হুজুগিপনার শেষ কোথায়?

প্রকাশ | ১৩ জুলাই ২০১৯, ১৫:১৬

মানিক মুনতাসির

ঘটনা -১: মঙ্গলবার রাত সোয়া ১১টা সিদ্ধেশ্বরী মনোয়ারা হাসপাতালের সামনে থেকে বউ বাচ্চাসহ উবারের গাড়িতে উঠলাম। গন্তব্য ভাড়া বাসা নামের পায়রার খোপ খিলগাঁও। যাই হোক বেইলি রোড ক্রস করে ফ্লাইওভারে উঠতেই ড্রাইভার বলল স্যার পদ্মা নদীতে আর কয়টা কল্লা লাগবো জানেন? আমি রীতিমত হতভম্ব। সামনের সিটে বসা আমার বড় ছেলে কল্প বলল, বাবা কল্লা কী জিনিস। আমি প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য নীরব থাকলাম। ছেলেকে বললাম বাবা গাড়িতে একটু ঘুমাও। সকালে স্কুল আছে। গাড়িচালক আবারো বলল, স্যার আমাদের ভোলায় তো সব স্কুল বন্ধ করে দিছে। বললাম কেন? তার উত্তর প্রত্যেক স্কুলের প্রধান শিক্ষককে বলে দেওয়া হয়েছে সাতজন করে দিতে হবে। জানতে চাইলাম কী দিতে হবে? উত্তরে সে বলল ওই যে পদ্মা সেতুর জন্য মাথা লাগবে। সে আরও বলল, আজ  সন্ধ্যায় মোহাম্মদপুর থেকে সাতজনকে ধরে নিয়ে গেছে। আমি বললাম এসব গুজব। আর কোথাও বলবেন না।

চালক স্মিত হেসে বলল স্যার আমারে বোকা ভেবেছেন। আমি বললাম তা না। হুজুগ! এবার সে একটু মাইন্ড করেছে মনে হলো। বললাম এসব চিন্তা না করে গাড়ি চালান। পৌনে ১২টার দিকে বাসার সামনে নামার সময় ভাড়া মিটিয়ে গেটের ভেতরে ঢুকবো ঠিক তখন চালকটি বলল, স্যার ঘটনা কিন্তু সত্যি, আপনার ছেলেটাকে কালকে স্কুলে দিয়েন না। আমি কোনো জবাব না দিয়ে ভেতরে চলে এলাম। অথচ সেতু বিভাগ এটা নিয়ে বার বার বলে যাচ্ছে এটা গুজব।

ঘটনা-২: ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে সামনে কোরবানির ঈদ এই গুজবে পেঁয়াজের দাম গত সাত দিনে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। কাল বাজারে গিয়ে জানলাম শ্যামবাজার ছাড়া রাজধানীর কোনো আড়ৎ কিংবা পাইকারি বাজারে পেঁয়াজ নেই। কারণ ভারত থেকে পেঁয়াজ আসছে না। অথচ ভারত তো পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করেনি। আর করলেই বা কি! আজকে যেটার এলসি খোলা হয় সেটা তো বাজার পর্যন্ত আসতে অন্তত এক বা তিন মাস লেগে যাবে। তার মানে আজকে আমদানি বন্ধ হলেও এর প্রভাব পড়ার কথা তিন মাস পর। কিন্তু সেটা কি হয়েছে। পেঁয়াজের গুদামগুলোতে নিশ্চয়ই টনকে টন পেঁয়াজ মজুদ আছে। নিশ্চয়ই তাহলে এখানে একটা হুজুগিপনা আর অসততা কাজ করছে। যা হয়তো গুটি কয়েক ব্যবসায়ী বা আমদানিকারক এটা করছে।

এবার আসুন কোনো ঘটনার কথা না বলে প্রধানমন্ত্রীর একটি উদ্ধৃতি নিয়ে কথা বলি। তিনি বলেছেন, উন্নয়ন চাইলে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি মানতে হবে। হ্যাঁ মানতে তো হবেই। কেননা এ দেশে জনগণের দাবি সর্বদাই উপেক্ষিত।

সাধারণ মানুষের কথা ভাবার সময় আমাদের নেই। কেননা এ দেশে অসাধারণের  সংখ্যা অনেক বেশি। দলের প্রধান থেকে ওয়ার্ডের নেতা। ছিঁচকে নেতা, পাতি নেতা সবাই অসাধারণ। সরকারি অফিসের সচিব থেকে পিয়ন। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মালিক থেকে তার চৌদ্দ গোষ্ঠী, বাস মালিক থেকে শ্রমিক নেতা সবাই ক্ষমতাধর। অক্ষম শুধু পাবলিক। এই আমজনতা শুধুই দর্শক। ফলে দাম বাড়লে তাদের কথা ভাবার কেউ নেই।

আচ্ছা উন্নয়নের জন্য দাম বাড়বে মেনে নিলাম। তাহলে তো তার ফিরতি দিতে হবে তাই না। ধরুন গত ১৫/২০ বছরে বাস ভাড়া বেড়েছে ১৫ বার কিন্তু যাত্রীসেবা কি বেড়েছে? গ্যাসের দাম বেড়েছে কিন্তু সংকট কি কেটেছে? এখনো রাজধানীর বহু এলাকায় গ্যাসের জন্য হাহাকার চলে। ওয়াসার পানির দাম বেড়েছে কিন্তু সে পানি কি পান করা যায়? ময়লা কি কমেছে? বিদ্যুতের দাম দ্বিগুণ হয়েছে কিন্তু লোডশেডিং কি বন্ন্ধ হয়েছে? প্রত্যেক এলাকায় সিটি করপোরেশনের হোল্ডিং ট্যাক্স বেড়েছে কিন্তু নিরাপত্তা কতখানি বেড়েছে? সেবাই বা কতটা বেড়েছে। মোবাইল ফোনের কলরেট বেড়েছে কিন্তু কলড্রপ কি থেমেছে? ইন্টারনেটের দাম বেড়েছে কিন্তু সে হারে কি গতি বেড়েছে?

মাছ, মাংস, দুধ, ডিমের দাম বেড়েছে কিন্তু ভেজাল কি কমেছে একটুও? গাড়ি বেড়েছে, চালক বেড়েছে রাস্তা বেড়েছে, রাস্তার নির্মাণ ব্যয় বেড়েছে কিন্তু রোড এক্সিডেন্ট কি কমেছে? মানুষ তো বেহিসাব মারা যাচ্ছে। পুলিশের বরাদ্দ বেড়েছে সরকারি চাকুরেদের বেতন বেড়েছে কিন্তু দুর্নীতি কি কমেছে?

এবার আসুন ভাবি আইন বেড়েছে, সাজা বেড়েছে কিন্তু ধর্ষণ কি কমেছে না বেড়েছে। মানুষের আয় বেড়েছে কিন্তু ব্যয় তার চেয়ে কত বেশি বেড়েছে তা কি ভেবেছে কেউ। মানুষের আয়ু বেড়েছে কিন্তু মানবিকতা কি বেড়েছে। নিত্য নতুন ওষুধ বেড়েছে মশা মারার বরাদ্দ বেড়েছে কিন্তু ডেঙ্গু কি নিয়ন্ত্রণে এসেছে। এক মাসেই ডেঙ্গু রোগী বেড়েছে পাঁচগুণ। তাহলে উন্নয়নটা কোথায়? প্রশ্নটা আসতেই পারে।

এবার চোখ খুলে তাকান বড় বড় ফ্লাইওভার, চারলেনের রাস্তা, বড় বড় সেতু, উঁচু উঁচু ভবন, নতুন রেল, বাড়ি বাড়ি পাকা আধা পাকা পায়খানা, সমুদ্রসীমা অর্জন, বিদেশে নেতাদের বাড়ি, পাতি নেতাদের নতুন নতুন গাড়ি এসব কি উন্নয়ন নয়?

এছাড়া ফুটপাতে পুলিশ বক্স, রাস্তার মোড়ে মোড়ে পুলিশ কার্যালয়, ফুটপাতে টাইলস, টাইলসের ওপর ডাস্টবিন। আগে তো ডাস্টবিন ছিল রাস্তায়। এখন সেটা টাইলস লাগানো ফুটপাতে। আবার সেই ডাস্টবিন ঘেঁসে উন্নত যাত্রী ছাউনি।

আরেকটা বিষয় ঢাকার জলাবদ্ধতা। সেটা তো নিউইয়র্কেও হয়। হোয়াইট হাউজেও পানি ওঠে। হ্যাঁ ওঠে কিন্তু কত বছর পর ওঠে। কেন ওঠে? আর কতক্ষণ স্থায়ী হয়। সেটা তো বুঝতে হবে। কিন্তু ঢাকায় তো সারাবছরই সাঁতার কাটতে হয়। এখানকার জলাবদ্ধতা নিরসনে কত ব্যয় হয় তার সঠিক হিসাব কি আছে সিটি করপোরেশনের কাছে।

তারপরও বলি আরে ভাই একদিনে তো সব হবে না। সময় তো দিতে হবে। দেশটা তথা ঢাকা কি একদিনে লাসভেগাস আর লসএঞ্জেলস হয়ে যাবে এটা ভাবেন কেন? আপনি কি একদিনে বড় হয়েছেন। নয়ন বন্ডরা কি একদিনেই সাব্বির আহমেদ থেকে নয়ন বন্ড ( জেমস বন্ড) বনে গেছেন?

লেখক: সাংবাদিক