিবহনের খরচ আর ঝামেলা।

আরও কষ্টের লাকড়ির রান্না

২০১৬ সালে জাতিসংঘের শিশু তহবিল-ইউনিসেফ এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে বাংলাদেশে শতকরা ৮৯ শতাংশ বাড়িতে কাঠ বা গোবর শুকিয়ে রান্নার কাজে ব্যবহার করা হয়। ঘর গরম করার জন্যও এগুলো ব্যবহার হয়।

হিসাব করলে দেখা যায়, এই রান্নার খরচ কিন্তু গ্যাসের চেয়ে বেশি। সেই সঙ্গে আছে পরিবেশ দূষণ আর ধোঁয়াজনিত কারণে রান্না ঘরে থাকা মানুষদের কষ্ট আর রোগের আশঙ্কা। সৃষ্ট ধোঁয়া ও তাপে ঘরে বায়ুদূষণ হয়। গ্রামাঞ্চলের স্বল্প আয়ের পরিবারের শিশুরাই এর বড় শিকার।

এ জন্য বাংলাদেশে প্রতি বছর সাড়ে আট হাজার শিশুর মৃত্যুর তথ্য আছে। 'ক্লিয়ার দ্য এয়ার অব চিলড্রেন : দ্য ইমপ্যাক্ট অব এয়ার পলুলেশন অন চিলড্রেন' শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়।

ময়মনসিংহে এক মণ ভেজা লাকরির দাম ১৪০ টাকা আর শুকনোটি ২০০ টাকা মন। বরিশালেও একই দাম পরিশোধ করতে হয় ক্রেতাদের।

বরিশালে আকলিমা আক্তারে ২০ বছরের সংসার। লাকরিতেই রান্না করেন। সম্প্রতি সিলিন্ডারও ব্যবহারও করা হচ্ছে। কিন্তু গ্যাস শুধু খাবার গরম আর হালকা রান্নার কাজে ব্যবহার করেন তিনি।

ঢাকা টাইমসকে আকলিমা বলেন, ‘মাটির চুলায় লাকরিতে রান্না করা কী কষ্ট সেটা যে রান্না করে সেই বুঝবেন। সারাক্ষণ চুলার কাছে বসে থাকতে হয়। ধোঁয়া আর তাপে মুখের জ্বালাপোড়া হয়। তার উপর আছে পাতিলের তলায় কালি পড়ে যাওয়ার সমস্যা। এ পাতিল ধোয়ায় আবার অনেক সময় ব্যয় করতে হয়। সব মিলিয়ে অনেক কষ্ট।’

‘প্রতি মণ লাকরি কিনতে হয় ২০০ টাকা করে। সাধারণত এক মণ লাকরি দিয়ে তিন/চার দিন রান্না করা যায় চার জনের জন্য। নিজেদের কিছু লাকরি থাকার কারণে সব লাকরি কিনতে হয় না। নইলে রান্নাতে আমার যেত দুই হাজার টাকার বেশি।’

রাজধানীর হাতিরপুলে হারুন আহমদের পাঁচ জনের পরিবারের গৃহিনী বিথী আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আসলে গ্যাসের চুলায় রান্নার সঙ্গে লাকরির চুলার রান্নার তুলনাই হয় না। লাকরিতে রান্না করার যে কষ্ট তা আমি মনে হয় করতে পারব না। রান্না করতেই আমার সারাদিন লেগে যাবে। শহরে রান্নাসহ সব কাজ করার যে কষ্ট সেটা গ্রামে লাকরি দিয়ে শুধু রান্না করাই তেমন কষ্ট।’

প্রিপেইড মিটারেবিল কম

বিস্ময়কর এই তথ্যটি মিলেছে গ্যাসের প্রিপেইড মিটার আছে এমন একটি বাড়ির বাসিন্দাদের কাছ থেকে।

সাদ্দাম হোসাইন থাকেন রাজধানীর কল্যাণপুরে এলাকায়। তার বাড়িতে পাইপলাইনে গ্যাসের সংযোগের বিল হয় ‘যতটুকু ব্যবহার, ততটুটু’ হিসেবে। আড়াই মাস আগে ৫০০ টাকা রিচার্জ করেছিলেন। গতকাল পর্যন্ত খরচ হয়েছে ৩১৫ টাকা। এখানো ১৮৫ টাকা আছে।’

দুই জনের সংসারে রান্নাবান্না কম হয়। কিন্তু চুলা হিসেবে বিল দিতে হলে দুই মাসেই দিতে হতো ১৭০০ টাকা। জুলাই থেকে লাগত আরো ১৭৫ টাকা বেশি।

সাদ্দাম হোসাইন বলেন, ‘স্মার্ট প্রিপেইড মিটার দিয়ে ভালোই হয়েছে। এখনতো দেখছি আগে যেখানে মাসে দুই চুলায় যে বিল দিতাম এখন সে বিল দিয়ে তিন মাস চলতে পারব।’

(ঢাকাটাইমস/০৮জুলাই/ডব্লিউবি/জেবি)