আমি লজ্জিত, আমি একজন পুরুষ

রেজাউল করিম
 | প্রকাশিত : ০৮ জুলাই ২০১৯, ২২:৫০

নিস্পাপ সাত বছরের শিশু সায়মা। সুন্দর পৃথিবী সম্পর্কে ভালো কোন ধারণা হওয়ার আগেই নিস্পাপ শরীরে বর্বরতার ছাপ এঁকে দিল নৃশংস ধর্ষক। ধর্ষণ করেই থেমে থাকেনি মানুষরূপী সেই নরপশু। শ্বাসরোধে হত্যা করেছে শিশুটিকে। গত শুক্রবার রাজধানীর ওয়ারিতে এমন ঘটনা ঘটে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ জানিয়েছেন, সায়মার দেহে ধর্ষণের আলামত মিলেছে। ধর্ষণের পর তাকে গলায় রশি পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যার বিষয়টিও নিশ্চিত হওয়া গেছে। শিশুটির শরীরে নানা ধরনের আলামত অনেকটাই বলে দিচ্ছে হত্যার আগে শিশুটির সাথে কেমন আচরণ করা হয়েছে।

প্রতিদিন খবরের কাগজ হাতে নিয়ে ভাবতে হয়, কেমন খবর দিয়ে আজকের পত্রিকা পড়াটা শুরু হবে। বিশেষ করে ধর্ষণের বিষয়টি যেন পত্রিকার প্রতিদিনের খবর। নারী ধর্ষণ, নারী লাঞ্ছিতের সাথে বর্তমানে যোগ হয়েছে শিশুদের ওপর এমন লালসা।

১৫ জুন ব্রুনের ইনফেকশন পরীক্ষার নামে রাজধানীর ধানমন্ডির পপুলার হাসপাতালের চর্ম ও যৌনরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. শওকত হায়দার তরুণী রোগীর গালে চুমু দেয়। ভুক্তভোগী ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই নারী শিক্ষার্থী পপুলার হাসপাতালের মানবসম্পদ ও প্রশাসন বিভাগের প্রধান অচিন্ত্যকুমার নাগের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। যদিও ওই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে আইনি নোটিশও এসেছে।

নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায়য় বাইতুল হুদা ক্যাডেট মাদ্রাসার ১২ ছাত্রীকে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির অভিযোগে আটক হয়েছে ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আল আমিন।

২০১৭ সালের ২৮ মার্চ রাতে টাঙ্গাইল সদর উপজেলার বিন্যাফৈর এলাকায় মাকে আপত্তিকর প্রস্তাব দেয়ায় নেশাখোর ছেলে হযরত আলী নামে এক ছেলেকে কুপিয়ে হত্যা করে মায়ের আত্মসমর্পন হওয়ার ঘটনাও আমাদের দেখতে হয়েছে।

২৭ জুন সিদ্ধিরগঞ্জের অক্সফোর্ড হাইস্কুলের সহকারী শিক্ষক আরিফুল ইসলাম আটক হয়ে ২০ ছাত্রীকে ধর্ষণের দায় স্বীকার করে।

চিকিৎসক থেকে শিক্ষক, মাদ্রাসার অধ্যক্ষ থেকে গাড়িচালক এমক কি পেটের সন্তানের কাছেও নারী নিরাপদ নয়।

নেত্রকোণার কেন্দুয়ায় দোজখের আগুনে পোড়ানোর ভয় দেখিয়ে একাধিক ছাত্রীকে মাদ্রাসাশিক্ষক আবুল খায়ের বেলালীর ধর্ষণের সংবাদও পড়া হলো। শিশু থেকে শতবর্ষী নারী কারো নিরাপত্তার নিশ্চয়তা নেই। কিছু পুরুষের এমন কাণ্ড দেখে নিজেকে পুরুষ পরিচয়ে বড়ই লজ্জা হয়।

এমজেএফের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত ছয় মাসে ধর্ষণ ও ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছে ৩৯৯টি শিশু। অন্যদিকে ৪৯৬টি শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম (বিএসএএফ)। এর মধ্যে গণধর্ষণ হয়েছে ৫৩টি। ২৭ প্রতিবন্ধী শিশুও ধর্ষিত হয়েছে। আর ধর্ষণের পর ২৩ শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। মোট শিশু হত্যা হয়েছে ২০৫ জন। যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে ১২০ শিশু।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত জানুয়ারি থেকে জুনের মধ্যে সর্বাধিক এপ্রিল মাসে ১২২টি শিশু ধর্ষিত হয়। জুন মাসে হয় ১১৯টি। ছয় মাসে শিশু হত্যার চেষ্টা হয়েছে ২৮টি। ৯৩টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ধর্ষণের পর আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ১০টি। চুরি হয়েছে ১২০ শিশু। হারিয়ে গেছে ৭২ শিশু। এর মধ্যে ২৪ জনকে মৃত ও ২২ জনকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।

