আমদানি কমার প্রচারে বেড়েছে পেঁয়াজের দাম

বৃষ্টিতে দেশি উৎপাদন নষ্ঠ হওয়াও কারণ

প্রকাশ | ১৫ জুলাই ২০১৯, ০৯:০২ | আপডেট: ১৫ জুলাই ২০১৯, ১৬:৩৯

জহির রায়হান, ঢাকাটাইমস

ঢাকার বাজারে এক মাসের মধ্যে পেঁয়াজের দাম দেড়গুণের চেয়ে বেশি বেড়ে গেছে। পাইকারি ও খুচরা বাজারের মধ্যেও দামের বিস্তর ব্যবধান। খুচরা পর্যায়ে ব্যবসায়ীরা দাবি করছেন, ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ বা কমে গেছে। এ কারণে দাম বেড়ে গেছে। তবে এমনটি ঘটেছে, এমন কোনো তথ্য নেই।

অবশ্য ব্যবসায়ীদের একটি তথ্য উদ্বেগজনক। তারা বলছেন, কৃষক যে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করেছে, আবহাওয়ার কারণে তার একটি বড় অংশ নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে দাম বেড়ে গেছে। ভারতেও দাম বেড়েছে। সামনে দাম আরও বাড়বে বলে ধারণা করছেন তারা।

গতকাল রাজধানীর হাতিরপুল কাঁচাবাজারে গিয়ে দেশি পেঁয়াজ ৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতে দেখা গেছে। ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছিল ৪৫ টাকা কেজি দরে। এক মাস আগে দেশি পেঁয়াজ ২৫ থেকে ২৭ টাকা, আর ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ২০ টাকার মতো।

শনিবার রাজধানীর শ্যামবাজারের আড়তে গিয়ে দেখা যায় সেখানে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩২ থেকে ৪২ টাকা। এক মাস আগেও দাম ছিল অনেক কম।

পেঁয়াজের দাম বাড়ল কেন? কারওয়ান বাজারের পাইকারি বিক্রেতা হাবিবুর রহমান বলেন, ‘প্রতিদিন ৫০০ গাড়ি পেঁয়াজ আমদানি প্রয়োজন। কিন্তু আসছে ২০০ গাড়ি পেঁয়াজ। আর আমরা পেঁয়াজ আমদানি করি না। যারা করে তাদের কাছ থেকে আমরা যে দামে কিনি সে অনুযায়ী বিক্রি করতে হয়।’

হাবিবুর রহমানের মতো বহু ব্যবসায়ী গত কয়েকদিন ধরে প্রচার করেছেন ভারত থেকে পেঁয়াজ আসছে না। আর এরপর প্রায় প্রতিদিনই দাম এক-দুই টাকা করে বেড়েছে।

এই প্রচার কি সত্য? জানতে চাইলে শ্যামবাজারের মেসার্স রফিক ট্রেডার্সে আড়তের দায়িত্বে থাকা অতুল সরকার ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘কয়েক দিন আগে আমদানি কিছুটা কমেছিল। এখন পোর্ট দিয়ে ভালোভাবেই পেঁয়াজ ঢুকছে।’

এই প্রতিষ্ঠানটি পেঁয়াজ আমদানি করে। তারা যখন বলছে আমদানি স্বাভাবিক, তখন সেটা ধর্তব্যে নিতেই হয়। তাহলে এই গুজব কে বা কারা ছড়িয়েছে, সেটা জানার কোনো উপায় নেই।

শ্যামবাজারের আরেক প্রতিষ্ঠান মেসার্স বিক্রমপুর ট্রেডার্সের ম্যানেজার নয়ন বলেন, ‘আমদানিতে কিছুটা ধীরগতি ছিল কয়েক দিন। তাই দাম বেড়েছে। এখন আমদানি স্বাভাবিক। আর বৃষ্টির কারণে দেশি পেঁয়াজ এবার সংরক্ষণ ভালোভাবে হয়নি। পেঁয়াজ পচে যাচ্ছে।’

পেঁয়াজ উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। তবে সিংহভাগ উৎপাদন দেশেই হয়, আর একটি অংশ আসে আমদানি হয়ে যার সিংহভাগই আসে ভারত থেকে। নানা সময় ভারত রপ্তানি কমিয়ে দিলে বা সে দেশে দাম বেড়ে গেলে বাংলাদেশে যে দামেই আমদানি হয়ে থাকুক না কেন, দাম বাড়িয়ে দেন ব্যবসায়ীরা। আর ভারতীয় পেঁয়াজের দামের ওপরই ঠিক হয় দেশি পেঁয়াজের দাম। কৃষক লাভবান হয় কমই, যারা পেঁয়াজ কিনে মজুদ করেছেন, মুনাফা বাড়ে তাদের।

গত বছর বাংলাদেশে উৎপাদিন হয়েছে ২২ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ। আর আমদানি হয়েছে সাত লাখ মেট্রিক টন। চলতি বছর উৎপাদন বেড়ে ২৬ লাখ মেট্রিক টন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। পাশাপাশি চলছে আমদানি।

শ্যামবাজারের মেসার্স রফিক ট্রেডার্সের অতুল সরকার মনে করছেন, পেঁয়াজের দাম আরও বাড়বে। যুক্তি হিসেবে তিনি বলেন, ‘দেশি পেঁয়াজ যখন কৃষকরা ঘরে তুলবে তার আগে কিছু দিন বৃষ্টি হয়েছিল। এর ফলে ক্ষেতে পানি জমে যায়। এখন বৃষ্টি বেশি হওয়ায় সে পেঁয়াজ পচে যাচ্ছে। ঈদের পর পেঁয়াজের দাম বাড়বে।’

‘পাবনা, ফরিদপুর, রাজবাড়ীতে পেঁয়াজ বেশি উৎপাদন হয়। আপনি সেখানে খোঁজ নিয়ে দেখুন। সেখানে ঘরে ঘরে পেঁয়াজ পচার গন্ধ। দেশে পেঁয়াজ ঈদের পর শেষ হয়ে যাবে। তখন আমদানি করা পেঁয়াজে নির্ভরতা করতে হবে। আবার নতুন পেঁয়াজ ওঠার আগ পর্যন্ত বেশি দামে কিনতে হবে পেঁয়াজ।’

আমদানিকারক ঢাকার শ্যামবাজারের আব্দুল মাজেদ বলেন, ‘দেশি পেঁয়াজ শেষ পর্যায়ে। কৃষকরা যে সময় ঘরে পেঁয়াজ তুলেছে তখন বৃষ্টি হওয়ায় অনেক পচে গেছে। আসলে কৃষকের অনেক ক্ষতি হয়েছে। তাদের প্রতি কেজি পেঁয়াজ উৎপাদনেরই খরচ হয়েছে ৩০ টাকা।’

‘ভারতে এখন ১৫ থেকে ১৬ রুপিতে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। এরপর বন্দরে আনতে খরচ হয় ছয় রুপি। তাতে বাংলাদেশি মুদ্রায় ২৭ টাকা হয়। আবার বন্দর থেকে শ্যামবাজারের আনতে প্রতিকেজিতে তিন থেকে সাড়ে তিন টাকা খরচ হয়। এখন সোজা কথা ভারতে পেঁয়াজের দাম বাড়লে এখনেও পেঁয়াজের দাম বাড়বে।’

মেসার্স নিউ মদিনা ট্রেডার্সের মালিক আজহার বলেন, ‘ভারতে পেঁয়াজের দাম বাড়ার কারণে বাংলাদেশেও দাম বেড়েছে। এর পর রয়েছে দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজ পচে যাওয়া।’

পাইকারি ও খুচরা বাজারের পার্থক্য ‘বেশি’

শ্যামবাজার ও কারওয়ানবাজারের আড়তে যে দামে পেঁয়াজ বিক্রি হয়, বিভিন্ন পাড়া মহল্লার খুচরা বাড়ারে দাম তার চেয়ে অনেক বেশি।

শনিবার শ্যামবাজারে একটি আড়তে দেখা যায় সেখানে প্রতিকেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ২৮ থেকে ৩৬ টাকা। ২৮ টাকার পেঁয়াজ তুলনামূলকভাবে ছোট।

অথচ গতকাল হাতিরপুল বাজারে দেশি পেঁয়াজ ৫০ টাকার নিচে পাওয়া যায়নি। এই দাম সরকারের ঠিক করা ‘যৌক্তিক মূল্যের’ চেয়ে বেশি।

কৃষি বিপণন অধিদপ্তর মনে করছে, গতকাল খুচরা পর্যায়ে দেশি পেঁয়াজের যৌক্তির মূল্য হওয়া উচিত ছিল ৪১ থেকে ৪৮ টাকা। কিন্তু বাজারে দুই থেকে চার টাকা বেশি দেখা গেছে।

ভারতীয় পেঁয়াজের যৌক্তিক মূল্যের চেয়ে বাজার দর আরো বেশি। গতকাল হাতিরপুল বাজারে ৪০ টাকার নিচে ভারতীয় পেঁয়াজ পাওয়া যায়নি। বেশির ভাগ দোকানে দাম ছিল ৪৫ টাকা।

তবে আগের দিন শ্যামবাজারে ভারতীর পেঁয়াজ বিক্রি হতে দেখা গেছে ২০ থেকে ৩০ টাকায়। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর মনে করছে খুচরা পর্যায়ে লাভ করার পর যৌক্তিক মূল্য হওয়া উচিত ২৮ থেকে ৩২ টাকা।

একমাসে কত বাড়ল দাম

কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত ১১ জুন খুচরা বাজারে দেশি পেঁয়াজের দাম ছিল ২৫ থেকে ৩৫ টাকা, আর আমদানিকাকৃত পেঁয়াজের দাম ২৮ ছিল ৩৫ টাকা। গতকাল কারওয়ান বাজারের পাইকারি বিক্রেতা হাবিবুর রহমান প্রতি কেজি বিক্রি করেছেন ৪০ থেকে ৪২ টাকায়। ভারতীয় পেঁয়াজের দাম ছিল ৩৪ টাকা।

ফরিদপুরের মোকামেও বাড়ছে দাম

ফরিদপুর প্রতিনিধি জানান, জেলার বোয়ালমারী, সালথা ও নগরকান্দা উপজেলার বড় অংশজুড়ে পেঁয়াজ আবাদ হয়। রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় যায় এখানকার পেঁয়াজ। এই মোকামে পাইকারি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা কেজি। পেঁয়াজে পচন ধরায় এই মূল্যবৃদ্ধি বলে জানান সেখানকার ব্যবসায়ীরা।

সালথা উপজেলার পেঁয়াজ ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘গত দুই বছর ধরে এ অঞ্চলের চাষিরা লাল তীর কিং পেঁয়াজ বীজের (ভারতীয়) আবাদ করে। এই জাতের পেঁয়াজে ভালো ফলন হয়, কিন্তু বেশি দিন ঘরে রাখা যায় না। এবার পচনের মাত্রা অনেক বেশি।’

সদর উপজেলার কানাইপুর কাঁচাবাজারের ইজারাদার সেলিম মাতবর বলেন, ‘এবার বিশেষ এক ধরনের রোগে কৃষকের ঘরের অনেক পেঁয়াজ পচে গেছে। তাই বাজারে পেঁয়াজের সংকট দেখা দিয়েছে। ভবিষ্যতে ভারতীয় পেঁয়াজের সরবরাহ না বাড়ালে দাম আরও বেড়ে যেতে পারে।’

ঢাকাটাইমস/১৫এপ্রিল/জেআর/এমআর