ধর্ষণ কেন বাড়ছে এ নিয়ে উদ্বিগ্ন পুরো জাতি। নরপশু পুরুষদের পাশাপাশি নারীর বেপর্দা চলাচল, যুগের সাথে তাল মিলিয়ে ছোট পোশাক এবং ধর্ষণের পর দ্রুত বিচার না হওয়ায় ধর্ষণের বৃদ্ধিও কারণ বলছেন কেউ কেউ। এছাড়া কিশোর বয়সে অবাধে স্মার্টফোন ব্যবহার। কিশোর বয়সে অবাধে পর্নগ্রাফি দেখার সুযোগ পাচ্ছে স্মার্টফোনে। ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা বাড়িয়ে ধর্ষণরোধ কিছুটা হলেও কমানো সম্ভব। অভিভাবকের সচেতনতাটা জরুরি। কিশোর বয়সে কোথায় যাচ্ছে, কার সাথে মিশছে, মোবাইল ফোন কীভাবে ব্যবহার করছে- এদিকে অভিভাবকদের নজর দেয়াটাও জরুরি। অধিকাংশ শিশু পড়ার টেবিলে নেই। হাতে মোবাইল ফোন। কি করছে মোবাইল ফোন দিয়ে? লাইনচ্যুত হচ্ছে কিনা? পর্নগ্রাফি সাইটে যাচ্ছে কিনা সেদিকে খেয়াল রাখলে হয়তো এতোটা নৈতিক অবক্ষয় ঘটবে না। এতে ধর্ষণ কমার সম্ভাবনা রয়েছে। শুধু পর্নগ্রাফি নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নেয়াই যথেষ্ট না। কম বয়সে স্মার্টফোন ব্যবহার এবং ইন্টারন্টে চালানোর প্রতিও নজরদারি জরুরি।

রাশিয়ান বিজ্ঞানী পাভলভ কুকুরের লালা ঝরার যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন সেটা দেশের ধর্ষণ বৃদ্ধিও কারণ নির্ণয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অর্থ বহন করতে পারে।

১৩৯ বছর আগে রাশিয়ান বিজ্ঞানী পাভলভ একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন, যার মাধ্যমে ধর্ষণের কারণ জানাও রোধ করা সহজ হবে। পাভলভ একদল কুকুরকে ল্যাবে বেঁধে রেখে দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন। তিনি প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে তাদের খাবার দিতেন। প্রতিদিন ঠিক একই সময়গুলোতে কুকুরগুলোকে খাবার দেয়া হতো। পাভলভের সঙ্গে থাকতেন তার ল্যাব সহকারী। খাবারের সময় কুকুরের কী পরিমাণ লালা ঝরত সেটি একটি কন্টেইনারে মাপা হতো। কিছুদিন পর পাভলভ দেখলেন, খাবার গ্রহণ নয়, খাবার দেখেও এবার কুকুরের লালা ঝরতে শুরু করেছে। পাভলভ খাবার দেখে কুকুরের কী পরিমাণ লালা ঝরত সেটিও কন্টেইনারে মাপার ব্যবস্থা করলেন। বেশ কিছুদিন যাওয়ার পর পাভলভ দেখলেন তিনি ল্যাবে ঢুকলেই কুকুরের লালা বের হচ্ছে। সঙ্গে খাবার থাক আর না থাক। পাভলভ এবার নিজে ল্যাবে না গিয়ে খাবারবিহীন অবস্থায় তার সহকারীকে ল্যাবে পাঠালেন। ল্যাব সহকারী অবাক হয়ে দেখলেন তাকে দেখেও কুকুরের লালা ঝরছে। পাভলভ এবার ভিন্ন কিছু করলেন। তিনি কুকুরকে খাবার দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে একই সময়ে একটি ঘণ্টা বাজাতে থাকলেন। খাবার দেয়া হচ্ছে এবং ঘণ্টা বাজানো হচ্ছে। এরপর খাবার ছাড়া শুধু ঘণ্টা বাজালেও দেখলেন কুকুরগুলোর একই পরিমাণ লালা ক্ষরণ হচ্ছে। পাভলভ সিদ্ধান্তে আসলেন- খাবারের প্যাকেট, ল্যাব অ্যাসিস্টেন্ট, ঘণ্টার শব্দ, এসব নিউট্রাল স্টিমুলেশন। এগুলোর সঙ্গে লালা ক্ষরণের সম্পর্ক নেই। কিন্তু কুকুর তার লার্নিং বিহেভিয়ারে খাবারের সঙ্গে খাবারের প্যাকেট, পাভলভ, ল্যাব সহকারী বা ঘণ্টার শব্দকে কো-রিলেট করে ফেলেছে এবং খাবারের সঙ্গে যা যা ঘটে সবকিছুকেই লালা ক্ষরণের উপাদান হিসেবে তার ব্রেইন ডিটেক্ট করছে। পাভলভের ব্যাখ্যাটি আমলে মানুষরূপী ওইসব চিহ্নিত কুকুরদের বিচার কার্য দ্রুত করতে হবে।

যে দেশে নারী রাজত্ব, নারী প্রধানমন্ত্রী, নারী স্পিকার, আরেকটি বড়দল বিএনপি চেয়ারপার্সন নারী, এমনকি দেশের বহু বড় বড় চেয়ারগুলো নারীদের দখলে- সেদেশে নারীদের এমন অসম্মান কাম্য নয়।

অন্যদিকে নারী স্বাধীনতা, নারী আন্দোলন, নারী অধিকার নিয়ে সর্বত্র আলোচনা-সমালোচনা, বক্তৃতা সেই চলমান সময়ে দেশে বেড়েই চলেছে ধর্ষণের সংখ্যা৷ কিন্তু কেন? এর জন্য কারা দায়ী, কী করে ধর্ষণ কমিয়ে আনা সম্ভব? ধর্ষিতা নারীদের কী-ই বা করা উচিৎ? এ বিষয়ে নারী তথা দেশকে আরও ভাবতে হবে। আমাদের শিশু ও নারীদের নিরাপত্তা দিলে পুরো জাতি নিরাপদে থাকবে।

লেখক: সংবাদকর্মী

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :